বুধবার, ২৬ ডিসেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

নির্বাচনকালীন মানবাধিকার সংরক্ষণ

নির্বাচনকালীন মানবাধিকার সংরক্ষণ

নির্বাচনে নারী, শিশু, প্রতিবন্ধী এবং সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তা ও তাদের মানবাধিকার বিষয়ে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন তাদের কার্যালয়ে ২৪ ডিসেম্বর এক গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে। সভায় স্বাগত বক্তব্য দেন ও সভাপতিত্ব করেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক। বিভিন্ন পেশার সম্মানিত ব্যক্তিরা ওই আলোচনায় অংশ নেন। তার চুম্বক অংশ তুলে ধরেছেন- আকতারুজ্জামান, মাহবুব মমতাজী ও জয়শ্রী ভাদুড়ী ছবি : জয়ীতা রায়

 

অবাধ স্বচ্ছ সুষ্ঠু গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে আমরা ৩০ লাখ শহীদের রক্তের ঋণ শোধ করতে পারি

কাজী রিয়াজুল হক

চেয়ারম্যান, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন

এবারের জাতীয় নির্বাচন অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। জাতি-ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ নির্বিশেষে সব ভোটার যেন নির্ভয়ে কেন্দ্রে গিয়ে পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিয়ে নির্বিঘ্নে বাড়ি ফিরতে পারেন তা নিশ্চিত করতে হবে। পূর্ববর্তী নির্বাচনগুলোয় আমরা সংখ্যালঘুদের ওপর যে সহিংসতা দেখেছি তা আর দেখতে চাই না। সংখ্যালঘু নির্যাতনের এলাকাগুলো চিহ্নিত করে তারা যেন ভোটাধিকার সুষ্ঠুভাবে প্রয়োগ করতে পারে সে ব্যবস্থা নির্বাচন কমিশনকে নিতে হবে। দেশের অনেক স্থানে নারী ও সংখ্যালঘু, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষ ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে বাধাগ্রস্ত হয়। এদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে হবে।

আমরা চাই এ নির্বাচন যেন অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক হয়। সঠিক, স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য হয়।

প্রায় এক-তৃতীয়াংশ লোক যুবক। তাদের ভোট তাৎপর্যপূর্ণ। ৩০ লাখ শহীদ যে উদ্দেশ্যে দেশ স্বাধীন করেছিলেন সেই চেতনা ধারণ করে যুবসমাজকে নির্বাচনে অংশ নিতে হবে।

বর্তমানে যেভাবে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে তাতে আমরা বহির্বিশ্বে গিয়ে মাথা উঁচু করে কথা বলতে পারি। এ মর্যাদা ধরে রাখতে পারব কিনা তা এ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে নির্ধারণ হবে। সবাইকে সজাগ থাকতে হবে যাতে কোনো অপশক্তি এ নির্বাচন বানচাল করতে না পারে। সংশ্লিষ্ট সবাইকেই দায়িত্বশীল বক্তব্য প্রদান করতে হবে। এজন্য  আমাদের এখনই করণীয় নির্ধারণ করতে হবে। আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বাংলাদেশ দেখতে চাই। আমরা আশা করি, প্রতিটি মানুষ আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে নির্বাচনী আচরণবিধি মেনে চলবে।

 

স্বাধীনতাবিরোধীরা সহিংসতা ছড়ায়

বিচারপতি মোহাম্মদ মমতাজ উদ্দিন আহমেদ

চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল

স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি দেশজুড়ে হামলা ও সহিংসতার ঘটনা ঘটায়। তাদের বিচার মনঃপূত না হলে বলা হয় বিচার হচ্ছে না। দেখে নেওয়ার হুমকি তো তারা হামেশাই দেয়। চিনে রাখব - এটা কোনো সভ্য মানুষের ভাষা হতে পারে না। ক্ষমতা হাতে পেলেই তারা মানবাধিকারকে ভূলুণ্ঠিত করে। ২০০১ সালে আমরা ১৬ জন বিচারপতি এই স্বাধীনতাবিরোধী পক্ষের রোষানলের শিকার হয়েছিলাম। তারা কোনো বিচার মানে না। তা ছাড়া কীভাবে জেলের তালা ভাঙার কথা বলতে পারে! ২০০১ সালে ক্ষমতায় এসে দেশজুড়ে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল। সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর ওপর নেমে এসেছিল অত্যাচারের খড়্গ। এটা কোন দেশের মানবাধিকার? তাই রাজাকার, আলবদরদের আর ভোট দেওয়া যাবে না। স্বাধীনতার চেতনা নষ্ট করতে তারা পরিকল্পিতভাবে মাঠে নেমেছে। ২০১৪ সালে জলজ্যান্ত মানুষকে পেট্রলবোমা মেরে পুড়িয়ে মেরেছে। নির্বাচনকেন্দ্রিক সহিংসতা রুখতে নির্বাচন কমিশনকে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নিতে হবে।

 

নির্বাচন কমিশনকে দায়িত্ব নিয়ে পরিকল্পনা করতে হবে

বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম

সাবেক চেয়ারম্যান, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল

নির্বাচন কমিশনকে দায়িত্ব নিয়ে চিন্তা করতে হবে। ২০০১ সালে যা ঘটেছে তা যেন আর না হয়। ২০১৪ সালের পরিস্থিতি তো সবার জানা। কী কারণে এভাবে মানুষ পুড়িয়ে মারা হলো তার কোনো ব্যাখ্যা নেই। দেশের মানুষ হলেই যেন তাকে গুলি করে পুড়িয়ে মারতে হবে। সুযোগ পেলেই সংখ্যালঘুদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়। আমার বিশ্বাস, এবার হয়তো এই সন্ত্রাসীরা এ রকম কিছু করতে পারবে না। তার পরও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। নারী, শিশু-কিশোর, সংখ্যালঘু থেকে শুরু করে দেশের একজন নাগরিকও যেন নির্বাচনের সময় সহিংসতার শিকার না হয় তা নিশ্চিত করতে হবে। দেশের প্রতিটি মানুষ সমান অধিকার ভোগ করবে। বিচার সবার জন্য সমান। আমরা সবাই বাঙালি হিসেবে বাঁচব। মানবাধিকার রক্ষার জন্য যেসব নীতিমালা রয়েছে তা আমাদের মেনে চলতে হবে। কমিশন এর আগে যে উদ্যোগ নিয়েছে তা চলমান রাখতে হবে।

 

এই নির্বাচনে জামায়াতের নেতারা ছদ্মবেশে প্রার্থী হয়েছেন

বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক

উপদেষ্টা, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি

এবারের নির্বাচনে আমি বিস্মিত হয়েছি। কারণ নির্বাচন কমিশন জামায়াতের ২২ জন প্রার্থীকে যোগ্য ঘোষণা করেছে। এ-সংক্রান্ত সুপ্রিম কোর্টের একটা আদেশ ছিল তবু তারা তা মানেনি। সুপ্রিম কোর্টের আদেশ মানে আইন।

অর্থাৎ তারা আইন মানেনি। নির্বাচন কমিশন মাথা থেকে পা পর্যন্ত সম্পূর্ণ বেআইনি কথা বলেছে। এই নির্বাচনে জামায়াতের নেতারা ছদ্মবেশে প্রার্থী হয়েছেন।

এ বিষয়ে একটি রিট হাই কোর্টে পেন্ডিং আছে, হয়তো একসময় তার শুনানি হবে। এমনকি যারা যুদ্ধাপরাধী তাদের সন্তানরাও নির্বাচন করছে। আমি ভাবতে পারি না, সাকার ছেলে, নিজামীর ছেলে, সাঈদীর ছেলে পার্লামেন্টে যাবে। অথচ ড. কামাল নির্লজ্জের মতো তাদের সঙ্গে আঁতাত করেছেন। ’৭১ সালেও তার ভূমিকা ছিল রহস্যজনক।

 

সম্প্রীতির খবরগুলোও প্রচার করা দরকার

মো. নজরুল ইসলাম

সার্বক্ষণিক সদস্য, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন

নির্বাচন সামনে রেখে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করতে দেশের বিভিন্ন জেলা আমরা পরিদর্শন করেছি। যশোরে জেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসনের ঐক্যবদ্ধতা দেখেছি। তারা স্থায়ী একটা ব্যবস্থা নিচ্ছে এটা প্রতিরোধে। একতরফা সংবাদের পাশাপাশি ভালো, সম্প্রীতির খবরও প্রচার করা দরকার।

সিলেটে ’৯০ সালে এক প্রার্থীর ওপর নির্যাতন হয়েছিল বলে স্থানীয়রা একজোট হয়ে সরকারদলীয় ও বিরোধীদলীয় সবাইকে পরাস্ত করে এক স্বতন্ত্র প্রার্থীকে বিজয়ী করেছিলেন। এটা একটা বড় উদাহরণ হতে পারে। নির্যাতনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে জনগণের ঐক্যবদ্ধ অবস্থানও দরকার।

সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার ব্যাপারে রাজনৈতিক নেতাদের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি নেওয়া যেতে পারে। এ ছাড়া ইলেকশন কমিশনের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা বলা দরকার।

 

নির্বাচন এলেই উৎকণ্ঠা

ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ চেয়ারম্যান, পিকেএসএফ

নির্বাচন এলেই আমাদের মাঝে এক ধরনের উৎকণ্ঠা দেখা দেয়। ঘাত-উৎঘাত শুরু হয়। কিন্তু স্বাধীনতার এত বছর পর এমনটি হওয়ার কথা ছিল না। যদি ১৯৯১ সাল থেকে গণতন্ত্রচর্চার ২৮ বছরের হিসাব দেখি তাহলে আজকের পরিবেশ-পরিস্থিতি অন্যরকম হওয়ার কথা ছিল। এ পরিবেশ ভালো না হওয়ার কারণ হলো, আমরা যুদ্ধাপরাধী কিংবা স্বাধীনতাবিরোধীদের নির্মূল করতে পারিনি। আমরা দেখেছি, ২০০১ সালের নির্বাচনে যারা জিতেছিল তারা সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন চালায়। ২০১৪ সালে দেখেছি আগুনসন্ত্রাস। তখন রাস্তায় বের হওয়া যেত না। তখন অর্থনীতি-সমাজ দুটোই পিছিয়ে পড়েছিল। সময় এসেছে, এখন আমাদের সবাইকে সচেতন হতে হবে। আমরা সঠিক ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন চাই। কিন্তু নির্বাচনে যেন কেউ স্বাধীনতাবিরোধীদের ভোট না দেয়। ড. কামাল হোসেন বলেছেন, কাণ্ডারি প্রস্তুত। তাহলে এই কাণ্ডারি কে? এই কাণ্ডারি বলতে আমরা যাকে চিনি তিনি তো হত্যা বা ক্যু করতে সর্বক্ষণ প্রস্তুত।

 

সংখ্যালঘুদের ওপর যেন কোনো সহিংসতা না হয়

আয়েশা খানম সভাপতি, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ

সংখ্যালঘুদের ওপর নির্বাচনের সময় যেন কোনো সহিংসতা না হয়। তারা যেন নিরাপদে ভোট দিতে পারে। গণতন্ত্র শুধু নির্বাচনের দিনের জন্য নয়। এর আগে ও পরের প্রক্রিয়াও এর অংশ। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব ছাড়াও রাজনৈতিক দল, জনগণের দায়িত্বশীল ভূমিকা দরকার। নির্বাচন কমিশনের একার পক্ষে তা সম্ভব নয়। নির্বাচন তখনই কার্যকর হবে যখন গণতন্ত্রের সৌন্দর্য ভিন্নমত নির্বাচনে অংশ নেবে। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ অনেকটা সময় পার করলেও স্বাধীনতার মধ্যে অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে এ পর্যায়ে এসেছে। যারা ভোটার তারা যাতে দল-মত-গোত্র, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে নিরাপত্তার সঙ্গে নিরাপদে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেন সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। উগ্র সাম্প্রদায়িক, ধর্মীয় লেবাসধারীদের কেউ যেন নির্বাচনী প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত না হয় তা নিশ্চিত করা দরকার। নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় ধর্মের ব্যবহার নিষিদ্ধ করা আমাদের দাবি ছিল, তা পুরোপুরি হয়েছে।

 

সংখ্যালঘু ও নারীরা সহিংসতার শিকার বেশি হয়

অধ্যাপক  ড. সাদেকা  হালিম ডিন, সমাজবিজ্ঞান অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

আমাদের দেশে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী, দলিত, হরিজনসহ বেশকিছু সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীর মানুষ বসবাস করে। কিন্তু হামলা, সহিংসতায় তারা দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে। হামলা করে বাড়িঘর ছিনিয়ে নিয়ে তাদের নিঃস্ব করে ফেলা হচ্ছে। ১৯৫১ সালে এ অঞ্চলের হিন্দু জনগোষ্ঠীর বসবাস ছিল মূল জনসংখ্যার ২৩ শতাংশ। বর্তমানে এ হার নেমে এসেছে ৮ শতাংশে। শুধু নির্বাচনের সময় নয়, সারা বছরই সংখ্যালঘু নির্যাতন চলে। তবে নির্বাচনকে আরও বেশি উপযুক্ত সময় হিসেবে দুষ্কৃতিকারীরা বেছে নেয়। শুধু যে বিরোধী দল করছে তা নয়, সরকারি দলের মদদপুষ্ট হয়েও অনেক সময় সহিংসতার ঘটনা ঘটছে। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবাধিকারের সাংঘাতিক বিপর্যয় আমরা লক্ষ্য করেছি। এর আগে জাতীয় নির্বাচনের ক্ষেত্রেও মানবাধিকার বিনষ্ট হয়েছে। এজন্য জাতীয় মানবাধিকার কমিশন দেশের মানুষের মানবাধিকার রক্ষার জন্য বিরামহীন কাজ করছে। তাদের কর্মতৎপরতা অব্যাহত রাখতে হবে।

 

নির্বাচনকে সংখ্যালঘু নির্যাতনের মৌসুম হিসেবে বেছে নেওয়া হয়

কাজল দেবনাথ সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ

মানবাধিকার রক্ষা নির্বাচনের অন্যতম শর্ত। বছরের ৩৬৫ দিনই নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যেই সোনাগাজীতে ৫টি, ঠাকুরগাঁওয়ে ১০টি ঘর পোড়ানো হয়েছে। জমি, বাড়ি দখলের জন্য মোক্ষম সময় হিসেবে বেছে নেওয়া হয় নির্বাচনকে। এতে বড় ইস্যুর নিচে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বাড়ি দখলের ঘটনা চাপা পড়ে যায়। তখন এ হামলার ঘটনাকে নির্বাচনকালীন সহিংসতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ঝুঁকিপূর্ণ এবং অতিঝুঁকিপূর্ণ চিহ্নিত এলাকাগুলোয় বাড়তি নিরাপত্তা নিতে হবে। আরও আগে থেকে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হতো। দেশকে স্বাধীন করতে যুদ্ধে যোগ দিয়েছিলাম। অথচ এখন সংখ্যালঘু হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়। জমি-বাড়ি দখল সরকারি দলের মদদপুষ্ট ব্যক্তিরা কম করেনি। সবাই আঘাত করার জন্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে বেছে নেয়। তাদের আঘাত করলে, জমি দখল করলে কেউ কিছুই বলবে না- এ রকম এক ধরনের মাইন্ডসেট তৈরি হয়ে গেছে। এর পরিবর্তন আগে করতে হবে।

 

কে দেবে সংখ্যালঘুদের ঘরবাড়ি পাহারা?

শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী শহীদজায়া

নির্বাচনের তো অল্প কয়েকদিন বাকি। নির্বাচনের আগের রাতে আক্রমণ হতে পারে সংখ্যালঘুদের ওপর। পরের রাতে হামলা হতে পারে। হামলার শিকারদের আইনি ও চিকিৎসাসেবা দিতে কমিটি করা হয়েছে।

কিন্তু সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা, আক্রমণ ঠেকাতে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে? এ আক্রমণ হলে কারা ঠেকাবে? কাদের দায়িত্ব এটি? নির্বাচনকালীন কোনো সংখ্যালঘুর ওপর যেন হামলা না হয়। হামলা হলে তার ক্ষত কীভাবে পূরণ করবে, সে দায়িত্ব কার? কে দেবে সংখ্যালঘুদের ঘরবাড়ি পাহারা? হামলার পর সংখ্যালঘুদের শারীরিক ও আইনি সহায়তা দিলেও মানসিক ক্ষতটা তো তাদের থেকেই যাবে।

 

বিএনপির নির্বাচন করার কোনো উদ্দেশ্য ছিল না

শ্যামল দত্ত সম্পাদক, ভোরের কাগজ

আমরা লক্ষ্য করেছি সেনাবাহিনী নামার পর নানা ধরনের প্রতিক্রিয়া। তার আগে বলতে চাই- যে মানুষগুলো ২০১৪ এবং ২০০১ সালের ভিকটিম তাদের কথা আমরা ভুলে গেছি। আমার প্রশ্ন- মানবাধিকার কার জন্য? আগুনসন্ত্রাসী কিংবা যুদ্ধাপরাধীর জন্য নির্বাচনে যে পরিবেশ থাকবে, অন্য সাধারণ প্রার্থীর জন্যও কি একই পরিবেশ-পরিস্থিতি থাকবে? আমি তো মনে করি উল্টো আওয়ামী লীগের জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নেই। ঢাকায় বিএনপির কোনো প্রার্থী নামছেন না। তারা না নেমে বলছেন নামতে দেওয়া হচ্ছে না। আসলে বিএনপির নির্বাচন করার কোনো উদ্দেশ্য ছিল না। এখনো তাদের সে উদ্দেশ্য নেই। তাদের উদ্দেশ্য নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করা।

 

আমরা সর্বক্ষণ শঙ্কায় থাকি

অজয় দাশগুপ্ত জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক

আমরা যারা সংখ্যালঘু তারা সর্বক্ষণ শঙ্কার মধ্যে থাকি। আমরা দেশকে স্বাধীন করেছি। এ স্বাধীনতা দেশের ভিতরে কেউ, আবার বিদেশের অনেকে পছন্দ করছে না।

২০০১ সালে নির্বাচনের আগে যেভাবে সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছিল, তারপর কিন্তু অনেক কম নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। নির্বাচনের আগে সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন চালানোর মাধ্যমে এক ধরনের আতঙ্ক সৃষ্টি করা হয়। যাতে তারা কেন্দ্রে না যায় এবং ভোট না দেয়। সেই নির্বাচনের আগে যা ঘটেছিল তা ছিল চরম উসকানি। এখনো তা আছে। ২০০১ ও ২০১৪ সালের তাড়না বা শঙ্কা এখনো আমাদের মাঝে আছে।

 

পুলিশের বিশেষ টাস্কফোর্স গঠন করা দরকার

জায়েদুল আহসান পিন্টু সম্পাদক, ডিবিসি নিউজ

নির্বাচন সামনে রেখে সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন, হামলা হবে। নির্বাচনের পরে আওয়ামী লীগ জিতলেও হামলা হবে। জামায়াত জিতলে তো কথাই নেই। শুধু ভোট কেন্দ্র পাহারা নয়, মনিটরিং কমিটি গঠন করে সংখ্যালঘুদের পাহারা দিতে হবে। পুলিশের বিশেষ টাস্কফোর্স গঠন করে দেওয়া দরকার যাতে সংখ্যালঘুরা মানসিক শক্তি পায়। ২০১৪ সালের নির্বাচনের পরদিন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলেও ৫ হাজার সংখ্যালঘু পরিবার নির্যাতিত হয়েছিল। আমরা অনেকে অসাম্প্রদায়িকতার কথা বলি। আসলে আমরা অসাম্প্রদায়িক কিনা তা ভাবতে হবে। সংখ্যালঘুদের ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন হচ্ছে।

 

ইসিকে সংখ্যালঘুর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে

আশালতা বৈদ্য মুক্তিযুদ্ধের নারী কমান্ডার

স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় পাকিস্তানিরা বলেছিল মুসলিম নাকি অমুসলিম? অমুসলিম হলে তাদের শেষ করে দাও। আমরা তখন যেভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছি, জাতির জনকের কন্যার শাসনামলেও একই ধারায় আজও আমাদের ওপর আক্রমণ চলছে। নির্যাতিত হচ্ছি। প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) সব শক্তির ধারক-বাহক বলে মনে করি। তার অনুমতিতে সেনাবাহিনী ও পুলিশবাহিনী পরিচালিত হচ্ছে। সংখ্যালঘু পরিবারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ক্ষমতা তিনি রাখেন। সংখ্যালঘুদের কয়েকটি গ্রামের নিরাপত্তাও তিনি দিতে পারবেন। সংখ্যাধিক্য হয়ে নারীরাও সংখ্যালঘুর তালিকায়। এই নারীদের নিরাপত্তাও নিশ্চিত করতে হবে।

 

সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে

সঞ্জীব দ্রং সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম

ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুরা কেমন আছেন তার ওপর নির্ভর করছে সে দেশের গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। রাষ্ট্রকে তার দায়িত্ব পালন করতে হবে। সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে সে কীভাবে দেখছে তা দেখতে হবে।  রাষ্ট্রকে লজ্জিত হতে হবে, বিনয়ী হতে হবে, উদ্ধত আচরণ কাম্য নয়। ১৯৭১ সালে যখন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী দেশের মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তখন দেশমাতৃকাকে মুক্ত করে এই ওরাও, সাঁওতালরা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। রংপুরের ওরাও, সাঁওতালরা তীর-ধনুক নিয়ে রংপুর ক্যান্টনমেন্টে আক্রমণ করেছিল। অথচ দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তাদেরই দেশ ছেড়ে চলে যেতে হয়েছিল। এ পর্যন্ত যেসব হামলা হয়েছে তার বিচার হয়নি।

 

শিশুদের যেন নির্বাচনী কাজে ব্যবহার করা না হয়

শবনম আজিম শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

এ আলোচনায় সংখ্যালঘুদের বিষয়টি বার বার উঠে এসেছে। বলা হচ্ছে, শিশুদের যেন নির্বাচনী কার্যক্রমে ব্যবহার করা না হয়। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, কিশোররা প্রতিনিয়ত নির্বাচনী প্রচারণায় যুক্ত আছে। তারা যদি ভ্রান্তপথে হাঁটে তাহলে এর দায় কে নেবে? সংখ্যায় অনেক তবু সংখ্যালঘু হলো নারীরা। নির্বাচনে তারা কতটা নিরাপদ? কয়েকটি গণমাধ্যম আরোপিত সত্য প্রকাশ করছে। তারা এমনভাবে রিপোর্ট প্রকাশ করছে যে, মনে হচ্ছে যুদ্ধ লেগে গেছে কিংবা লাগবে। নির্বাচন কমিশন থেকে সাংবাদিকদের একটা নীতিমালা দেওয়া হয়েছে। এতে আমার যথেষ্ট আপত্তি আছে। নির্বাচনী কেন্দ্রে কোনো ভুল কিংবা মিথ্যার সঠিকটা তারা কেন প্রকাশ করতে পারবে না?

 

রাস্তাঘাটে সহিংসতা শুরু হয়েছে

ব্যারিস্টার নাদিয়া চৌধুরী আইনজীবী

একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আইনবিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার নাদিয়া চৌধুরী বলেছেন, আমরা আসন্ন নির্বাচনে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোয় ক্যাম্প করার কথা বলেছি। এ ক্যাম্পের ব্যবস্থা করলে উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতি তৎক্ষণাৎ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে অবগত করা যাবে। তবে এরই মধ্যে রাস্তাঘাটে সহিংসতা শুরু হয়েছে। আমরা লক্ষ্য করছি, এগুলো দলীয় সহিংসতা; কিন্তু ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচনে হতাশ হলে হবে না, দাঁতভাঙা জবাবের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। মানবাধিকার কমিশন মানবাধিকার রক্ষার জন্য বেশকিছু সুপারিশ করেছিল, সেগুলোর বাস্তবায়ন জরুরি। বিষয়টি ভাবার জন্য জোর দাবি জানাচ্ছি।

 

নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার অপচেষ্টা চলমান রয়েছে

কবীর চৌধুরী তন্ময়

সভাপতি, বাংলাদেশ অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট ফোরাম

নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উসকানিমূলক তথ্য ছড়ানো হচ্ছে। নোংরা থাবা কাজ করছে। এদের প্রতিহত করতে সামাজিক সচেতনতার বিকল্প নেই। বিভিন্ন রকমের সামাজিক যোগাযোগ-মাধ্যমের পেজ থেকে দাঙ্গা-হাঙ্গামা লাগতে পারে এ রকম উসকানিমূলক বার্তা ছড়ানো হচ্ছে। নির্বাচন কমিশন আন্তরিক হলে এগুলো মোকাবিলা করা সম্ভব। অপপ্রচার চালানো পেজগুলোয় রিপোর্ট করা হচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশে ফেসবুকের অ্যাডমিন প্যানেল না থাকায় সেগুলো বন্ধ হতে সময় লাগবে। বিভিন্ন ধরনের ভিডিও ভাইরাল করে উসকানির চেষ্টা করছে দুর্বৃত্তরা। এগুলো রুখতে তরুণদের এগিয়ে আসতে হবে।

 

সহিংসতা এড়াতে তৎপর হতে হবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে

অয়ন শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

২০১৪ সালে নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন সহিংসতা ঘটতে দেখা গেছে। মা ও বোনকে নিয়ে আমি চিকিৎসা নিয়ে বাসায় ফেরার পথে মিরপুরে কাজীপাড়ায় সিএনজিতে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল। পেট্রলবোমায় দগ্ধ হয়ে প্রায় দুই মাস হাসপাতালে থাকতে হয়েছে। এ সময় সাধারণ মানুষ দীর্ঘদিন ঘর থেকে বের হতে পারেনি। তারা জিম্মি হয়ে পড়েছিল। ঝুঁকি নিয়ে তাদের কর্মস্থলে যেতে হয়েছে। চাইব ভবিষ্যতে নির্বাচনে যাতে এমন সহিংসতা না হয়। নির্বাচনের আগে ও পরে কীভাবে এ সহিংসতা এড়ানো যায় সে ব্যাপারে সরকারসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে তৎপর হতে হবে। তরুণ ভোটারদের হাতে মানবিকতা আর উন্নয়নের চাবি।

 


 

সর্বশেষ খবর