রাষ্ট্র সংস্কার শুরুর আগে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে তৃতীয় দফায় গত শনিবার বৈঠক করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সংলাপে অংশ নেওয়া অধিকাংশ রাজনৈতিক দল দ্রুত নির্বাচনি রোডম্যাপ ঘোষণা ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের ওপর বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সংস্কার কাজ শেষ করে যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচন দেওয়া হবে। বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা ছাড়াও উপদেষ্টা পরিষদের কয়েকজন সদস্য উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠকে অংশ নেওয়া রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সংলাপে কেউ প্রস্তাব দিয়েছেন নানামুখী সংস্কারের, আবার কেউ প্রস্তাব দিয়েছেন কেবল নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কারের। কেউ কেউ দ্রুত নির্বাচনের রোডম্যাপও জানতে চেয়েছেন। শনিবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে প্রথমে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় বিএনপির। এতে দলীয় মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে ছয় সদস্যের প্রতিনিধি দল অংশ নেয়। প্রায় ঘণ্টাখানেক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। যমুনা থেকে বেরিয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, নির্বাচনই তাঁদের এক নম্বর অগ্রাধিকার। তবে নির্বাচনের রোডম্যাপ নিয়ে তাঁরা সরকারের কাছে কোনো মাস বা দিন-কালের কথা বলেননি। জানা গেছে, বিএনপি ১৮টি দাবি সামনে রেখে কথা বলেছে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে। দ্রুত নির্বাচনি রোডম্যাপ ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো সংস্কার চায় বিএনপি। বিএনপির পর প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক করে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। আলোচনায় জামায়াত নেতারা যৌক্তিক সময়ের মধ্যে সংস্কার শেষ করে নির্বাচনের দাবি জানিয়েছেন। জামায়াতের আমির শফিকুর রহমানের নেতৃত্বে ১৩ সদস্যের প্রতিনিধি দল অংশ নেয়।
জামায়াত নেতারা মনে করেন, নির্বাচনের সংস্কার খুবই জরুরি। সে কারণে এ দলটি সংস্কারের গুরুত্ব বেশি দিয়েছে। বৈঠক শেষে জামায়াতের আমির শফিকুর রহমান বলেন, আমাদের দেওয়া দুটি রোডম্যাপের মধ্যে একটি সংস্কারের, আরেকটি নির্বাচনের। সংস্কার সফল হলেই নির্বাচন সফল হবে। অংশ নেওয়া রাজনৈতিক দলগুলোর একাধিক নেতা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানিয়েছেন, আমরা অন্তর্বর্তী সরকারকে সমর্থন জানিয়েছি। আমরা চাই না, অন্তর্বর্তী সরকার ব্যর্থ হোক। সে জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে দ্রুত নির্বাচনের আয়োজন করতে হবে। দ্রুত নির্বাচন না দিলে অথবা সংস্কার করতে দীর্ঘসময় লাগলে গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষ অস্থির হতে পারে। ভিন্ন পরিস্থিতির আশঙ্কা তৈরি হতে পারে। কমিউনিস্ট পার্টি ও বাম জোটের নেতারা বলছেন, নির্বাচিত সরকার ছাড়া সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষা করা যাবে না। এ জন্য নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার করে নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করার জন্য প্রধান অংশীজন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে এখনই আলোচনা শুরু করা প্রয়োজন।গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নূর সংলাপ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, জাতীয় সংসদের মেয়াদ এক বছর কমিয়ে চার বছর নির্ধারণ করার জন্য অন্তর্বর্তী সরকারকে পরামর্শ দিয়েছি। একই সঙ্গে আমরা একটি জাতীয় সরকার গঠনের কথা বলেছি। এ সময় রাষ্ট্র সংস্কারে ১২ দফা প্রস্তাবনা তুলে ধরা হয়েছে বলেও জানান তিনি।
আমার বাংলাদেশ পার্টি (এবি পার্টি) প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে ৬ দফা পর্যবেক্ষণ ও ১১ দফা প্রস্তাবনা পেশ করার কথা জানায়। দেড় থেকে দুই বছরের মধ্যে প্রয়োজনীয় সংস্কার করে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজনের আহ্বান জানিয়েছেন দলটির নেতারা। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, সংস্কার কমিশনগুলো তিন মাসের মধ্যে প্রতিবেদন দেবে। সেগুলো নিয়ে উপদেষ্টা পরিষদ রাজনৈতিক দল ও সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের সঙ্গে কথা বলবে। এরপর রিফর্মের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো একটা ন্যূনতম ঐকমত্যে আসবে। ঐকমত্যের ওপর নির্ভর করবে নির্বাচনের টাইমলাইন। কারণ কতটুকু রিফর্ম লাগবে সেটা দেখার বিষয়। শনিবার বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টাকে রাজনৈতিক দলগুলোর দেওয়া প্রস্তাব পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, নির্বাচনের রোডম্যাপ তাঁদের অন্যতম চাওয়া। তাঁরা বলছেন, আগামী দুই মাসের মধ্যে কঠোর পদক্ষেপ নিয়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটাতে হবে। বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দপ্তরে গতিশীলতা আনতে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনার তাগিদ দিয়েছেন রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা। প্রয়োজনে কয়েকটি মন্ত্রণালয়ে সহকারী উপদেষ্টা নিয়োগ করা। সংবিধান সংশোধন বা পুনর্লিখনের মাধ্যমে সরকারের বৈধতার সংকট সমাধানে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করার তাগিদ দেওয়া হয়েছে। সংবিধান সংশোধন বা প্রণয়নের জন্য একটি কন্সটিটুয়েন্ট অ্যাসেম্বলি গঠন করা এবং সংবিধান রচনার পর গণভোটে সেটি পাস করানো। অবিলম্বে গণতদন্ত কমিশন গঠন করে জুলাই-আগস্টে সংঘটিত সব নৃশংসতার ঘটনা জাতির সামনে তুলে ধরার ব্যবস্থা করা। প্রতিটি শহীদ পরিবারের পুনর্বাসনে স্পষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ। আহত ও পঙ্গু ছাত্র-জনতার চিকিৎসা কার্যক্রমকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়ার দাবি তোলা হয়েছে। সিভিল প্রশাসন ও সশস্ত্র বাহিনীর কর্মকর্তা ও সিপাহিদের মধ্যে যাদের অন্যায়ভাবে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে তাদের বিষয়ে একটি পৃথক কমিশন গঠন করা, যারা নিগ্রহ ও নিপীড়নের শিকার হয়েছেন তাদের চাকরিতে ফিরিয়ে আনা বা সম্মানজনক পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা। ফ্যাসিবাদের দোসর, গুম, খুন, বিচারবহির্ভূত হত্যা, মানবাধিকার লঙ্ঘন ও গণহত্যার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগী ব্যক্তি, সংগঠন ও রাজনৈতিক দলের বিচারের জন্য ‘মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনাল’-এর পাশাপাশি ‘ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশন’ গঠন করা, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দ্রুত বিচারক নিয়োগ দিয়ে তদন্ত ও বিচার কার্যক্রম শুরু করা, বিলম্বের কারণে বহু আসামি পালিয়ে যাচ্ছে, বহু আলামত নষ্ট হচ্ছে। বিচার প্রক্রিয়া স্বচ্ছ ও আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য করার জন্য আইনের প্রয়োজনীয় সংস্কার করা একান্ত আবশ্যক। পিলখানা ও শাপলা চত্বরের গণহত্যার জন্যও পৃথক বিচার কমিশন গঠন করার দাবি করা হয়েছে। দ্রব্যমূল্য সহনীয় মাত্রায় নিয়ে আসার জন্য নিয়মিত বাজার পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা চালু রাখা। চাঁদাবাজি, ছিনতাই, দুর্নীতি বন্ধ করা, ফুটপাত জনগণের চলাচলের জন্য হকারমুক্ত করা, অসহনীয় যানজট নিরসনসহ প্রাত্যহিক জনভোগান্তি দূর করার জন্য প্রশাসন, রাজনৈতিক দল, সামাজিক সংগঠন ও পরিবর্তন-প্রত্যাশী ছাত্র-জনতার সমন্বয়ে কেন্দ্রীয় ও আঞ্চলিক কমিউনিটি মনিটরিং টিম গঠনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা।