রফিকুল ইসলাম রনি ও শফিকুল ইসলাম সোহাগ
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক কোনো ঘোষণা না এলেও রাজনৈতিক দলগুলোতে বইছে নির্বাচনি হওয়া। দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপিসহ অধিকাংশ দল এককভাবে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে।
নির্বাচন কমিশনে বর্তমানে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল আছে ৫৩টি। এর অর্ধেকই আগামী সংসদ নির্বাচনে ৩০০ আসনে প্রার্থী দিতে চায়। সে টার্গেট নিয়েই চলছে দলগুলোর ভিতরে-বাইরে নানা প্রস্তুতি। কমপক্ষে ২০টি দলের শীর্ষ নেতার সঙ্গে কথা বলে এমন আভাস পাওয়া গেছে। বিগত পাঁচ-ছয়টি সংসদ নির্বাচন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, জোট ও ভোটের রাজনীতির কারণে দেশের বড় রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সারা দেশে ৩০০ আসনে প্রার্থী দিতে পারেনি। একমাত্র রাজনৈতিক দল ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ (চরমোনাই পীর) যাদের ৩০০ আসনে প্রার্থী দেওয়ার রেকর্ড আছে। এর মধ্যে একটি আসনে প্রার্থীর হলফনামা ত্রুটিপূর্ণ হওয়ায় প্রার্থিতা বাতিল হয়ে যায়। তারা ২৯৯ আসনে লড়াই করে। জানা গেছে, সংসদ নির্বাচনের ডামাডোল শুরু না হলেও আওয়ামী লীগ বাদে অন্য দলগুলো প্রতিটি আসনে প্রার্থী দিতে কাজ শুরু করেছে। বিগত কয়েকটি নির্বাচনে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী জোট করে ভোট করলেও আগামীতে এককভাবে লড়াই করার ঘোষণা দিয়েছেন দুই দলের নেতারাই। এখানেই শেষ নয়, আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট করে ক্ষমতায় আসা কিংবা আসন ভাগাভাগি করে বিরোধী দল হওয়া জাতীয় পার্টিও চায় ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনে এককভাবে সারা দেশে ৩০০ আসনে প্রার্থী দিতে। অতিসম্প্রতি নিবন্ধন পাওয়া গণ অধিকার পরিষদ (জিওপি), আমার বাংলাদেশ পার্টিও (এবি পার্টি) ৩০০ আসনে প্রার্থীর সন্ধান করছে। জানতে চাইলে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব ও দলের মুখপাত্র রুহুল কবির রিজভী আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘নির্বাচন কখন কীভাবে হবে তা এখনো নিশ্চিত নয়। নির্বাচন প্রক্রিয়া শুরু হলে দল কীভাবে অংশ নেবে সে সিদ্ধান্ত নেবে। তবে এখন ৩০০ আসন কেন্দ্র করে সারা দেশে দলকে সংগঠিত করা হচ্ছে।’ জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সাবেক এমপি অধ্যাপক মুজিবুর রহমান নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে জেলা পরিষদ অডিটোরিয়ামে জেলা জামায়াতের রুকন সম্মেলনে বলেছেন, ‘জামায়াত আগামী সংসদ নির্বাচনে ৩০০ আসনেই প্রার্থী দেওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছে।’গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নূর বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘দেশের মানুষ পরিবর্তন চায়। তরুণ নেতৃত্ব দেখতে চায়। তরুণ প্রজন্মই পারে মানুষকে নতুন কিছু দিতে। আর আমরাই সেটা পারব বলে বিশ্বাস করি। যখন নির্বাচন হবে আমরা ৩০০ আসনেই প্রার্থী দেব। মানুষ যে পরিবর্তন চাইছে, আমরাই হব সে পরিবর্তনের একমাত্র ভরসা।’ বিএনপি-জামায়াত-এবি পার্টি-গণ অধিকার পরিষদই নয়, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, খেলাফত মজলিস, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশ, এলডিপি, জাতীয় পার্টি-জেপি, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, ওয়ার্কার্স পার্টি, বিকল্পধারা বাংলাদেশ, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ, বাংলাদেশ জাসদ, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডি, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি-বিজেপি, বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশন, ন্যাশনাল পিপলস পাটি-এনপিপি, গণফোরাম, গণফ্রন্ট, কল্যাণ পার্টি, ইসলামী ঐক্যজোট, বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট, বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্ট-বিএনএফ, জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন-এনডিএম, তৃণমূল বিএনপি, গণসংহতি আন্দোলন-এসব দলের অধিকাংশই ৩০০ আসনে প্রার্থী দেওয়ার লক্ষ্যে সাংগঠনিক প্রস্তুতি নিচ্ছে। এ ছাড়া নিবন্ধিত দলগুলোর বাইরেও বিভিন্ন রাজনৈতিক দল আত্মপ্রকাশ করেই ৩০০ আসনে প্রার্থী দেওয়ার ঘোষণা দিচ্ছে।আওয়ামী লীগের শাসনামলে টানা তিনবার বিরোধী দলে থাকা জাতীয় পার্টিও আগামী সংসদ নির্বাচন এককভাবে করবে বলে জানা গেছে। জানতে চাইলে দলের ঢাকা বিভাগীয় অতিরিক্ত মহাসচিব ও প্রেসিডিয়াম সদস্য মীর আবদুস সবুর আসুদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের আগামীতে একক নির্বাচনের লক্ষ্যে সারা দেশে সংগঠন শক্তিশালী করছেন।’ তিনি বলেন, ‘আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচন প্রক্রিয়া শুরু হলে পার্টির চেয়ারম্যান কেন্দ্রীয় নেতাদের মতামতের ভিত্তিতে একক না জোটগত করবেন-পরিস্থিতি অনুযায়ী সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন।’
ইসলামী আন্দোলনের কেন্দ্রীয় প্রচার ও দাওয়াহ সম্পাদক মাওলানা আহমদ আবদুল কাইয়ুম বলেন, ‘আগামী সংসদ নির্বাচনে এককভাবে ভোট করার লক্ষ্যে দলকে তৃণমূল থেকে সংগঠিত করা হচ্ছে। আমরা ৩০০ আসনেই প্রার্থী দেব।’ ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নিয়েছেন নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তাঁর সরকার রাষ্ট্র সংস্কারে গুরুত্ব দিয়েছে। এজন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে তিন দফা বৈঠক করেছেন। দলগুলো নির্বাচনি রোডম্যাপ চাইছে। কোনো কোনো দল সংস্কারেও সময় দিতে চাচ্ছে। সহসা নির্বাচন না হলেও ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ ও তাদের কিছু মিত্র ছাড়া সবার মধ্যে নির্বাচনি আমেজ শুরু হয়েছে। প্রায় প্রতিটি দলই নির্বাচন ঘিরে সারা দেশে চালাচ্ছে সাংগঠনিক তৎপরতা। জানা গেছে, নির্বাচন নিয়ে তৎপরতা শুরু হওয়ায় সংসদীয় আসনের সম্ভাব্য প্রার্থীরাও নড়েচড়ে বসেছেন। অংশ নিচ্ছেন বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচিতে। সামাজিক কর্মকান্ডেও বেড়েছে তাদের তৎপরতা। সম্ভাব্য প্রার্থীরা কেন্দ্রীয় নেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছেন নানাভাবে। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের আন্দোলনে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী রাজপথে একসঙ্গে লড়লেও আগামী সংসদ নির্বাচনে মুখোমুখি হতে পারে দল দুটি। রাজনৈতিক মহলে জোর আলোচনা, ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনে বিএনপির শক্তিশালী প্রতিপক্ষ হয়ে উঠছে তাদের একসময়ের মিত্র জামায়াত। বিএনপি এককভাবে নাকি আন্দোলনের সাথিদের নিয়ে একসঙ্গে ভোট করবে তা এখনো স্পষ্ট নয়। তবে জামায়াতে ইসলামী ৩০০ আসনে দলীয় প্রার্থী দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। এ ছাড়া নির্বাচন সামনে রেখে আওয়ামীবিরোধী ইসলামী দলগুলো নিয়েও একটি জোট গড়ার পরিকল্পনা রয়েছে জামায়াতের। জানা গেছে, প্রায় ২৫ বছর একসঙ্গে চললেও ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে হাসিনা সরকারের পতনের পর বিএনপি-জামায়াতের বিরোধ অনেকটা প্রকাশ্যে আসে। দল দুটির নেতারা একে অন্যকে কটাক্ষ করে বক্তব্য দিচ্ছেন। বিএনপি দ্রুততম সময়ে নির্বাচন চাইলেও জামায়াত ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারকে নির্বাচন নিয়ে চাপ না দেওয়ার কথা বলছে। জামায়াত নেতারা বলছেন, গণ অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ মাঠে না থাকায় এবং ভোট পর্যন্ত বর্তমান পরিস্থিতির বদল না হলে আগামী নির্বাচন হতে পারে ‘বিএনপি বনাম জামায়াত’। আওয়ামী লীগবিরোধী সব দল নিয়ে বিএনপির প্রতিদ্বন্দ্বী একটি নির্বাচনি জোট গঠনেরও পরিকল্পনা আছে। এ লক্ষ্যে নির্বাচন সামনে রেখে নানা ছক কষছে জামায়াতে ইসলামী। ধর্মভিত্তিক দল ছাড়াও বিএনপির সঙ্গে একসময় যুগপৎ আন্দোলন করা এবং ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী দলগুলোকে পাশে রাখতে চাচ্ছে দলটি। এসব দলকে এক প্ল্যাটফরমে এনে নির্বাচনি জোটে রূপান্তরের পরিকল্পনা জামায়াতের।
এরই মধ্যে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে যুগপৎ আন্দোলন করা দলগুলোর সঙ্গে মতবিনিময় সভা করে তাদের কাছে টানার চেষ্টা করা হচ্ছে। ভবিষ্যতে সরকার গঠন করতে পারলে ছোটবড় সব দলকে ক্ষমতার অংশীদার করার প্রতিশ্রুতিও দিচ্ছে জামায়াতে ইসলামী।
গণতন্ত্র মঞ্চের শীর্ষ নেতা ও নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘দল বা জোটগত যা-ই বলেন, ৩০০ আসনে ভোট করাই আমাদের টার্গেট। তবে ভোট কীভাবে হবে তা এখনো চূড়ান্ত নয়। সময়মতো সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’ জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন (এনডিএম)-এর মহাসচিব মোমিনুল আমিন বলেন, ‘৩০০ আসনেই আমরা যোগ্য প্রার্থী দেব। নতুন বাংলাদেশের আকাঙ্ক্ষা যারা ধারণ করে এমন প্রার্থী খুঁজছি আমরা।’ তিনি জানান, শেখ হাসিনা সরকারের পতন আন্দোলনে বিএনপির সঙ্গে রাজপথে তারা ছিলেন। বিএনপি জোটগতভাবে আগামীতে ভোট করে কি না সবকিছু মিলিয়ে পরিস্থিতি অনুযায়ী চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। এ প্রসঙ্গে গণ অধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মো. রাশেদ খান বলেন, ‘আগামী নির্বাচনে গণ অধিকার পরিষদ ৩০০ আসনে প্রার্থী দেবে। জনগণ তরুণ নেতৃত্ব চায়। আমরা চাই জাতীয় সংসদে কমপক্ষে ১৫০ জন তরুণ সংসদ সদস্য থাকুক। তরুণরা শুধু আন্দোলন করবে আর অন্যরা সুযোগ নেবে, তা হতে পারে না। তরুণরাই নেতৃত্ব দিয়ে দেশ সামনে এগিয়ে নেবে।’ জাতীয়তাবাদী প্রগতিশীল জোটের চেয়ারম্যান ফিরোজ মোহাম্মদ বলেন, তাঁর দল ৩০০ আসনে ভোট করার লক্ষ্য নিয়েই সংগঠিত হচ্ছে। তিনি বলেন, ২১ দফা নিয়ে নানান কর্মসূচি করে চলেছেন। আশা করছেন আগামী জানুযারিতে সম্মেলনের পর ৩০০ আসনের প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করতে পারবেন।