সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে শুরু করে অফিসের সর্বনিম্ন পদে কর্মরত পিয়ন-ঝাড়ুদারকেও সম্পদের হিসাব জমা দিতে হবে। এতদিন যারা ট্যাক্স দিতেন, শুধু তারাই সম্পদের হিসাব দিতেন। এ ছাড়া অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা এবং সমমর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের আয় ও সম্পদবিবরণী জমা দিতে হবে। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আয়ের স্বচ্ছতা আনতেই এই উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। ইতোমধ্যে এ-সংক্রান্ত সরকারি কর্মচারীদের সম্পদের হিসাব দাখিলের প্রক্রিয়া ও এ-সংক্রান্ত চার পৃষ্ঠার একটি ফর্ম প্রকাশ করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। সম্পদের হিসাব দিতে গেলে সব সরকারি কর্মচারীকে তিনটি অংশে ঘরবাড়ি, বাগানবাড়ি, স্বর্ণালঙ্কার, ব্যক্তিগত গাড়িসহ ৩৫ রকমের তথ্য দিতে হবে সরকারকে। এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়েছেন অনেকেই। তবে দুর্নীতিবাজ ও অনিয়ম করে অর্থ কামানো কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে রয়েছে আতঙ্ক।
জানা গেছে, সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা-১৯৭৯, যা ২০০২-এ সংশোধনী এনে সরকারি কর্মচারীদের সম্পদবিবরণী পাঁচ বছর পর পর দেওয়ার বিধান করা হয়। দেশে বর্তমানে প্রায় ১৫ লাখ সরকারি কর্মচারী রয়েছেন। আচরণবিধিমালা অনুসারে, নিজ নিজ নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষকে সরকারি কর্মচারীর সম্পদের হিসাব জমা দেওয়ার কথা। যা বিগত দিনগুলোতে পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা যায়নি।
সম্পদের হিসাব বিষয়ে সাবেক সচিব এ কে এম আবদুল আউয়াল মজুমদার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সরকারি চাকরিজীবীদের সম্পদের হিসাব নেওয়ার যে উদ্যোগ, এটা খুবই ভালো উদ্যোগ। এতে তদারকি থাকবে, জবাবদিহি থাকবে, মানসিক চাপ থাকবে। যা দীর্ঘদিন ছিল না। জবাবদিহি না থাকলে মানুষ লাগামহীন হয়। এটা বছর বছর নেওয়া উচিত, যা আগে থেকেই বলে আসছি। সম্পদের হিসাব নিয়ে সেটাকে যাচাইবাছাই করতে হবে। হিসাব নিয়ে বস্তাবন্দি করে রাখলেই হবে না। সাবেক এই সচিব বলেন, এ কারণে অনেক দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা আতঙ্কে থাকবে। যদি সম্পদের হিসাব যাচাইবাছাই করে দু-চার-দশজনকে ধরা হয় তখন আরও আতঙ্কে থাকবে দুর্নীতিবাজরা।বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর গত ১ সেপ্টেম্বর এ লক্ষ্যে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করে সব সরকারি কর্মচারীকে সম্পদবিবরণী দাখিলের নির্দেশনা দেওয়া হয়। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রতি বছর ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে সম্পদের হিসাব জমা দিতে হবে। তবে চলতি বছর সম্পদের হিসাব জমা দিতে হবে ৩০ নভেম্বরের মধ্যে। হিসাব জমা দেওয়ার ফরম সহজ করার জন্য পাঁচ সদস্যের একটি কমিটিও করা হয়েছিল। সেই কমিটি একটি ফরমেট তৈরি করে দেয় সম্পদ বিবরণ জমা দেওয়ার জন্য। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে জানা গেছে, ইতোমধ্যেই বিভিন্ন মন্ত্রণালয় থেকে অধীনস্ত বিভাগ/সংস্থায় পাঠানো হয়েছে সম্পদের বিবরণী ফর্ম। গত কয়েকদিন সচিবালয়ে একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, এটি ভালো উদ্যোগ। তবে যারা অনিয়ম করে অবৈধ অর্থের পাহাড় গড়েছেন তারা চিন্তায় আছেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক অতিরিক্ত সচিব বলেন, এটা নিয়ে আমার ন্যূনতম দুশ্চিন্তা নেই। একটি টাকাও বাড়তি কোনো আয় নেই। প্রতিবছর ট্যাক্স দিচ্ছি। সরকারের উদ্যোগ খুবই ভালো। তবে অনেকেই বলেন, এই সময়ে এটা না হলেও চলত। বাড়তি আবার কেন ফর্ম পূরণ করব। যুগ্ম সচিব পর্যায়ের এক কর্মকর্তা বলেন, দুর্নীতিবাজ কোনো কর্মচারী-কর্মকর্তা ভিতরে ভিতরে ভয়ে থাকবে এটা স্বাভাবিক। এটা নিয়মের মধ্যেই আছে, আগে চর্চা ছিল না।
যেসব তথ্য দিতে হবে সরকারকে : জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় তথ্যে জানা গেছে, সম্পদের হিসাব দেওয়ার ফর্মে তিনটি অংশের মধ্যে সাধারণ তথ্যাবলি অংশে ১৭ রকমের তথ্য দিতে হবে। আর সম্পদের অংশে আছে আরও ১৮ রকমের তথ্য। আর তৃতীয় অংশে কোনো দায় থাকলে উল্লেখ করতে হবে। সাধারণ তথ্যের মধ্যে রয়েছে- ১। কর্মচারীর নাম, ২। পরিচিতি নম্বর (যদি থাকে), ৩। পদবি, ৪। ক্যাডার (যদি থাকে), ৫। বর্তমান কর্মস্থল, ৬। চাকরিতে যোগদানের তারিখ, ৭। যোগদানকালে পদবি, ৮। স্থায়ী ঠিকানা, ৯। এনআইডি নম্বর, ১০। জন্ম তারিখ, ১১। টিআইএন, ১২। বেতন স্কেল, ১৩। মূল বেতন, ১৪। মোবাইল ফোন নম্বর, ১৫। ইমেইল (যদি থাকে), ১৬। বর্তমান ঠিকানা এবং ১৭। পরিবারের সদস্যদের (স্ত্রী/স্বামী/সন্তান) বিবরণ বিস্তারিত উল্লেখ করতে হবে। সম্পদের অংশে সরকারি কর্মচারী নিজ ও পরিবারের সদস্যদের নামে দেশে ও বিদেশে অর্জিত সব স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদের তথ্য উল্লেখ করতে হবে। যেখানে ১৮ ধরনের তথ্যের মধ্যে স্থাবর সম্পদ এবং অস্থাবর সম্পদের আলাদা তথ্য দিতে হবে। স্থাবর সম্পদের মধ্যে ১। কৃষি এবং অকৃষি জমির অবস্থান কোথায় তা তুলে ধরে পরিমাণ মৌজা, খতিয়ান নং, দাগ নং, হোল্ডিং নং দিতে হবে। জমির পরিমাণ, অর্জনের ধরন অর্থাৎ উত্তরাধিকার/ক্রয়/দান/অন্যান্য বা যৌথ মালিকানা থাকলে উল্লেখ করতে হবে। যার নামে সম্পদ নিজ/স্ত্রী/স্বামী/সন্তান তা উল্লেখ করতে হবে। সম্পদ অর্জনের তারিখ ও মূল্য এবং ক্রয় হলে অর্থের উৎস উল্লেখ করতে হবে। এ ছাড়া ২। ইমারত, ৩। বসতবাড়ি, ৪। ফ্ল্যাট, ৫। খামার/বাগানবাড়ি, ৬) ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান এবং ৭। অন্যান্য তথ্য থাকলে উল্লেখ করতে হবে। অস্থাবর সম্পদের হিসেবে ১১ তথ্য দিতে হবে। এর মধ্যে ১। অলংকারাদি, ২। স্টকস/শেয়ার/ডিবেঞ্চার/বন্ড/সিকিউরিটিজ, ৩। সঞ্চয়পত্র/প্রাইজ বন্ড/সঞ্চয় স্কিম, ৪। বিমা, ৫। নগদ/ব্যাংকে গচ্ছিত অর্থ/ ঋণ প্রদানকৃত অর্থ, ৬। এফডিআর/ডিপিএস, ৭। জিপিএফ/সিপিএফ, ৮। মোটরযান (ব্যক্তিগত/বাণিজ্যিক), ৯। ইলেকট্রনিক্স জিনিসপত্র/আসবাবপত্র, ১০। আগ্নেয়াস্ত্র এবং ১১। অন্যান্য তথ্য থাকলে উল্লেখ করতে হবে। অস্থাবর সম্পদও কার নামে তা উল্লেখ করতে হবে। সম্পদের পরিমাণ এবং কীভাবে অর্জনের অর্থাৎ ধরন, অর্থের উৎস উল্লেখ করতে হবে হিসাব বিবরণীতে। তৃতীয় অংশে দায় থাকলে নিজ/স্ত্রী/স্বামী/সন্তানের নামে ঋণ থাকলে তা দেওয়া যাবে। সে ক্ষেত্রে ঋণদাতা ব্যক্তি/প্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখ করে ঋণের ধরন (গৃহনির্মাণ/কম্পিউটার/মোটরযান/অন্যান্য) এবং ঋণের পরিমাণ, ঋণ গ্রহণের তারিখসহ দিতে হবে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বিধি অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. ওবায়দুর রহমান এক বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছেন, ক্যাডার বা প্রথম শ্রেণির নন-ক্যাডার কর্মকর্তা (নবম গ্রেড এবং তদূর্ধ্ব) তার নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে প্রশাসনিক মন্ত্রণালয়ের সচিবের কাছে তার সম্পদবিবরণী নির্ধারিত সময়ে দাখিল করবেন। দ্বিতীয় শ্রেণির গেজেটেড/নন-গেজেটেড কর্মকর্তারা (দশম গ্রেড) নিজ নিজ নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের কাছে তার সম্পদবিবরণী নির্ধারিত সময়ে দাখিল করবেন। মন্ত্রণালয়/বিভাগ এবং এর অধীনস্ত সরকারি অফিস/প্রতিষ্ঠানের গ্রেড-১১ থেকে গ্রেড-২০ পর্যন্ত কর্মচারীরা তাদের নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের কাছে তাদের সম্পদবিবরণী নির্ধারিত সময়ে দাখিল করতে বলা হয়েছে। সম্প্রতি এক ব্রিফিংয়ে সম্পদবিবরণী জমা না দিলে এবং তথ্য গোপন করলে শাস্তি দেওয়া হবে জানিয়েছেন জনপ্রশাসন সিনিয়র সচিব ড. মো. মোখলেস উর রহমান। এ ক্ষেত্রে দুই ধরনের দন্ড হবে- লঘুদন্ড ও গুরুদন্ড। সিনিয়র সচিব জানিয়েছেন, লঘুদন্ড হচ্ছে তিরস্কার, নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য পদোন্নতি বা বেতন বৃদ্ধি স্থগিত রাখা; কর্তব্যে অবহেলা বা সরকারি আদেশ অমান্য করার কারণে সরকারের আর্থিক ক্ষতির সম্পূর্ণ অংশ বা অংশবিশেষ বেতন বা আনুতোষিক থেকে আদায় করা; বেতন গ্রেডের নিম্নতর ধাপে অবনমিতকরণ। আর গুরুদন্ড হলো- নিম্নপদ বা নিম্নবেতন গ্রেডে অবনমিত করা, বাধ্যতামূলক অবসর, চাকরি থেকে অপসারণ, বরখাস্ত করা। মোখলেস উর রহমান আরও বলেন, বছর বছর সম্পদবিবরণী দেওয়া হলো কর্মচারীদের জন্য একটা লাগাম। দুর্নীতির লাগাম টানতে হবে।