বুধবার, ১৪ জুন, ২০২৩ ০০:০০ টা
জাতীয় পুষ্টি সপ্তাহ ২০২৩

পুষ্টি চাহিদা পূরণে প্রবীণরাও হবেন জনসম্পদ

পুষ্টি চাহিদা পূরণে প্রবীণরাও হবেন জনসম্পদ

জ্ঞান ও অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ প্রবীণরা পরিবারের ও সমাজের জন্য আশীর্বাদ। নবীনদের দিকনির্দেশনা দিয়ে সমাজ গঠনে বড় অবদান রাখেন তাঁরা। অথচ এই জনগোষ্ঠী আজ ভয়াবহ অপুষ্টির শিকার। আক্রান্ত হচ্ছেন নানা রোগব্যাধিতে। পর্যাপ্ত পুষ্টি নিশ্চিত করতে পারলে প্রবীণ এই জনগোষ্ঠীকে ভালো রাখার পাশাপাশি সম্পদে পরিণত করা সম্ভব। গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিন আয়োজিত প্রবীণ পুষ্টিবিষয়ক এক গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা এসব কথা বলেন। রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার ইডব্লিউএমজিএল কনফারেন্স হলে এ আয়োজনে সহযোগিতা করে জনস্বাস্থ্য পুষ্টি প্রতিষ্ঠান। আলোচনার চুম্বকাংশ তুলে ধরেছেন শামীম আহমেদ, জয়শ্রী ভাদুড়ী, হাসান ইমনরাশেদ হোসাইন। ছবি : জয়ীতা রায়

 

প্রবীণদের সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে

ডা. বি এম আবদুল্লাহ

ইমেরিটাস অধ্যাপক

বয়স বাড়লে শারীরিক, সামাজিক, মানসিক, অর্থনৈতিক- অনেক ধরনের সমস্যার শিকার হতে হয়। শারীরিক রোগের পাশাপাশি মানসিক বিষণ্নতা জেঁকে ধরে। নিজেকে অপ্রয়োজনীয় মনে করেন। এমনটা হলে তার রোগ আরও বেড়ে যায়। মন ভালো না থাকলে খাবারেও রুচি থাকে না। এতে পুষ্টির ঘাটতি তৈরি হয়। তাই প্রবীণদের সর্বোচ্চ গুরুত্ব ও সম্মান দিতে হবে। বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে দাওয়াত দিতে হবে। বাসে, হাসপাতালে সর্বত্র অগ্রাধিকার দিতে হবে। তাহলেই তাদের পরিপূর্ণ সেবা নিশ্চিত হবে। এটা তাদের চিকিৎসারও একটি অংশ।

এখানে এখন যে প্রবীণনিবাস তৈরি হচ্ছে, এগুলো ৩০-৪০ বছর আগে কেউ ভাবতও না। এটা পশ্চিমা সংস্কৃতি। কর্মব্যস্ততার কারণে সেখানে সন্তানরা বাবা-মাকে প্রবীণ নিবাসে রেখে আসত। বর্তমানে এখানেও এমনটা হচ্ছে। মানুষ ব্যস্ত হয়ে পড়ছে। আবার গড় আয়ু বৃদ্ধির কারণে প্রবীণের সংখ্যাও বাড়ছে। তাই সংকট আরও বাড়বে। আজ প্রবীণদের জন্য কিছু করে যেতে পারলে ভবিষ্যতে সেই সুফলটা আমিও পাব। এটা সরকার, সমাজ, পরিবার- সবার দায়িত্ব। তবে পরিবার থেকেই এর শুরু হওয়া দরকার। যে বাবা-মা জীবনের সবটুকু উজাড় করে সন্তানদের মানুষ করে, শেষ বয়সে সেই সন্তানরা তাদের দেখভাল করে না, এর চেয়ে কষ্টের কিছু নেই। অনেকের দেখার সামর্থ্য থাকে না। অনেকে আবার বৃদ্ধ বাবা-মাকে বোঝা মনে করেন। অনেক ক্ষেত্রে ছেলের বউ শ্বশুর-শাশুড়ির সঙ্গে থাকতে পছন্দ করেন না। তবে কর্মফল সবাইকে ভোগ করতে হয়। বার্নার্ড শ’র একটা গল্প আছে, ছেলে তার পিতাকে মারতে মারতে বাড়ির গেটের বাইরে নিয়ে আসে, তখন বাবা তার ছেলেকে বলেন, ‘বাবারে, আমি আমার বাবাকে মারতে মারতে ঘরের দরজার বাইরে এনেছিলাম, তুমি আমাকে গেটের বাইরে নিয়ে এসেছো! ’ অর্থাৎ আজ আমি যা করব, কাল আমাকেও সেই ফল ভোগ করতে হবে। তাই শুধু আইন দিয়ে হবে না, দায়িত্ববোধের শিক্ষাটা পরিবার থেকেই আসতে হবে। একটা শিশু যা দেখে বড় হবে, পরবর্তীতে সে সেটারই প্রতিফলন ঘটাবে। বয়স বাড়লে স্বাভাবিকভাবেই কিছু রোগ-ব্যাধি হবে। ডায়াবেটিস, কিডনি রোগ, হার্টের রোগ, লিভারের রোগ, চোখের সমস্যা ইত্যাদি বাড়বে। তাই তার যত্নও বেশি লাগবে। তার মন খারাপ থাকলে, পুষ্টিহীনতা দেখা দিলে রোগ আরও বাড়বে। বিষয়গুলো পরিবারের সদস্যদের মাথায় রাখতে হবে।

 

দোরগোড়ায় পুষ্টিসেবা পৌঁছাতে কাজ হচ্ছে

অধ্যাপক ডা. শাহ গোলাম নবী

পরিচালক, জনস্বাস্থ্য পুষ্টি প্রতিষ্ঠান

পরিবারের অন্য সদস্যদের কথা ভেবে প্রবীণরা সব সময় কম খান। তাঁরা ভাবেন, আমার তো বয়স হয়ে গেছে, পরিবারের সদস্যসংখ্যা বেড়েছে, আমি খেলে নাতি-নাতনি, ছেলে-মেয়েরা কি কম খাবে? এগুলো ভাবতে গিয়ে তাঁরা পুষ্টির চাহিদা মেটাতে পারছেন না। কম খাচ্ছেন। ফলে অপুষ্টিতে ভুগছেন। দিন দিন রোগ-শোক চেপে ধরছে। পরিবারের ও সমাজের বোঝা হচ্ছেন। এ জন্য আমাদের দায়িত্ব রয়েছে। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর পাশাপাশি যে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো পুষ্টি নিয়ে কাজ করে, তাদেরও দায়িত্ব রয়েছে। সরকারিভাবে এটা নিয়ে আমরা কাজ করছি।

খুশির খবর হচ্ছে- প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্রেইনচাইল্ড হিসেবে পরিচিত আমাদের কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার জন্য একটা চমৎকার উদ্যোগ হিসেবে গ্রহণ করেছে। এই ক্লিনিকের মাধ্যমে মানুষের দোরগোড়ায় সেবা পৌঁছানো সম্ভব। যদি কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোকে পুষ্টিসেবার প্রাণকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলি, ক্লিনিকগুলোর সার্ভিস প্রোভাইডারদের যদি এ ব্যাপারে প্রশিক্ষিত করি, তাহলে সার্ভিসটি প্রবীণদের দোরগোড়ায় সহজে পৌঁছে দিতে পারব। এটা নিয়ে কাজ হচ্ছে। এ ছাড়া বাংলাদেশে শহরাঞ্চলে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা একেবারে উপেক্ষিত। এবার আমাদের পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় শহুরে স্বাস্থ্যসেবার সঙ্গে পুষ্টিসেবা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হচ্ছে। শহুরে জনগণের জন্য, বিশেষ করে প্রবীণদের জন্য প্রতিটি অপারেশনাল প্ল্যানে পুষ্টিসেবাকে যুক্ত করা হয়েছে। এ জন্য আমরা সার্ভে করব। কৌশলগত পরিকল্পনা করা হবে। শহরে ও গ্রামে সবাই যাতে প্রয়োজনীয় পুষ্টি পেতে পারে, সেই ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে কাজ করে যাচ্ছি।

আমরা এখন একটা ট্রানজিশনে আছি। সংক্রামক ও অসংক্রামক রোগের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি রোগগুলো বাড়ছে। গড় আয়ু বাড়ায় প্রবীণের সংখ্যা বাড়ছে। ফলে প্রবীণদের নিয়ে ভাবতে আমরা বাধ্য। পুষ্টি উন্নয়নের একটা রূপরেখা আমাদের আছে। জনস্বাস্থ্য পুষ্টি প্রতিষ্ঠান সরকারের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কাজ করে যাচ্ছে।

 

খাদ্য পিরামিড মানতে হবে

অধ্যাপক ডা. মো. এখলাসুর রহমান

অধ্যক্ষ, আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতাল

শিশু-বৃদ্ধ সবাইকে ব্যালান্স ডায়েট (ভারসাম্যপূর্ণ খাবার) খেতে হবে। সব ধরনের খাবার খাওয়ার সুযোগ না থাকলে ফুড পিরামিড মেইনটেইন করতে হবে। পিরামিডের নিচে আট গ্লাস পানি, ওপরে ভাত-রুটি, তার ওপরে ডান দিকে ফল, বাম দিকে সবজি, এর ওপরে ডান দিকে প্রোটিন, বাম দিকে দুগ্ধজাত পণ্য ও সবার ওপরে ফ্যাট বা তেল। প্রত্যেকটা ধরন থেকে একটা করে খাবার খেলেও হয়। অনেকে ডায়েট করতে গিয়ে কার্বোহাইড্রেট একেবারেই খায় না। অথচ ৩০ শতাংশ কার্বোহাইড্রেট খেতেই হবে, না হলে প্রোটিন ব্রেকডাউন হয়ে যাবে। প্রোটিন খুব গুরুত্বপূর্ণ। অনেকে মনে করে মাছ, মাংস, ডিম, দুধেই শুধু প্রোটিন। অথচ ডালে প্রোটিনের পাশাপাশি আছে লাইসিন, যা অন্য কোনো খাবারে নেই। ছোট মাছে যে গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টি উপাদান আছে, বড় মাছে তা নেই। ফ্যাট বা চর্বিও খেতে হবে ২৫-৩০ শতাংশ। এটা একেবারে বাদ দিয়ে দিলে ব্যালান্স ডায়েট হবে না।

২০১২-১৩ সালে এই দেশে প্রথম নিউটিশন পলিসি আমরাই করেছি। এটা করতে গিয়ে অনেক বাধার সম্মুখীন হই। ওয়ার্ল্ড ফুডের এক কর্মকর্তা বাধা দিয়ে বলেছিলেন, ফুড পলিসি আছে, নিউট্রিশন পলিসি দরকার নেই। পরে তাঁকে বোঝাতে সক্ষম হই যে, ফুড, নিউট্রিশন ও ডায়েট এক জিনিস নয়। পলিসিতে পাঁচটি উদ্দেশ্য নির্ধারণ করা হয়। সেখানে কয়েকটা লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়। প্রথম লক্ষ্য জন্মের পর থেকে ১ হাজার দিন পুষ্টি নিশ্চিত করা। দুই নম্বরে কিশোরীদের পুষ্টি নিশ্চিত করা। তিন নম্বরে গর্ভবতী নারীর পুষ্টি নিশ্চিত করা। চার নম্বরে দুগ্ধদানকারী মায়ের পুষ্টি নিশ্চিত করা। পাঁচ নম্বরে প্রবীণ ও বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন মানুষের পুষ্টি নিশ্চিত করা। অর্থাৎ প্রবীণদের বিষয়টা আগেই ভাবা হয়েছিল। তবে সবশেষ বিডিএইচএস সার্ভে অনুযায়ী অনেক ক্ষেত্রেই পুষ্টি পূরণের বিষয়ে আশানুরূপ উন্নতি হয়নি।

 

প্রবীণদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় গাইডলাইন হচ্ছে

অধ্যাপক ডা. মিজানুর রহমান

লাইন ডিরেক্টর, জাতীয় পুষ্টিসেবা

প্রবীণদের শারীরিক অবস্থা ঠিক রাখতে আমরা কিছু পরিকল্পনা সাজিয়েছি। এর মধ্যে অন্যতম হেলদি ডায়েট। এটার ওপরে মানুষকে আরও বেশি সচেতন করা। এ ছাড়া ডিজিজ গাইডলাইন তৈরি করছি। কোন রোগ হলে কোনটা খাবে- এ রকম দিকনির্দেশনা সংবলিত লিফলেট তৈরি করছি। এই গাইডলাইনটা যদি কমিউনিটির মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পারি তাহলে আমরা লক্ষ্যে পৌঁছতে পারব। প্রবীণদের সামাজিক নিরাপত্তার জন্য আমরা কাজ করছি। হাসপাতালগুলোতে বয়স্ক রোগীরা যেন উঠতে পারেন সে জন্য র‌্যাম্প করে দিয়েছি। অনেক উপজেলা হেলথ কমপ্লেক্সে স্পেশাল চেয়ার বানানো হয়েছে যেন তাঁরা সহজে সেবা নিতে পারেন। আমাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা রয়েছে। ওই পরিকল্পনায় জেনেটিক নিউট্রিশনের জন্য বিশাল বাজেট রাখা হয়েছে। যাতে আমরা লক্ষ্যে পৌঁছতে পারি। সে জন্য সবার সহযোগিতা প্রয়োজন। বিশেষ করে গণমাধ্যমের ভূমিকা বেশি প্রয়োজন।

 

প্রবীণদের পুষ্টির বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয় না

ইমদাদুল হক মিলন

প্রধান সম্পাদক, কালের কণ্ঠ

সচেতনতামূলক এ ধরনের গোলটেবিলের আয়োজন আমরা প্রায়ই করে থাকি। এর কারণ হলো- আমরা গণমাধ্যম দিয়ে দেশের মানুষকে সচেতন করার কাজ করছি। সচেতনতার জন্যই আজকের এ আয়োজন। প্রবীণদের পুষ্টির বিষয়টি বাংলাদেশে তেমন গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয় বলে আমার জানা নেই। আমরা অন্যান্য বিষয় নিয়ে কথা বলি কিন্তু প্রবীণদের নিয়ে বলি না। আমরা নিজেরাও প্রবীণ হচ্ছি। প্রবীণদের পুষ্টি নিয়ে আমাদের কাজ করতে হবে। সচেতনতার বিকল্প নেই। পরিবারকে সচেতন হতে হবে। এ নিয়ে আলোচনা করতে হবে। সরকারেরও ভূমিকা রাখতে হবে। বাংলাদেশ প্রতিদিন সবচেয়ে জনপ্রিয় পত্রিকা। এ পত্রিকার মাধ্যমে আমরা এই মতামত জনগণের কাছে পৌঁছে দেব। তখন দেশের মানুষ ব্যাপারগুলো জানবে এবং তারা সচেতন হবে। আমরা মানুষের কল্যাণের জন্য কাজ করে যাচ্ছি।

 

প্রবীণরা তিন ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হন

ডা. মো. এম ইসলাম বুলবুল

প্রোগ্রাম ম্যানেজার, জাতীয় পুষ্টিসেবা

প্রত্যেক ঘরে প্রত্যেকের পরিবারে প্রবীণরা একটা অংশ। আমরা যাঁদের সম্মানের চোখে দেখি তাঁরাই হলেন প্রবীণ। এই প্রবীণরাই তিন ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হন। মানসিক, শারীরিক ও সামাজিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হন তাঁরা। এর মধ্যে শারীরিকের মধ্যে হাড়ক্ষয়ের রোগ অন্যতম। ডায়াবেটিস, কিডনি, হার্ট, হৃদরোগ এবং রক্তের বিভিন্ন সমস্যায় ভোগেন তাঁরা। একই সঙ্গে দাঁত নষ্টসহ বয়স্করা বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকেন। এ জন্য তিনটি সুপারিশ রয়েছে। প্রথমত, প্রবীণদের নিয়ে ক্ষুদ্র পর্যায়ে কিছু গবেষণা হয়েছে; সেখানে বিশদ গবেষণা দরকার। যার মাধ্যমে আমরা বুঝতে পারব- তারা কোন সমস্যায় ভোগেন। দ্বিতীয়ত, গবেষণার বেসিসে চিন্তা করে আমার এক্সিস্ট পলিসি লেভেলে খুঁজে বের করে সেখানে ইনপুট দেওয়া। যেখানে একটু ইনপুট দিলে বেশি আউটপুট পাওয়া যাবে। সবশেষ মানুষের সচেতনতা বাড়ানো। কোন খাবারগুলো ভালো, কোন খাবার ভালো নয়। কীভাবে চললে ভালো থাকবে।

 

দেশে .২৫ শতাংশ মানুষ প্রবীণ

ডা. গাজী আহমদ হাসান তুহিন

থানা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা, তেজগাঁও

বর্তমানে সারা বিশ্বে এক বিলিয়ন প্রবীণ রয়েছেন। ২০৩০ সালে ১ দশমিক ৪ বিলিয়ন মানুষ প্রবীণ হবেন। আর ২০৫০ সালে ২ দশমিক ১ বিলিয়নে পৌঁছাবে। ২০১৫-২০৫০ সালে এ সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ হচ্ছে। বাংলাদেশে ৬০ বছরের ওপর প্রবীণ রয়েছেন ৯ দশমিক ২৫ শতাংশ মানুষ। প্রবীণদের জন্য মৌলিক কিছু খাবারের প্রয়োজন তা হলো- প্রোটিন, লিপিড, কার্বোহাইড্রেট, ভিটামিন, মিনারেল, ফাইবার। একজন মানুষের দৈনিক ২৫-৩০ শতাংশ ক্যালোরির প্রয়োজন পড়ে।

প্রবীণদের জন্য কিছু নির্দেশিকা রয়েছে। তা হলো- শারীরিক পরিচর্যার মাধ্যমে শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণ রাখা, প্রচুর পরিমাণে শাকসবজি খাওয়া, লো ফ্যাট দুধ খাওয়া, ডিম, বাদাম ইত্যাদি খাওয়া। প্রতিদিন পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি পান করা, দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত থাকার জন্য ইয়োগা, মেডিটেশন করা। কম ফ্যাট জাতীয় খাবার খাওয়া, লবণ কম খাওয়া, পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে খাবার খাওয়া। দিনে তিনবার খাবার খাওয়া, ব্যায়াম করা।

আমরা যদি এসব না করি তাহলে আমাদের শরীরে বিভিন্ন রকম প্রভাব পড়তে পারে। এর মধ্যে প্রাথমিক প্রভাব হলো- সামাজিক ও পারিবারিক বোঝা তৈরি হয়। তাই প্রবীণদের স্বাস্থ্যসেবা দিতে আরও বেশি উদ্যোগ নিতে হবে।

 

প্রবীণদের পুষ্টিতে সচেতন হতে হবে

আসফিয়া আজিম

ডেপুটি কান্ট্রি ডিরেক্টর, নিউট্রিশন ইন্টারন্যাশনাল

আমাদের দেশে মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে। এখন গড় আয়ু ৭২.৩ বছর। এর মধ্যে প্রবীণদের সংখ্যা প্রায় ১০ শতাংশ। ২০৮০ সালে এর সংখ্যা অনেক বেড়ে যাবে। সেই ১০ শতাংশ মানুষের সুরক্ষায় আমরা কতটুকু প্রস্তুত আছি। ২০২১ সালে আইসিডিডিআরবি’র এক গবেষণায় দেখা গেছে, আমাদের প্রবীণ জনগোষ্ঠীর বেশির ভাগ খাদ্য গ্রহণে সচেতন নয়। এদের বেশির ভাগ চার বা আরও বেশি উপকরণ দিয়ে খাবার গ্রহণ করেন। যার মধ্যে অতিরিক্ত মাত্রায় নিউট্রিশন রয়েছে। যা তার শরীরের জন্য খারাপ। প্রবীণদের আরেকটি দল পুষ্টিহীনতায় ভোগেন। অতিরিক্ত এবং পুষ্টিহীনতা দুটিই শরীরের জন্য ক্ষতি। তাই প্রবীণদের পুষ্টির চাহিদা কতটুকু তা তাঁর জানা দরকার এবং আরও সচেতনতা দরকার। দেশে প্রবীণ জনগোষ্ঠী কেমন আছেন তার কোনো তথ্য-উপাত্ত আমাদের কাছে নেই। একই সঙ্গে প্রবীণ ব্যক্তিদের খাদ্য নীতিমালা তৈরি করা হয়নি। পলিসি ও কৌশলগত পরিকল্পনাও নেই তাঁদের জন্য। এ ছাড়া প্রবীণ ব্যক্তিরা সেবা নিতে হাসপাতালে গেলে সেবাদাতা ব্যক্তিরা কি জানেন তাঁদের কীভাবে সেবা দিতে হবে?  প্রবীণদের অন্যতম সমস্যা দাঁত নষ্ট হয়ে যাওয়া। দাঁত না থাকার কারণে তাঁরা পুষ্টিকর অনেক খাবার খেতে পারেন না। ফলে তাঁরা পুষ্টিহীনতায় ভোগেন।

 

প্রবীণদের খাদ্যাভ্যাসে নজর দেওয়া জরুরি

ডা. শেখ শাহেদ রহমান

চিফ অব পার্টি, সূচনা প্রোগ্রাম, সেভ দি চিলড্রেন

বয়স্ক অর্থাৎ প্রবীণ ব্যক্তিদের খাদ্যাভ্যাসে নজর দেওয়া খুব জরুরি। এটার অন্যতম কারণ খাবারের ক্ষেত্রে তাঁর আগ্রহ আছে কি না এটা তাঁর মানসিক ও পারিবারিক ফ্যাক্টর কাজ করে। এগুলোর মধ্যে আছে- প্রবীণদের ক্রয় সীমা কতটুকু আছে? কারা বেশি ঝুঁকিতে? গ্রাম অঞ্চলের নাকি শহর অঞ্চলের মানুষ? একই সঙ্গে যাঁরা ঝুঁকিতে থাকেন তাঁরা পুরুষ নাকি নারী তা দেখতে হবে। এসব চিহ্নিত করতে হবে। আমরা আমাদের পপুলেশন ডেমোগ্রাফিক ট্রানজেকশনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। আমরা যে গ্রাফ দেখতে পাচ্ছি তলাটা সরু ওপরটা বাড়বে অর্থাৎ প্রবীণ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বাড়বে। এ জন্য আমরা তৈরি কি না। আমাদের দেশে ধনী এবং গরিবের বৈষম্য বাড়ছে। প্রকারান্তরে ঝুঁকিতে পড়ছেন প্রবীণরা। এ জন্যই সবচেয়ে বেশি ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে।

বাজেটে ভাতার পরিমাণ ৫০০ টাকা থেকে ৬০০ টাকা করেছে। এই টাকা কি যথেষ্ট? বাজার মূল্য হিসাবে মাসিক ভাতার পরিমাণ বাড়েনি। আমাদের প্রত্যাশা অনেক বেশি। জাতীয় পুষ্টি প্রতিষ্ঠান পুষ্টি সেবা নিশ্চিতে কাজ করছে। পুষ্টি কার্যক্রমকে দেশের মানুষের দোড়গোড়ায় পৌঁছে দেওয়া সারা পৃথিবীতে একটা নজির। এটা কিন্তু শুধু তাদের কাজ নয়। পুষ্টি নিয়ে ২২টি মন্ত্রণালয় কাজ করে। তাদের এ বিষয়ে এগিয়ে আসতে হবে।

 

বয়স্কদের জন্য কল্যাণমূলক কেন্দ্র চালু করতে হবে

মিথুন গুপ্তা

প্রোগ্রাম ম্যানেজার, এইচ.এন.পি.পি, ব্র্যাক

আমাদের ওল্ড হোম থেকে বের হয়ে এসে ওয়েল বিং (কল্যাণমূলক কেন্দ্র) সেন্টার প্রচলন করতে হবে। বয়স্ক ব্যক্তিদের জন্য এক ছাতার নিচে সব ধরনের সুবিধার ব্যবস্থা করতে হবে। এটা আমাদের নিশ্চিত করতে হবে। পুষ্টি স্ক্যানিং ও বিভিন্ন ধরনের কেয়ার, স্পেশাল কেয়ার সাপোর্ট করা যেতে পারে। সেই সঙ্গে মানসিক সুস্বাস্থ্য ও শারীরিক কসরত যেন নিশ্চিত করা যায়, তা দেখতে হবে। নগরায়ণের কারণে মানুষ এখন ব্যস্ত হয়ে পড়ছেন। প্রবীণদের সঙ্গে গল্প করতে হবে। তাঁদের সঙ্গে সময় দেওয়া ও খাওয়া-দাওয়া করতে হবে। এই জায়গাটায় একটা বড় চ্যালেঞ্জ হয়েছে। আগে মানুষ বাড়ির নারীদের ওপর নির্ভর ছিল। এখন নারীরাও কাজের মধ্যে বের হয়ে গেছে। সুতরাং এই দায়িত্বটা এখন পুরো পরিবারের ওপর পড়েছে।

এবারের পুষ্টি সপ্তাহে আমাদের মূূল বিষয় হচ্ছে- ‘মজবুত হলে পুষ্টির ভিত স্মার্ট বাংলাদেশ হবে নিশ্চিত’। আমাদের বয়স্কদের শারীরিক ও মানসিক সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে বেশ কিছু সমস্যা দেখা দিচ্ছে। অনেক রোগ আছে যাতে মানুষের শারীরিক সক্ষমতা কমে আসে। তাদের খাবার গ্রহণের পরিমাণ কমে যায়। এই জায়গায় নজর দিতে হবে।

সর্বশেষ খবর