শুক্রবার, ২০ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

গর্ভকালীন এবং প্রসব পরবর্তী মানসিক স্বাস্থ্য

ডা. নওশিন শারমিন পূরবী, গাইনোকলজিস্ট, পূরবী’স হেল্প ডেস্ক, ঢাকা

গর্ভকালীন এবং প্রসব পরবর্তী মানসিক স্বাস্থ্য

সতর্কতা

গর্ভকালীন মানসিক পরিবর্তন :  একটি মেয়ের জীবনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ‘গর্ভধারণ’। তবে সবার কাছে বিষয়টি সমান নয়। গর্ভধারণ বিষয়টি কেমন মানসিক প্রভাব ফেলবে তা কয়েকটি বিষয়ের ওপর নির্ভরশীল। ১। বয়স ২। পরিকল্পনা ৩। স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যকার সম্পর্ক। ৪। পারিবারিক অবস্থান।

১। বয়স : খুব অল্প বয়সে মা হলে একটা মেয়ের মানসিক অবস্থার ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়ে। ঠিক তেমনি যদি দীর্ঘদিন চেষ্টার পর কেউ অধিক বয়সে গর্ভধারণ করেন তাতেও সেই মায়ের মাঝে নিরাপত্তাহীনতা, হঠাৎ অনাগত সন্তানকে হারানোর ভয় বেশি থাকে।

২। পরিকল্পনা : আদর্শগত ভাবে প্রতিটি গর্ভধারণ পরিকল্পিত হওয়া উচিত। অপরিকল্পিত গর্ভধারণে বহমান নদীর গতিপথ পরিবর্তন করে দেয়। যার প্রভাব পড়ে মানসিক স্বাস্থ্যর ওপর।

৩। স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যবর্তী সম্পর্কও মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর যথেষ্ট প্রভাব ফেলে। অনেক সময় দেখা যায় একজন মেয়ে তার স্বামীর সঙ্গে মানসিক বোঝাপড়া গড়ে ওঠার আগেই গর্ভধারণ করে ফেলে, যা গর্ভকালীন একটি মেয়েকে আরও বেশি একাকিত্বের মধ্যে ঠেলে দেয়।

৪। একটি অনাগত শিশু শুধু একজন মায়ের জীবনের জন্য নয়, একটি পরিবারের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ সময়। তাই পারিবারিক পূর্ণ সমর্থন অত্যন্ত জরুরি।

গর্ভকালীন সময়কে তিন ভাগে ভাগ করা যায়।

প্রথম ট্রাইমেস্টার [প্রথম ১২ সপ্তাহ ] : এই সময় মায়ের মাঝে মিশ্র এক ধরনের অনুভ‚তি হয়। একদিকে ‘মা’ হওয়ার খুশি, অন্যদিকে অনাগত সন্তানের দায়িত্ব ও তার জীবন ধারার পরিবর্তন মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়।

দ্বিতীয় ট্রাইমেস্টার (১২-২৪ সপ্তাহ) : নতুন প্রাণের স্পন্দনের অনুভ‚তি জীবনে নতুন মাত্রা যোগ করে। এ সময় প্রতিটি মা তার গর্ভকালীন শারীরিক পরিবর্তনের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেয়।

২৪ সপ্তাহের পরবর্তী কীভাবে কোথায় কখন প্রসব হবে সেই চিন্তায় অনেক সময় হতাশা, খিটখিটে মেজাজ, দুশ্চিন্তাগ্রস্থ হতে দেখা যায়। তাই গর্ভধারণের পূর্বে অবশ্যই মানসিকভাবে প্রস্তুত হতে হবে।

গর্ভধারণের পূর্ববর্তী মানসিক প্রস্তুতি :

পরিকল্পনা অত্যন্ত জরুরি। দুইটি সন্তানের মাঝে বয়সের পার্থক্য থাকা, স্বামী স্ত্রীর মধ্যে বোঝাপড়া সমস্ত কিছুই মানসিক প্রস্তুতির অন্তর্গত। অর্থনৈতিক, সামাজিক, ক্যারিয়ার সবকিছুর সঙ্গে তাল মিলিয়ে গর্ভধারণের সিদ্ধন্তে আসা উচিত। তবে এ ধারণা করা ঠিক নয় চাইলেই গর্ভধারণ করা যায়। গর্ভধারণ কখনোই স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার অন্যান্য সমস্যার সমাধান হতে পারে না।

 

 

প্রসব-পরবর্তী মানসিক সমস্যার কারণ :

৩০-৪০% মায়ের ক্ষেত্রে ‘Maternty Blue’ হয়ে থাকে যা সাময়িক এবং শুধুমাত্র পূর্ণ মানসিক নিশ্চয়তা এবং যথাযথ কাউন্সিলিংয়ের মাধ্যমে তা আপনা-আপনি ঠিক হয়ে যেতে পারে। এর কারণ প্রসব-পরবর্তী হরমোনাল পরিবর্তন। ‘প্রসব-পরবর্তী মানসিক বিষণ্নতা’ অথবা ‘প্রসব-পরবর্তী মানসিক উন্মাদনা’ সাধারণত প্রসবের ৩ থেকে ৬ মাসের মধ্যে হতে দেখা যায়। লক্ষণগুলো হলো- সাধারণত কান্নাকাটি করা, মানসিকভাবে অবসাদগ্রস্ত থাকা, বেশি খাওয়া-দাওয়া করা, খুব সহজেই রেগে যাওয়া, অনেকে মনে করেন রাতে না ঘুমানোর কারণে এমন হচ্ছে। বিষয়টি আরও মারাÍক আকার ধারণ করে কখনো কখনো উন্মাদ রূপ নেয়, যেমন- গায়েবি আওয়াজ শুনতে পাওয়া, চোখে অন্ধকার দেখা, সন্তানের ক্ষতি করা। বিষয়টি অবহেলা না করে চিকিৎসা ও কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা করা জরুরি।

পারিবারিক ভূমিকা : জীবনের এই ক্রান্তিকালে পরিবারের পাশে থাকা একান্ত জরুরি। কোনো প্রকার মানসিক চাপে না রেখে মেয়েটিকে সম্পূর্ণ মানসিক সহায়তা করা, তার সন্তানকে লালন-পালনে সহায়তা করা এবং সব সময় তাকে এই নতুন উপহার দেওয়ার জন্য অভিনন্দন জানাতে হবে। সন্তান ছেলে হোক কিংবা মেয়ে হোক মাতৃত্ব আশীর্বাদ এবং যে কোনো ধরনের মানসিক সমস্যা সম্পূর্ণ নিরাময় যোগ্য ও বিশ্বাসে এগিয়ে যেতে হবে।

সন্তান প্রসবের পর মা ও শিশুর শরীর দুর্বল ও ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় থাকে। এ সময় সঠিক যত্ন নিলে এবং কিছু নিয়ম মেনে চললে এসব জটিলতা এড়ানো সম্ভব। প্রসবের পর সঠিক যত্ন নিলে মায়ের শরীর যেমন তাড়াতাড়ি সুস্থ হয় তেমনি শিশু সুস্থ থাকে ও সবল হয়ে ওঠে।

প্রসব-পরবর্তী সেবা : প্রসবের পর পরই মায়ের এবং নবজাত শিশুর যত্ন নেওয়া এবং প্রসবের পর ৬ সপ্তাহ (৪২ দিন) পর্যন্ত মা ও শিশুর অবস্থা ফলোআপ করাকে প্রসব-পরবর্তী সেবা বলা হয়।

মায়ের ক্ষেত্রে : গর্ভধারণে শরীরের যে ক্ষয় হয় তা পূরণের জন্য প্রসবের পর মাকে বেশি করে খাবার খেতে হবে। শিশুর প্রয়োজনে বুকের দুধ তৈরির জন্য এ সময় মায়ের সুষম খাবার খাওয়া প্রয়োজন। মাকে পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিতে হবে। মাকে নিয়মিত গোসল ও পরিষ্কার কাপড় পরাতে হবে। এ সময় ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী প্রসূতি মাকে ভিটামিন ‘এ’ ক্যাপসুল ও আয়রন বড়ি খেতে হবে। প্রসবের পর দম্পত্তিকে পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি গ্রহণ করতে হবে। পরিবারের সব সদস্যকে প্রসব-পরবর্তী মায়ের সেবা সম্পর্কে অবহিত করতে হবে।

শিশুর ক্ষেত্রে : প্রসবের পর মাটিতে না রেখে শিশুকে হাতে তুলে নিতে হবে। নবজাতকের মুখের ভিতর, মুখমণ্ডল ও সমস্ত শরীর পরিষ্কার কাপড় দিয়ে জড়িয়ে নিতে হবে। জন্মের পরপরই গর্ভফুল পড়ার অপেক্ষা না করে শিশুকে শালদুধসহ মায়ের দুধ খাওয়ানো শুরু করতে হবে। জন্মের সঙ্গে সঙ্গে শিশু স্তন চোষা শুরু করলে মায়ের দুধ ঠিকমতো আসবে। এ ছাড়া প্রসবের সঙ্গে সঙ্গে নবজাতককে মায়ের দুধ খাওয়ালে মায়ের ফুল পড়তে এবং রক্তস্রাব দ্রুত বন্ধ হতে সাহায্য করবে। নবজাতককে সরিষার তেল, মধু বা চিনির সরবত জাতীয় অন্য কোনো পানীয় খেতে দেওয়া উচিত নয়। নাড়ি কাটার জন্য প্রথমে নবজাতকের পেট থেকে যথাক্রমে দুই আঙ্গুল, আধ আঙ্গুল ও এক আঙ্গুল ব্যবধানে জীবাণুমুক্ত সুতা দিয়ে পরপর তিনটি বাঁধন দিতে হবে। এরপর পরিষ্কার জীবাণুমুক্ত ব্লেড দিয়ে দ্বিতীয় ও তৃতীয় বাঁধনের মাঝ বরাবর কেটে দিতে হবে। শিশুর জন্মের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে তার ওজন নিতে হবে। জন্মের পর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শিশুকে বিসিজি এবং ইপিআইয়ের ৮টি রোগের টিকা দিতে হবে।

সর্বশেষ খবর