৯ এপ্রিল ২০১৬, শনিবার ইডব্লিউএমজিএল কনফারেন্স রুমে বাংলাদেশ প্রতিদিন ও পিউর ইট যৌথভাবে আয়োজন করে ‘নিরাপদ পানি : সমস্যা ও করণীয়’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠক। নাজনীন মুন্নীর সঞ্চালনায় বৈঠকে অংশ নেন সাবেক সচিব, পানি বিশেষজ্ঞ, চিকিৎসক, বিজ্ঞানী, আইনজীবী, প্রকৌশলী, সাংবাদিকসহ গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ। বৈঠকের চুম্বকাংশ তুলে ধরেছেন— গোলাম রাব্বানী ও তানভীর আহমেদ ছবি তুলেছেন জয়ীতা রায়
ভূগর্ভস্থ পানির অধিক ব্যবহারে ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়া দেখা দিচ্ছে
—ড. খন্দকার আজহারুল হক
পানি নিয়ে সাতটিরও বেশি দেশে কাজ করার সুযোগ হয়েছে। পঞ্চাশটির বেশি দেশে পানিবিষয়ক বিভিন্ন সেমিনারেও অংশগ্রহণ করেছি। বর্তমানে আমাদের দেশে সুপেয় পানির স্বল্পতায় সেই কথাটিই মনে পড়ছে— সমুদ্রে চারদিকে পানি কিন্তু পানযোগ্য পানি নেই। আমরা এখনই বুঝতে পারছি, পানি নেই। আমরা বারবার টেকসই উন্নয়নের কথা বলি। মানুষের জন্য নিরাপদ পানি নিশ্চিত করা টেকসই উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য। ওয়াসা গ্রাউন্ড লেভেল থেকে পানি তুলে ব্যবহার করছে। অথচ ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, ২০০ বছর আগে ঢাকায় ‘সারফেস ওয়াটার’ ব্যবহারে গুরুত্ব দিয়ে কাজ শুরু হয়েছিল। গত শতকের ষাটের দশকে এসে হঠাৎ করেই ‘গ্রাউন্ড ওয়াটার’ ব্যবহার শুরু হলো। এ যেন আমাদের নেশাগ্রস্ত করেছে। এখনো মাটির নিচের পানিই ব্যবহার করছি আমরা। ভূগর্ভস্থ পানির অধিক ব্যবহারে এরই মধ্যে তার ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়া দেখা দিচ্ছে। যেমন— পানিতে আর্সেনিক ছড়িয়ে পড়ছে। এই আর্সেনিক কিন্তু হাজার বছর ধরে আমাদের মাটিতে ছিল। হুট করে কেন পানিতে ছড়াল তা বিজ্ঞানীরা খতিয়ে দেখছেন। আর্সেনিক যেন পানিতে না মিশে সেজন্য বিজ্ঞানীরা উন্নত প্রযুক্তির খোঁজ করছেন। চিকিৎসা বিজ্ঞানীরাও কার্যকরী ওষুধ তৈরির চেষ্টা চালাচ্ছেন। কৃষিতে যথেচ্ছ ব্যবহৃত সারের ব্যাপারেও সচেতনতা বাড়ানো প্রয়োজন।
ছয় মাসের মধ্যে সমাধান সম্ভব
—মোহাম্মদ মুসা
বাংলাদেশের মানুষের জন্য নিরাপদ পানি নিশ্চিত করা ছয় মাসের মধ্যে সম্ভব। জনগণের কল্যাণের কথা চিন্তা করে সরকারকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এ বিষয়ে উদ্যোগ নিতে হবে। সারা বিশ্বে বাংলাদেশের সুনাম আছে। জাতিসংঘও এর স্বীকৃতি দিয়েছে। ২০০০ সালে ওয়ার্ল্ড ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট কনফারেন্সে বাংলাদেশকে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে আদর্শ দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। নিরাপদ পানি নিশ্চিত করার জন্য জাতিসংঘের কাছে প্রস্তাব দিলে তারাও সহযোগিতা দেবেন। তবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে উদ্যোগ নেওয়ার অনুরোধ জানাই। পার্শ্ববর্তী দেশে পুকুর ভরাট করার সুযোগ নেই। কিন্তু আমাদের মন্ত্রীপাড়ার পুকুর ভরাট করে ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। বর্তমান সরকার খাস পুকুর উদ্ধারের চেষ্টা করছে। এসব পুকুর সুপেয় পানি সরবরাহের জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে। এ জন্য সারা দেশে ডিসি-এসপিদের নির্দেশনা দিলেই এসব উদ্ধার হয়ে যাবে। তারা স্থানীয় চেয়ারম্যানের সহায়তা নিতে পারেন। ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহারের চেয়ে প্রাকৃতিক পানি বিশেষ করে বৃষ্টির পানি ধারণ করা যেতে পারে। বৃষ্টির পানি সবচেয়ে নিরাপদ। পানির অপচয় রোধে আমাদের সচেতন হতে হবে। এ ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন জনসচেতনতা। মানুষের মধ্যে জনসচেতনতা বাড়লে পানির পরিমিত ব্যবহার নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। ওয়াসার কর্মীদের আরও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে।
কৃষিতে জৈব কীটনাশকের ব্যবহার বাড়ছে
—শ্যামল কান্তি ঘোষ
যেখানে জীবন, সেখানেই পানি। যেখানে পানির ব্যবস্থা হয়েছে সেখানেই মানুষ এসেছে। কৃষি উৎপাদনের ক্ষেত্রেও পানির ভূমিকা অনেক বেশি। আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষের কৃষির সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ আছে। কৃষিতে পানির প্রয়োজন অপরিসীম। রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহারের ফলে কৃষি উৎপাদন বাড়ছে। কীটনাশক ব্যবহার কতটা নিরাপদ? অধিক মাত্রায় রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহারের ফলে কিছুটা ক্ষতি হচ্ছে। তবে বিগত বছরগুলোয় রাসায়নিক সারের ব্যবহার কমিয়ে আনা হয়েছে। কীটনাশক আমদানি কমিয়ে বর্তমানে জৈব কীটনাশক ব্যবহার বাড়ানো হচ্ছে। তাছাড়া মাটির উপরিভাগে পানি আমরা ঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারছি না। নদী-খাল খনন করে এখন নাব্যতা বৃদ্ধি করা হচ্ছে। রাবার ড্যাম নির্মাণ করে পানি ধরে রাখা হচ্ছে। কৃষি ক্ষেত্রে এটি কার্যকরী ভূমিকা রাখছে। কৃষক তার সর্বোচ্চ সামর্থ্য প্রয়োগ করে ফসল উৎপাদন করছে। পানির অপচয় যেন না হয় সেজন্য এখন উন্মুক্ত ড্রেন না করে মাটির নিচ দিয়ে, পাইপ দিয়ে নানা আধুনিক উপায়ে পানি সেচ দেওয়া হচ্ছে। এখন পাতকুয়া কেটে, রাবার ড্যাম নির্মাণ করে পানি স্বল্পতা মেটানো হচ্ছে। এমনকি যারা পাহাড়ে বসবাস করেন, তাদের আবাদের জন্য পানির ব্যবস্থা করা হচ্ছে। তবে পানি ব্যবহারে সাধারণ মানুষের সচেতনতা বাড়াতে হবে। যারা আইন করেন তাদের এ বিষয়ে বাড়তি গুরুত্ব দিতে হবে।
নিরাপদ পানি সরবরাহে সম্মিলিত উদ্যোগ দরকার
—নঈম নিজাম
পানির সঙ্গে মানুষের প্রাত্যহিক জীবন সম্পৃক্ত। আমরা শহরে কিংবা গ্রামে, যেখানেই বসবাস করি না কেন, আমাদের সব কিছুর সঙ্গে পানির সম্পর্ক রয়েছে। আমরা ছোটবেলায় পড়ে এসেছি ‘পানির অপর নাম জীবন’। কিন্তু এখন সেই জীবনের কতটা তারতম্য ঘটছে। কতটুকু নিরাপদ পানি আমরা পান করছি! গ্রাম-শহর, পৌরসভা, সিটি করপোরেশনে যে পানি সরবরাহ করা হচ্ছে তা-ই বা কতটুকু নিরাপদ? এমনকি আমরা অফিসে বসে মিনারেল ওয়াটার হিসেবে যা পান করছি, সেই পানির জারেও শ্যাওলা পাওয়া যাচ্ছে। এটা নিয়ে ভাবা জরুরি হয়ে পড়েছে। তাই নিরাপদ পানি পান ও ব্যবহারে দেশের মানুষকে সচেতন করা একটা বড় বিষয়। মানুষকে যদি আমরা সচেতন না করতে পারি, মানুষের পক্ষে সম্ভব নয় সব কিছু নিজে নিজে অবহিত হওয়া। নিরাপদ পানি নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে। যত দিন যাবে ততই নিরাপদ পানির সমস্যা বাড়বে। আর এই সমস্যা সমাধানযোগ্য। আমরা যার যার অবস্থান থেকে সম্মিলিত উদ্যোগ গ্রহণ করলেই এ সমস্যা সমাধান হবে। ঢাকা ওয়াসা, চট্টগ্রাম ওয়াসা, রাজশাহী ওয়াসা কিংবা খুলনা ওয়াসা যে পানি সরবরাহ করছে তা যথাযথ ব্যবহার হচ্ছে কিনা সেদিকে সার্বক্ষণিক মনিটরিং করা প্রয়োজন। ওয়াসার পানির অপচয়, চোরাই লাইন সরকারকে ক্ষতির সম্মুখীন করছে। এ জন্য পানির পরিমিত ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। আমরা সব মানুষের জন্য নিরাপদ পানি চাই।
সবচেয়ে বড় সমস্যা সমন্বয়হীনতা
—মো. শহীদুল হাসান
সবার জন্য নিরাপদ পানি নিশ্চিত করতে ইতিমধ্যে অনেক কাজ হয়েছে। প্রতিনিয়ত বর্ধিত আকারে সে কাজ হচ্ছে। ইউনিয়ন পর্যায়ে কমিটির মাধ্যমে নাগরিক সেবা প্রদানে গুরুত্বের কথা বলা হচ্ছে। গ্রাম পর্যায়ে যে অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয় তার যথার্থ ব্যবহার করতে হবে। ঠিকভাবে বাজেট কাজে লাগালে উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে। সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকাগুলোতে পানির কিছু সমস্যা রয়েছে। কিছু জায়গায় পানি নেই, কিছু জায়গায় পানি দূষণ সমস্যা রয়েছে। সেখানে গভীর নলকূপ বসিয়ে নিরাপদ পানির ব্যবস্থা করা হচ্ছে। কিছু পুকুর হাইজেনিক অবস্থায় রাখার চেষ্টা করা হলেও তা পুরোপুরি সম্ভব হচ্ছে না। এখন নতুন যত স্কুল হচ্ছে সেখানে নিরাপদ খাবার পানি ও স্যানিটেশন নিশ্চিত করা হচ্ছে। এগুলো মনিটরিংয়ের আওতায় আনতে হবে। ভূগর্ভস্থ পানির অধিক ব্যবহার না করে বিকল্প সন্ধান করতে হবে। কিছু জায়গায় সোলার ব্যবহার করে ডিপটিউবওয়েল চালানো হচ্ছে। এগুলো বেশির ভাগই ফসলি জমিতে সেচ কাজে লাগছে। তবে এ সমস্যা নিরসনে সবচেয়ে বড় বাধা আমাদের সমন্বয়হীনতা। একটি কমিশন গঠন হতে পারে। এই কমিশন দেখভাল করবে, জনশুনানি নেবে ও সচেতনতা বাড়াতে কাজ করবে।
খাস পুকুরের তালিকা তৈরি হচ্ছে
—এ কে এম ইব্রাহিম
প্রথম বাংলাদেশে যখন আর্সেনিক ধরা পড়ে তা থেকে আমরা অনেক উত্তরণ ঘটিয়েছি। এ জন্য সরকার ব্যাপক কাজ করছে। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর জনসচেতনতা সৃষ্টি করাসহ নানা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। আমরা যে সোর্স থেকে পানি সংগ্রহ করি, তখন সেটা ভালোই থাকে। পরবর্তী পর্যায়ে তা সরবরাহ করতে গিয়ে সমস্যার সৃষ্টি হয়। শহরাঞ্চলে আমরা যে পাইপ দিয়ে ২/৪ ঘণ্টা পানি সাপ্লাই দিই, তাতে পানি নিরাপদ রাখা কষ্টকর। এ ছাড়া নিরাপদ পানি পান ও ব্যবহারের জন্য গ্রাম অঞ্চলে সচেতনতা বাড়াতে হবে। আমরা ওয়াটার সেফটি প্ল্যান্ট গ্রামাঞ্চলে বাস্তবায়নের চেষ্টা করছি। যাতে মানুষ যে পানি ব্যবহার করছে তা যেন নিরাপদ থাকে। এতে কিছু টেকনিক্যাল, ননটেকনিক্যাল ব্যাপার আছে, তা নিয়ে আমরা কাজ করছি। স্যানিটেশনের জন্য আমাদের নিউ টেকনোলজি ব্যবহার করা দরকার। সরকার গ্রামে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের জন্য বিভিন্ন খাস পুকুরের তালিকা তৈরি করছে। এসব পুকুরে পানি সংরক্ষণ করা হবে। নিরাপদ পানি সরবরাহের জন্য সরকার নানা উদ্যোগ নিয়েছে এবং তা বাস্তবায়নাধীন। পৌরসভাগুলোতে নিরাপদ পানি সরবরাহের জন্য বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা দরকার।
দূষিত পানির কারণে মৃত্যু হতে পারে
—ডা. এ কে এম মোস্তফা
দূষিত পানি ব্যবহারের ফলে ডায়রিয়া থেকে শুরু করে ক্যান্সার পর্যন্ত হতে পারে। সম্প্রতি ডায়াবেটিস ও কিডনি রোগী বৃদ্ধির পেছনেও দূষিত পানি দায়ী। অনেকে বলতে পারেন ডায়াবেটিসের সঙ্গে পানির কী সম্পর্ক? দূষিত পানিতে এমন কিছু কেমিক্যাল আছে, যা মানুষের প্যানক্রিয়াসের কার্যক্ষমতা কমিয়ে দেয়। ফলে ইনসুলিনের স্বাভাবিক নিঃসরণ বন্ধ হয়ে মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়। দীর্ঘদিন দূষিত পানি ব্যবহারের কারণে শরীরে টক্সিন (বিষাক্ত পদার্থ) জমা হয়, যা বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের কার্যক্ষমতা কমিয়ে দেয়। ইদানীং কিডনি ডিজিস এবং ক্রনিক লিভার ডিজিস বেড়ে গেছে। চক্ষুরোগী বাড়ছে। ওরাল ক্যান্সার বাড়ছে। প্রত্যেকটি রোগের সঙ্গে দূষিত পানির যোগসূত্র রয়েছে। দূষিত পানির কারণে কেমিক্যাল পয়জনিং হয়ে সাবেক এক রাষ্ট্রপতি মারা গেছেন। এ ছাড়া দূষিত পানি ব্যবহারের কারণে হেপাটাইটিস, টাইফয়েড, আমাশয়, গ্যাস্ট্রিক আলসার, ত্বকের নানা রোগ এমনকি ক্যান্সার পর্যন্ত হতে পারে। এমনকি আমরা মুখ দিয়ে যখন পানি পান করি, তখন এই দূষিত পানির কারণে মুখেও ক্যান্সার হতে পারে। তাই বিশুদ্ধ পানি পান করার জন্য সবাইকে সচেতন হতে হবে।
নিরাপদ পানি সরবরাহ বড় চ্যালেঞ্জ
—মো. আবদুল হাকিম
দূষিত পানি মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি ডেকে আনছে। অনেকেই ফুটিয়ে বা ক্লোরিনেট করে পানি পান করছেন। তবে এটা সবার পক্ষে সম্ভব নয়। বিশেষ করে বস্তি ও উপকূলীয় এলাকাগুলোতে। বস্তি থেকে শুরু করে হাওর, পাহাড়ি এলাকায় বিশুদ্ধ পানি নিশ্চিত করা বড় একটা চ্যালেঞ্জ। এ জন্য আধুনিক টেকনোলজি দরকার। ৪০ লাখ বস্তিবাসীকে বর্তমানে পানি সরবরাহ করা হচ্ছে। তারা ২০০৭ সাল পর্যন্ত সুপেয় পানির আওতার বাইরে ছিল। কারণ তখন ওয়াসার পানি পেতে হোল্ডিং নম্বর লাগত। বস্তিতে এখন দেড় হাজার পানি সংযোগ দেওয়া হয়েছে। তারা বিলও দিচ্ছে নিয়মিত। ২০১৬ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে সব বস্তি পানি নেটওয়ার্কের মধ্যে চলে আসবে। পরীক্ষায় ওয়াসার পানিতে নানা সমস্যা পাওয়া গেছে। কারণ ওয়াসার পাইপ লাইনে লিকেজ আছে। পুরো পাইপ লাইন পরিবর্তন করতে পারলে নিরাপদ পানি নিশ্চিত হতো। অবশ্য যে রিজার্ভারে পানি সংরক্ষণ করা হচ্ছে তাও নিয়মিত পরিষ্কার করা জরুরি। ওয়াসার পানি ও বাজার থেকে কেনা বোতলজাত পানির দামের পার্থক্য দূর করতে হবে। পানির দামের পার্থক্য বিশেষ রেগুলেটরির মধ্যে এনে দূর করা দরকার।
দূষিত পানির কারণে অটিস্টিক শিশুর জন্ম
—ড. মনিরুল আলম
পানি হচ্ছে জীবনের অংশ। প্রতিদিনই আমরা পানি ব্যবহার করি, পান করি। পানি পাকস্থলিতে যায়। শরীরের সঙ্গে মিলে যায়। ঢাকা সিটিতে আগে প্রয়োজনের তুলনায় পানি কম ছিল। এখন অনেক বেশি। তবে পানির মান রক্ষা করতে পারছি না। এ জন্য সরকারকে দায়ী করছি না। সরকার প্রাণপণ চেষ্টা করছে। পানি সাপ্লাই লাইনে সমস্যা হচ্ছে। অনেক সময় স্যুয়ারেজ লাইনও লিক হয়ে যাচ্ছে। গবেষণায় দেখা গেছে, বাচ্চাদের যখন ঘন ঘন ডায়রিয়া হয়, তখন তাদের গ্রথ কমে যায়। মানুষের উচ্চতা কমে যাচ্ছে। বাচ্চাদের ব্রেণও তেমন কাজ করে না। শুধু ডায়রিয়া নয়, পানির কারণে অনেক ধরনের রোগ হতে পারে। দূষিত পানির কারণে অটিস্টিক শিশুর জন্ম হচ্ছে। এ ছাড়া দূষিত পানির কারণে নানা ধরনের রোগব্যাধিও হচ্ছে। আমরা যেভাবে পানি উত্তোলন করছি এ জন্য পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। এ কারণে বড় ধরনের ভূমিকম্প হতে পারে। এ ছাড়া আগামী কয়েক বছরের মধ্যে ঢাকার পানি লবণাক্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আমরা ৪৫০ নদীর পানি ব্যবহার করতে পারি। নদীতে ড্রাম দিয়ে সেই পানি ঢাকায় সরবরাহ করা যেতে পারে। বিশ্বের অনেক দেশে নদীর পানি বিশুদ্ধ করে ব্যবহার হচ্ছে।
স্কুলগুলোতে নিরাপদ পানি নিশ্চিত করতে হবে
—পার্থ হেফাজ সেখ
সবার জন্য সুপেয় পানির সরবরাহ করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। সরকার ও বেসরকারি বিভিন্ন এনজিও সবার জন্য নিরাপদ পানি নিশ্চিত করতে একসঙ্গে কাজ করে আসছে। এটি বড় একটি কাজ। এখানে কিছু সমস্যা রয়ে গেছে। আমাদের পানি আইন-২০১৩ রয়েছে। সেখানে এটা স্পষ্ট, সরকার সুপেয় পানির ব্যবস্থা করবে। এখন স্থানীয় পর্যায়ে ইউনিয়নেও স্ট্যান্ডিং কমিটির মাধ্যমে নাগরিক সেবা প্রদানের সুযোগ তৈরি হয়েছে। সেখানেও পানি প্রদানের সেবা যোগ রয়েছে। জনগণ কিন্তু পানির সমস্যা নিয়ে সে পর্যায়ে গিয়েই তার সমস্যার কথা জানাবে। তাই স্থানীয় সরকারকে যথেষ্ট শক্তিশালী করা গুরুত্বপূর্ণ। পানির সমস্যা নগরে ও গ্রামে সবখানেই রয়েছে। তবে আমাদের পরিকল্পনা ও বাজেট অনেকটা ‘আরবান ফোকাস’ হয়ে যায়। এখন হাওর ও সমুদ্র উপকূলবর্তী অঞ্চলে পানি সমস্যা নিরসনে নজর দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া একটি বড় বিষয় স্কুলগুলোতে নিরাপদ পানি নিশ্চিত করা। আমাদের শিক্ষার্থী শিশুরা দিনের একটি বড় সময় স্কুলে থাকে। ২০০৬ সালের পর আর্সেনিকমুক্ত টিউবওয়েল চিহ্নিতকরণের কাজ এখন কতটা গতিশীল সেদিকে গুরুত্ব দেওয়া দরকার। তবে সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, সবার মধ্যে নিরাপদ পানি ব্যবহারে সচেতনতা তৈরি করা।
নদী আছে প্রবাহ নেই
—ওমর ফারুক
আমাদের নদী আছে। কিন্তু নদীতে পানির প্রবাহ নেই। প্রতিদিনই বিভিন্ন কারণে নদীর পানি দূষিত হচ্ছে। ঢাকার আশপাশে যেসব নদী আছে তার পানি এতটাই দূষিত যে, নদীতে মাছ ছাড়লেও তা সঙ্গে সঙ্গে মরে যাচ্ছে। ঢাকার পাশের নদীগুলোতে প্রবাহ থাকলে পানি দূষিত থাকত না। এর আগে ঢাকার একজন মেয়র বুড়িগঙ্গা নদীতে মাছ ছাড়ার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কিন্তু এক পাশে মাছ ছেড়ে অন্য পাশে যেতে যেতেই দেখা গেছে অনেক মাছের পোনা মরে গেছে। অন্যদিকে গ্রামগঞ্জের পুকুরের পানিও দূষিত হচ্ছে। অনেক কারণে পুকুরের পানি দূষিত হচ্ছে। দেখা গেছে, পুকুর থেকে যেসব মাছ ধরা হচ্ছে তাতেও ঘা রয়েছে। এর কারণ মূলত দূষিত পানি। ঢাকায় বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের জন্য উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে পদ্মা-মেঘনা নদীর পানি বিশুদ্ধ করে ঢাকায় সরবরাহ করা হবে। বিভিন্ন বড় নদীর সঙ্গে যদি ঢাকার পাশের নদীগুলোর সংযোগ করা যেত তবে এসব নদীতে পানির ফ্লো সৃষ্টি হতো এবং পানিও দূষণমুক্ত করা সম্ভব হতো। এ ছাড়া বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের জন্য জনগণের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টির পাশাপাশি সরকারকেও সচেতন হতে হবে। নিরাপদ পানি ও খাবার নিশ্চিত করতে সরকার, জেলা ও স্থানীয় প্রশাসনকে আরও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে।
মনিটরিং সেল গঠন করা যেতে পারে
—ব্যারিস্টার আহসান হাবিব
নিরাপদ পানির নিশ্চিতকরণ একটি জনস্বার্থ সম্পর্কিত বিষয়। হাইকোর্ট প্রায়ই জনস্বার্থ রক্ষায় রুল জারি করে থাকেন। বর্তমানে নিরাপদ পানির স্বল্পতার কথা বলা হচ্ছে। পানির সর্বোচ্চ সুষ্ঠু ব্যবহারে জনসচেতনতা জরুরি। নিরাপদ পানির সুষ্ঠু ব্যবহারে সুনির্দিষ্ট আইন নেই। এখন পানি বোতলজাত করে বাজারে বিক্রি করা হয়। পানি বোতলজাতকারক কিছু অসাধু প্রতিষ্ঠান মেয়াদোত্তীর্ণ তারিখ ছাড়াই পানি বাজারজাত করছে। এটি জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি। এখানে আইনের প্রয়োগ করতে হবে। পানি আইন দিয়ে নিরাপদ পানি নিশ্চিত করা সম্ভব। বাজার মনিটরিং করতে একটি মনিটরিং সেল গঠন করা দরকার। প্রচলিত আইনে মহাপরিচালক বা যথাযোগ্য দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার অনুমতি ছাড়া মামলা করা যায় না। এটি নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে, যদি সর্ষেই ভূত থাকে তবে তাড়ানো হবে কীভাবে? ইউনাইটেড ন্যাশন পানি নিয়ে তিনটি দিক গুরুত্ব দিচ্ছে। পর্যাপ্ততা, নিরাপদ ও সহজলভ্যতা। পানি সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে এই দিকগুলোতে নজর রাখতে হবে। তা ছাড়া মানুষের সচেতনতা একটি বড় বিষয়। সরকারের যেমন দায়িত্ব রয়েছে তেমনি সাধারণ জনগণেরও নিরাপদ পানি ব্যবহারে সচেতন হতে হবে। প্রচলিত আইনের সুষ্ঠু ব্যবহারের পাশাপাশি আলাদা সেল থাকলে নিরাপদ পানি সবার কাছে পৌঁছাবে।
বাজারে ৯০ শতাংশ পানি দূষিত
—মো. সারওয়ার আলম
সম্প্রতি ঢাকা শহরে অ-অনুমোদিত জারে পানি বিক্রি করছে এমন ১৮টি প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিয়েছি। বাসাবাড়িতে যেসব বোতল বা জারজাত পানি সরবরাহ করা হচ্ছে তার ৯০ শতাংশই দূষিত। আমি গত এক বছরে ২৪টি পানি বাজারজাতকরণ প্রতিষ্ঠানে গিয়ে মাত্র ছয়টির মোটামুটি মান পেয়েছি। এরা ওয়াসার পানি সরাসরি জারে ভরে বিক্রি করছে। পাশাপাশি ওইসব জার ফুডগ্রেডের না। জারে করে বিক্রি হওয়া ওই পানিগুলোতে মাইক্রোব্যাকটেরিয়া আছে। মানুষ এই পানিগুলো কিনে প্রতারিত হচ্ছে। চানখাঁরপুলে বাড়ির ছাদের ওপরও বহু নকল ফ্যাক্টরি গজিয়ে উঠেছে। ওইসব পানি পান করার চেয়ে ওয়াসার পানি সরাসরি ফুটিয়ে পান করা ভালো। এ ছাড়া কীটনাশক ব্যবহারের কারণে জাতির সর্বনাশ হয়ে যাচ্ছে। এটা আমাদের গুরুত্বের সঙ্গে ভাবা উচিত। প্রতিটি ক্ষেত্রে ভেজাল। বিস্কুট, বনরুটিতে বেকিং পাউডারের বদলে ব্যবহার করা হচ্ছে অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট। এ রাসায়নিক কিডনি বিকল করে দিচ্ছে। বাজারের ৭০-৮০ শতাংশ লুব্রিকেন্ট ভেজাল। এ ব্যাপারে সমন্বিত পদক্ষেপ দরকার। এর সঙ্গে অনেক স্টেকহোল্ডার জড়িত। এদের শক্তিশালী সিন্ডিকেট রয়েছে। সবাইকে নিয়ে সমন্বিত পরিকল্পনা করে সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নিতে হবে। মনে রাখতে হবে, নিরাপদ পানি নিরাপদ জীবন।
দুর্যোগ-পরবর্তী নিরাপদ পানির সংকট ভয়াবহ
—আলিম বারী
আমাদের ১৬ কোটি জনসংখ্যা। এখানে যে পরিমাণ পানির উৎস রয়েছে সেটি যথেষ্ট নয়। আমাদের সুপেয় পানির দুষ্প্রাপ্যতা রয়েছে। দেশে ৩৭ শতাংশ মানুষ নিরাপদ পানি পাচ্ছে। বাকি শতকরা ৬০ ভাগ মানুষ অনিরাপদ পানি ব্যবহার করছে। আমরা মূলত ভূগর্ভস্থ ও মাটির উপরিতলের পানি ব্যবহার করি। শহরে উপরিতলের পানি ব্যবহারে সমস্যা রয়েছে। এ সমস্যা তীব্র আকার নিচ্ছে। এ ছাড়া দুর্যোগপ্রবণ এলাকা যেমন দক্ষিণাঞ্চলে চার-পাঁচ বছর পরপরই বন্যা হয়। সেখানে বন্যাকালীন ও বন্যা-পরবর্তীতে নিরাপদ পানির দুষ্প্রাপ্যতা দেখা দেয়। পানির অভাবে দুর্যোগ-পরবর্তী সময়ে রোগ ছড়িয়ে পড়ে। গর্ভবতী মায়েরা লবণাক্ত পানি ব্যবহারে দুরারোগ্য ক্যান্সারে আক্রান্ত হন। হাজার হাজার মানুষ চার থেকে পাঁচ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে সুপেয় পানির খোঁজে হেঁটে যান। পাহাড়ি এলাকাতেও নিরাপদ পানির সংকট রয়েছে। দক্ষিণাঞ্চলে পানির সমস্যা সমাধানে সরকার কিছু পুকুর সংরক্ষণের কথা বললেও স্থানীয় মোড়লরা সেগুলো দখল করে গলদা চিংড়ির চাষ করছেন। শিল্প-কারখানাগুলো বর্জ্য সরাসরি পাইপ দিয়ে নদীতে ফেলছে। পাঠিয়ে দিচ্ছে আন্ডারগ্রাউন্ডে। এ ভয়াবহ রূপ নিয়ন্ত্রণে জনসচেতনতা বাড়াতে হবে।
যারা অংশ নিলেন
ড. খন্দকার আজহারুল হক
সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ঢাকা ওয়াসা
মোহাম্মদ মুসা
সাবেক সচিব ও মহাপরিচালক, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ব্যুরো
শ্যামল কান্তি ঘোষ
সাবেক সচিব, কৃষি মন্ত্রণালয়
মো. শহীদুল হাসান
সাবেক প্রধান প্রকৌশলী, এলজিইডি
নঈম নিজাম
সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন
এ কে এম ইব্রাহিম
প্রকল্প পরিচালক, বিশ্বব্যাংক প্রকল্প, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর
অধ্যাপক ডা. এ কে এম মোস্তফা
সাবেক পরিচালক, জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল
ড. মনিরুল আলম
জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী, আইসিডিডিআর,বি
মো. আবদুল হাকিম
সিনিয়র প্রোজেক্ট কো-অর্ডিনেটর, ডিএসকে
পার্থ হেফাজ সেখ
হেড অব কান্ট্রি কো-অর্ডিনেশন, প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশ
আলিম বারী
কো-অর্ডিনেটর, অ্যাডভোকেসি অ্যান্ড কমিউনিকেশন, সাইটসেভার্স
ওমর ফারুক
মহাসচিব, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন
মো. সারওয়ার আলম
নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও আইন কর্মকর্তা, র্যাব
ব্যারিস্টার আহসান হাবীব
আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট
সঞ্চালক : নাজনীন মুন্নী, প্রধান প্রতিবেদক, নিউজটোয়েন্টিফোর