শিরোনাম
শুক্রবার, ১৩ অক্টোবর, ২০২৩ ০০:০০ টা

আন্তর্জাতিক দুর্যোগ প্রশমন দিবস-২০২৩

আন্তর্জাতিক দুর্যোগ প্রশমন দিবস-২০২৩

বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আজ বাংলাদেশেও পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক দুর্যোগ প্রশমন দিবস। এ বছর দিবসের প্রতিপাদ্য ‘অসমতার বিরুদ্ধে লড়াই করি, দুর্যোগ সহনশীল ভবিষ্যৎ গড়ি’। ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগে সবচেয়ে ঝুঁকিতে বাংলাদেশ। গত দুই দশকে এ ভূখন্ডে ১৮৫টি প্রাকৃতিক দুর্যোগ আঘাত হেনেছে। এতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত উপকূলীয় প্রান্তিক জনগোষ্ঠী। পূর্বাভাস ও পূর্ব প্রস্তুতির কারণে বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনা গেলেও প্রতিনিয়ত চরিত্র বদলাচ্ছে দুর্যোগের। নতুন আতঙ্ক হিসেবে দেখা দিয়েছে ভূমিকম্প, বজ্রপাত ও মানবসৃষ্ট দুর্যোগ। দুর্যোগ মোকাবিলায় প্রশিক্ষিত জনবল কাঠামো গঠনের পাশাপাশি স্মার্ট প্রযুক্তি ব্যবহারে জোর দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। সম্প্রতি এসব নিয়ে ইডব্লিউএমজিএল কনফারেন্স কক্ষে এক গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করা হয়। গোলটেবিল বৈঠকের সঞ্চালনায় ছিলেন মো. মানসুরুল হক। বরেণ্য ব্যক্তিদের আলোচনার চুম্বকাংশ তুলে ধরেছেন শামীম আহমেদ ও হাসান ইমন। ছবি তুলেছেন- জয়ীতা রায়

 

দুর্যোগ মোকাবিলায় বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে অনন্য রোল মডেল

ডা. মো. এনামুর রহমান

প্রতিমন্ত্রী, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়

দুর্যোগ মোকাবিলায় বাংলাদেশ বিশ্বে এক রোল মডেল। আইএমএফ, ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, আমেরিকা, ব্রিটেন, ভারতসহ বিভিন্ন দেশ আমাদের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার প্রশংসা করেছে। তবে দুর্যোগ মোকাবিলায় আমাদের দুটি দুর্বলতা প্রকাশ পেয়েছে। প্রথমত- বজ্রপাত, দ্বিতীয়ত- ভূমিকম্প। এই দুর্যোগ মোকাবিলায় আমরা এখনো প্রস্তুত নই। তবে সরকার বসে নেই। ভালোভাবে প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করতে না পারলে দেশ পিছিয়ে যাবে। আমরা আমাদের অর্থনীতিকে যত শক্তিশালী করতে পারব, দুর্যোগে ক্ষয়ক্ষতি যত কমিয়ে আনতে পারব, জাতি হিসেবে আমরা তত শক্তিশালী হতে পারব। আমাদের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষার শক্তি তত বাড়বে। দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্তদের কাছে দ্রুত ত্রাণ পৌঁছে দিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে ৬৪ জেলায় ৬৬টি ত্রাণ গুদাম করা হয়েছে। দুর্গত এলাকায় উদ্ধার তৎপরতায় ৬০টি মাল্টিপারপাস রেসকিউ বোট তৈরি করা হয়েছে। দারিদ্র্য বা অসমতা দূর করতে সামাজিক নিরাপত্তার আওতায় প্রায় ১৪৩টি প্রকল্প আছে। এই খাতে এ বছর বাজেটে প্রায় ১ লাখ ৩৭ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। বজ্রপাত সহনীয় রাষ্ট্র গড়ে তুলতে আমরা কিছু প্রজেক্ট হাতে নিয়েছি। বজ্রপাতের ৩০ থেকে ৪০ মিনিট আগে পূর্বাভাস পাওয়ার পাশাপাশি ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় স্বল্প দূরত্বে বজ্রপাত সহনশীল শেল্টার তৈরি করব। এটা বাস্তবায়ন করতে পারলে ঘূর্ণিঝড় ও বন্যার মতো বজ্রপাতেও ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনতে পারব। এ ছাড়া ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি এবং মৃত্যু কমাতে জাপানের মতো বাংলাদেশকেও ভূমিকম্প সহনীয় রাষ্ট্রে পরিণত করতে হবে। শুধু ভলান্টিয়ার তৈরি করে এবং উদ্ধার সরঞ্জাম কিনলে হবে না। জাপান তাদের বিল্ডিং কোড পরিবর্তন করে ১০ মাত্রার ভূমিকম্প সহনশীল বিল্ডিং কাঠামো তৈরি করেছে। ফলে এখন জাপানে ১০ মাত্রার ভূমিকম্প হলে বিল্ডিংগুলো দোলে কিন্তু ভেঙে পড়ে না। দীর্ঘদিন পর হলেও গত বছর বাংলাদেশে বিল্ডিং কোড প্রবর্তন করা হয়েছে। এখানে সাড়ে ৭ মাত্রার ভূমিকম্প সহনশীল বিল্ডিং কোড তৈরি করা হয়েছে। কারণ আমাদের দেশে এখন পর্যন্ত এর চেয়ে বেশি মাত্রার ভূমিকম্প হয়নি। এই বিল্ডিং কোড হওয়ার ফলে যে ভবনগুলো ঝুঁকিপূর্ণ সেগুলোকে ধ্বংস করে নতুন ভবন নির্মাণ করা হবে। বহুতল ভবনগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হবে। যেগুলো ভূমিকম্প সহনশীল না সেগুলোকে ‘রেট্রোফিটিং’ করার মাধ্যমে ভূমিকম্প সহনশীল করা হবে। এ প্রক্রিয়া চালুর জন্য রাজউক ইতোমধ্যে ৫০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। ভূমিকম্প ও বজ্রপাতে সহনীয় হয়ে গেলে আমরা দুর্যোগ সহনীয় রাষ্ট্র হিসেবে নিজেদের ঘোষণা দিতে পারব।

 

প্রাকৃতিক দুর্যোগের চেয়ে এখন মানবসৃষ্ট দুর্যোগ বেশি

ক্যাপ্টেন (অব.) এ বি তাজুল ইসলাম

সভাপতি, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি

যারা শহরে অট্টালিকায় থাকেন, তারা বন্যা বা ঘূর্ণিঝড় তেমন টের পান না। ক্ষতিগ্রস্ত হন পিছিয়ে পড়া প্রান্তিক জনগোষ্ঠী। তবে ভূমিকম্প হলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন শহরের বাসিন্দারা। কখন যে কোন দুর্যোগ আসবে তা আমরা জানি না। তাই সব সময় প্রস্তুত থাকতে হবে। বাংলাদেশের মানুষ ও সরকারের দুর্যোগ মোকাবিলার সক্ষমতা আগের তুলনায় বেড়েছে। ১৯৭৪ সালে দুর্ভিক্ষের সময় সরকারের গুদামে খাদ্যশস্য থাকার পরও তা মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার মতো অবকাঠামো ছিল না। পর্যাপ্ত হেলিকপ্টারও ছিল না। এসব অভিজ্ঞতা থেকে আমরা নিজেদের দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিচ্ছি। তবে এখনই আত্মতৃপ্তিতে ভোগার সুযোগ নেই। আমাদের দেশে এখন প্রাকৃতিক দুর্যোগের চেয়ে মানবসৃষ্ট দুর্যোগ বেশি। ছোটখাটো ঘটনায় একজন আরেকজনকে খুন করে ফেলছে। রাস্তায় ট্রাফিক সিগন্যাল মানছে না। অন্যের ক্ষতি করছে। আমাদের এই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে পরিবর্তন আনতে হবে। শুধু প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা নয়, অন্যান্য বিষয়েও সহনশীল হতে হবে। এ জন্য জাতীয় ঐক্য দরকার। বিভাজিত জাতি কোনো কিছুতে দ্রুত এগোতে পারে না। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে গেছে। আগে যে মূল্যবোধগুলো শেখানো হতো, এখন তার কিছুই নেই। শুধু বছরের প্রথমদিকে ৩২ কোটি বই দিলে শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতি হবে না। এখন পর্যন্ত আমরা একটা টেকসই শিক্ষা পদ্ধতি দিতে পারিনি! পরীক্ষা পদ্ধতি দিতে পারিনি! এগুলো আমাদের সামনে যাওয়ার প্রচেষ্টাকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। আমাদের রপ্তানি ৮ ভাগ কমে গেছে। রেমিট্যান্স ৯ ভাগ কমে গেছে। আবার বিদেশি লোন রিপেমেন্ট ৪ গুণ বেড়েছে। অর্থাৎ সামনে মানবসৃষ্ট একটা দুর্যোগ আসছে। এটা মোকাবিলার জন্য আমাদের প্রস্তুতি নিতে হবে। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সেটা মোকাবিলার চেষ্টা করছেন, আশা করছি তিনি পারবেন। এগুলোকে ছোট করে দেখার কারণ নেই। ডলার সংকটে এলসি পেমেন্ট করা যাচ্ছে না। এখন হয়তো এটা আটকে রাখছি, একসময় তো দিতে হবে। তখন চাপ অনেক বেশি হবে। এগুলো মানবসৃষ্ট দুর্যোগ। এটা অনেক কঠিন হবে। এক্ষেত্রে সহযোগিতা নেই। সবকিছু নিজের উদ্যোগেই করতে হচ্ছে। সব ধরনের দুর্যোগ প্রশমনে মানসিক প্রস্তুতি যেমন লাগবে, পাশাপাশি আর্থিক সক্ষমতা ও আধুনিক সরঞ্জামাদিও লাগবে। দুর্যোগ প্রশমনে আমাদের অবকাঠামোগত সক্ষমতা এখনো কাক্সিক্ষত মানে পৌঁছেনি। এটি রাতারাতি করাও সম্ভব নয়। তবে আশা করছি, সামনে এ বিষয়ে দেশ আরও এগিয়ে যাবে। সরকার সেই চেষ্টা করছে। সবার সহযোগিতায় আমরা নতুন প্রজন্মকে সুন্দর ভবিষ্যৎ দিয়ে যেতে চাই।

 

আমরা এখন অন্যান্য দেশের দুর্যোগেও সহায়তা দিচ্ছি

মো. কামরুল হাসান এনডিসি

সচিব, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়

প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় আমাদের সাফল্য বিশ্বস্বীকৃত। আমরা এখন দেশের বাইরেও ত্রাণ সহায়তা দিচ্ছি। ফেব্রুয়ারিতে সিরিয়া ও তুরস্কে ভূমিকম্পে বাংলাদেশ সবার আগে তাঁবু, খাবার, ওষুধ, কম্বল পাঠিয়েছি। উদ্ধারকারী দল পাঠিয়েছি। যা সারা বিশ্বে প্রশংসিত হয়েছে। আমাদের এখন কাজ করতে হবে মানবসৃষ্ট দুর্যোগ নিয়ে, যার পূর্ব প্রস্তুতি নিতে পারি না। একের পর এক অগ্নিকান্ড, প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে। দুর্ঘটনা বলে-কয়ে আসে না। এক্ষেত্রে পূর্ব প্রস্তুতি প্রয়োজন। তুষারধস ও অগ্ন্যুৎপাত বাদে সব দুর্যোগই বাংলাদেশে হয়। এ জন্য দুর্যোগে সহনশীল হওয়া আমাদের আবশ্যিক। এক্ষেত্রে আমাদের অর্জন রয়েছে। ১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড়ে ১০ লাখের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছিল, কিন্তু গত মে মাসে ঘূর্ণিঝড় মোখায় মৃত্যু ছিল শূন্য। অথচ ঘূর্ণিঝড়টি ছিল ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত, আমেরিকান পদ্ধতিতে ক্যাটাগরি-৪। এমন ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানার পর শূন্য মৃত্যু অসামান্য সাফল্য। আশিয়ানের তথ্যমতে, আমাদের পাশের দেশ মিয়ানমারেও ১৪৭ জনের মৃত্যু হয়েছিল। আমাদের পূর্ব প্রস্তুতির কারণে সৃষ্টিকর্তা আমাদের এ সাফল্য দিয়েছেন। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় আমরা রিঅ্যাকটিভ মেথড থেকে প্রো-অ্যাকটিভ মেথডে চলে এসেছি। অর্থাৎ দুর্যোগ আঘাত হানার আগেই আমরা তা মোকাবিলার সব প্রস্তুতি নিয়ে ফেলছি। এখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তরফ থেকে যে উপহারের ঘরগুলো দেওয়া হয়েছে, সেগুলোও দুর্যোগ সহনশীল। বর্তমানে যে কোনো দুর্যোগ আসার আগেই আপৎকালীন ত্রাণ মজুদ রাখছি।

 

নগরকে দুর্যোগ সহনশীল করা এখন বড় দায়িত্ব

মো. মিজানুর রহমান

মহাপরিচালক, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতর

গ্রামে ঘূর্ণিঝড় ও বন্যা মোকাবিলায় আমাদের যথেষ্ট সফলতা আছে। এখন প্রয়োজন নগরকে দুর্যোগ সহনশীল করা। ভূমিকম্পের বিষয়ে আমাদের অনেক কিছু করণীয়। রানা প্লাজা দুর্ঘটনার কারণে শিল্প ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশের অনেক বদনাম হয়েছে। কিন্তু এ দেশের মানুষ ঘুরে দাঁড়াতে পারে। ১০০টি উন্নতমানের গ্রিন ইন্ডাস্ট্রির মধ্যে বাংলাদেশ ৫৩টির মালিক। প্রথম সারির ১০টির মধ্যে ৯টির মালিক বাংলাদেশ। আমি বিশ্বাস করি ভূমিকম্প নিয়ে আমাদের যে দুর্বলতা আছে, সেটাও আমরা জাপানের মডেল অনুসরণ করে কাটিয়ে উঠতে পারব। এখন দরকার জ্ঞান ও আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার। দুর্যোগে সব সময় ঝুঁকিতে থাকে পেছনে পড়া মানুষ। সমাজের ধনী ব্যক্তি, যার একটি টেকসই বাড়ি আছে, তার জন্য দুর্যোগ বড় ব্যাপার না। এই অসমতা দূর করাই আমাদের মূল লক্ষ্য। এখানকার মানুষ পরিশ্রমী। কিন্তু তারা দুর্যোগে ভুক্তভোগী। দুর্যোগ তাদের পেছনে ফেলে দেয়। এই অসম মানুষদের জন্য দেশ স্বাধীনের পর জাতির পিতা নানা কর্মসূচি নিয়েছিলেন। উপকূলীয় এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের নিয়ে সিপিপি গঠন করেন। সেখানে এখন ৭৭ হাজার ভলান্টিয়ার, যার ৫০ ভাগ নারী। এ কারণে আমরা জাতিসংঘ থেকে অ্যাওয়ার্ড পেয়েছি। এ বছর ঘূর্ণিঝড়ে আমাদের কোনো মৃত্যু নেই, বন্যায় মৃতের সংখ্যা বিশের নিচে, যেখানে আমাদের প্রতিবেশী দেশসহ উন্নত দেশগুলোতে শতাধিক, সহস্রাধিক মানুষ মারা গেছে। সুতরাং দুর্যোগ সহনশীল জাতি হিসেবে আমরা আমাদের পরিচয় দিতে সক্ষম হয়েছি।

 

নানা উদ্যোগে প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি কমেছে

নাহিদ সুলতানা মল্লিক

পরিচালক (গবেষণা ও প্রশিক্ষণ), দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতর

বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম দুর্যোগপ্রবণ দেশ। বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, ভূমিধস, টর্নেডো, খরা, লবণাক্ততা, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে বৈশ্বিক উষ্ণতা ইত্যাদি মোকাবিলা করে চলেছে ছোট এই দেশটি। অর্থনৈতিক, ভৌগোলিক, বিনিয়োগ ও প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও দুর্যোগ ঝুঁকি প্রশমনে আধুনিক বিশ্বের কাছে অন্যতম দৃষ্টান্ত বাংলাদেশ। ১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড়ে উপকূলীয় এলাকায় ১০ লাখ মানুষ ও বহু প্রাণী প্রাণ হারায়। জাতির পিতা তাঁর দূরদর্শী চিন্তায় ১৯৭২ সালে চালু করেন বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র। ১৮ হাজার স্বেচ্ছাসেবক নিয়ে ১৯৭৩ সালে ‘ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচি (সিপিপি)’ চালু করেন। বর্তমানে স্বেচ্ছাসেবকের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৬ হাজার ১৪০ জন, যার মধ্যে অর্ধেক নারী। দেশব্যাপী ৩৫০টি বন্যা পূর্বাভাস কেন্দ্র সচল রয়েছে। গাণিতিক মডেল ব্যবহারে আবহাওয়া অধিদফতর থেকে ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাস অনেকটা নির্ভুলভাবে পাওয়া যাচ্ছে। দুর্যোগের প্রাক্কালে রেডিও, টিভি ও মাইকিং ছাড়াও দ্রুত আগাম সতর্কতা প্রচারে টোল ফ্রি ১০৯০ নম্বরে আইভিআর চালু রয়েছে। দুর্যোগ সহনীয় বাসগৃহ নির্মাণ কর্মসূচির আওতায় এখন পর্যন্ত ১ লাখ ৬০ হাজার ৪৫০টি বাসগৃহ নির্মাণ করে হস্তান্তর শুরু হয়েছে। আরও বাসগৃহ নির্মাণকাজ চলমান। নানা উদ্যোগের কারণে দুর্যোগে প্রাণহানি-ক্ষয়ক্ষতি কমে গেছে। চলতি বছর মহাকাশে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২ উৎক্ষেপণের কথা রয়েছে। এটা হলে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার সক্ষমতা আরও বৃদ্ধি পাবে।

 

প্রাতিষ্ঠানিকভাবে প্রশিক্ষিতদের সম্পৃক্ত করতে হবে

প্রফেসর মাহবুবা নাসরীন

উপ-উপাচার্য (শিক্ষা), বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়

১৯৮৮ সালের বন্যার পর দেখেছি সেখানে কোনো বেসরকারি সংস্থাও কাজ করছে না। কেউ ত্রাণ নিয়ে যাচ্ছে না। তারা জানতও না বেশি পানি হলে কী করতে হবে। মুজিবকেল্লার কথা তখন তারা শোনেননি। যদিও তাদের আগের জেনারেশন শুনেছে, কারণ এই কর্মসূচি আগেই নেওয়া হয়েছিল। নানা প্রতিকূলতা কাটিয়ে ধীরে ধীরে বাংলাদেশ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে এগিয়ে যাচ্ছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ হয়েছে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও ইনস্টিটিউটে পড়ানো হচ্ছে। এখান থেকে যারা বের হচ্ছেন তারাই আমাদের বড় সম্পদ। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে যারা উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেছেন, প্রশিক্ষিত হয়েছেন, তাদের সম্পৃক্ত করে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার পরিকল্পনা সাজালে ফল ভালো হবে। দুর্যোগে আমরা খাপখাইয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছি। বিভিন্ন সরকারি পদক্ষেপের মাধ্যমে সেই প্রক্রিয়াকে শক্তিশালী করা হচ্ছে। তবে প্রাইভেট সেক্টর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় অনেক পিছিয়ে। তারা বিষয়টিকে চ্যারিটি বা মানবিক দিক মনে করেন। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা যে বিনিয়োগ হতে পারে সেটা উনারা ভাবেন না। প্রাইভেট সেক্টরকে কীভাবে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় অন্তর্ভুক্ত করা যায় সেই পরিকল্পনা করতে হবে। জাপানের মতো দেশ যদি সুনামি জেনারেটেড ভূমিকম্প প্রাইভেট সেক্টরের সহায়তা নিয়ে সামাল দিতে পারে, আমরা কেন পারব না? সব মিলিয়ে যেসব স্থানে পিছিয়ে আছি, সেই জায়গাগুলোতে নজর দিতে হবে। তাহলে দুর্যোগ মোকাবিলায় আমরা আবার চ্যাম্পিয়ন হব।

 

দুর্যোগ প্রশমনে সারা বছরই তৎপরতার মধ্যে থাকছি

সুব্রত পাল চৌধুরী

প্রকল্প পরিচালক, দুর্যোগ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা বর্ধিতকরণ প্রকল্প

কথায় আছে- নদী তীরে বাস, ভাবনা বারো মাস। দুর্যোগ ভাবায়, আর আমরা ভাবি। নদীমাতৃক এই দেশে আমাদের সার্বক্ষণিক ভাবনা-দুর্যোগ কখন আসবে? এর প্রেক্ষাপটে আমরা কী করছি? দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় ও অধিদফতর কী করছে? হ্যাঁ, আমরা কিন্তু ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছি। নিউজিল্যান্ডে জমাট বরফ গলে যাচ্ছে, অস্ট্রেলিয়াতে ঝড়-ঝঞ্ঝা হচ্ছে, বনে আগুন লাগছে। সেখানে প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি বেশি, এখানে কম। কারণ তারা দুর্যোগের জন্য প্রস্তুত না, আমরা প্রস্তুত। আমরা জানি দুর্যোগকে শুধু প্রশমন করা যায়, নিবারণ করা যায় না। এ জন্য বাংলাদেশে দুর্যোগ আসবে এবং বিভিন্ন রূপে আসছে। সিকিমের বাঁধ ভেঙে যে বন্যার সৃষ্টি হয়েছে, এর জন্য তারাও প্রস্তুত ছিল না, আমরাও ছিলাম না। এত বছর হয়নি, এখন কেন হলো? কারণ, ওখানে বরফ গলছে। অর্থাৎ বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে দুর্যোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমরা জনগণকে নিয়ে দুর্যোগ প্রশমনে সদা তৎপর। এবারের দিবসের প্রতিপাদ্য- অসমতার বিরুদ্ধে লড়াই। প্রশ্ন হচ্ছে- অসমতাটা কোথায়? গ্রামে বানভাসি মানুষের অবস্থা আর ঢাকায় থাকা মানুষের অবস্থা এক নয়। এখানেই অসমতা। দুর্যোগ অসমতা বাড়িয়ে তোলে। এই অসমতার বিরুদ্ধে আমরা প্রতিনিয়ত লড়াই করে যাচ্ছি।

 

দুর্যোগ সহনীয়, টেকসই ও নিরাপদ দেশ গড়াই আমাদের উদ্দেশ্য

মো. মানসুরুল হক

সঞ্চালক ও প্রোগ্রামার, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতর

আপনারা জানেন, বাংলাদেশ সারা বিশ্বের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় রোল মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এর পেছনে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা ব্যাপক। ১৯৮৯ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ কর্তৃক দিনটিকে ‘আন্তর্জাতিক দুর্যোগ প্রশমন দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রতি বছর ১৩ অক্টোবর বাংলাদেশসহ বিশ্বজুড়ে দিবসটি পালিত হয়। এর উদ্দেশ্যও একটাই- দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় সাধারণ মানুষের সম্পৃক্ততা। আর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতর প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইন বাস্তবায়নে বদ্ধপরিকর। এই আইনের উদ্দেশ্য- বিভিন্ন দুর্যোগে বিপদাপন্নতা হ্রাস, দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষের সামর্থ্য বৃদ্ধির জন্য কার্যকর মানবিক সহায়তা কর্মসূচি গ্রহণ, দুর্যোগের ঝুঁকি হ্রাস এবং জরুরি সাড়া দান ইত্যাদি। এই আইন, বিধি, পরিকল্পনা ও নীতিমালার আলোকে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বিবেচনায় নিয়ে সরকার দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি টেকসই উন্নয়ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। দুর্যোগে ঝুঁঁকি হ্রাসে জীবন ও সম্পদের সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে দুর্যোগ সহনীয়, টেকসই ও নিরাপদ দেশ গড়ার লক্ষ্যে সরকার পরিকল্পিতভাবে কাঠামোগত ও অবকাঠামোগত কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে।

 

ভবিষ্যতে দুর্যোগ মোকাবিলা আরও চ্যালেঞ্জিং হবে

এম আবেদ আলী

জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা, কুমিল্লা

বছর ঘুরলেই আমরা আন্তর্জাতিক দুর্যোগ প্রশমন দিবস বা জাতীয় দুর্যোগ প্রস্তুতি দিবস পালন করি। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘোষণা অনুযায়ী ২০৪১ সালে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে হলে দুর্যোগ মোকাবিলায় আমাদের স্মার্ট জনবল কাঠামো প্রয়োজন। আমরা যদি দুর্যোগ মোকাবিলায় জেলা ও উপজেলা কাঠামোকে শক্তিশালী করতে না পারি, তাহলে অদূর ভবিষ্যতে দুর্যোগ মোকাবিলা চ্যালেঞ্জ হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যেভাবে অনাকাক্সিক্ষতভাবে দুর্যোগ আসছে, বৃষ্টির সময় খরা, অসময়ে ভারী বৃষ্টি, হঠাৎ বন্যার সৃষ্টি, তাতে বর্তমান জনবল দিয়ে দুর্যোগ মোকাবিলা কঠিন হয়ে যাবে। আমি দুর্যোগ নিয়ে বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় কাজ করেছি। এখন পর্যন্ত যত দুর্যোগ এসেছে, মন্ত্রণালয় ও অধিদফতরের কর্মকর্তারা রাত-দিন পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ এবং তা মোকাবিলায় কাজ করেছেন। কিন্তু মূল ব্যবস্থাপনা হচ্ছে জেলা-উপজেলা পর্যায়ে। সেখানে প্রশিক্ষিত, পেশাদার জনবল দরকার। তাই দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের কাঠামোগুলোকে শক্তিশালী ও স্মার্ট করতে হবে। আমরা এখন বন্যার পূর্বাভাস পাচ্ছি। সেই অনুযায়ী প্রস্তুতিও নিতে পারছি। কিন্তু এখন পর্যন্ত ভূমিকম্পের কোনো পূর্বাভাস পাচ্ছি না। ফলে কোনো প্রস্তুতিও নেওয়া যাচ্ছে না। এটাও আমাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।

 

স্থায়ী প্রশিক্ষিত জনবল ছাড়া স্মার্ট দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অসম্ভব

মুহাম্মদ মবিনুর রহমান

সহকারী পরিচালক, মুজিবকেল্লা নির্মাণ, সংস্কার ও উন্নয়ন প্রকল্প

১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড়ে ১০ লাখ মানুষ মারা গিয়েছিল, সর্বশেষ ঘূর্ণিঝড় মোখায় কারও মৃত্যু হয়নি। এটা প্রমাণ করে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় আমরা অনেক এগিয়ে গেছি। কিন্তু সুনামগঞ্জে ২০২২ সালে ১২০ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যা হয়। দুই ঘণ্টার মধ্যে ডিসি অফিস ৪ ফুট পানিতে ডুবে যায়। বন্যার এমন ধরন আগে ছিল না। সেই বন্যাও আমরা সফলভাবে মোকাবিলা করতে পেরেছি। এটা আমাদের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আধুনিকায়নের অন্যতম উদাহরণ। তবে জলবায়ু পরিবর্তনে দুর্যোগের প্রকৃতি বদলে গেছে। অসময়ে হঠাৎ বন্যা চলে আসা আমাদের নতুন করে ভাবিয়ে তুলেছে। প্রকৃতির সঙ্গে খাপখাইয়ে আমাদের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার পরিকল্পনা বদলাতে হবে। স্থায়ী প্রশিক্ষিত জনবল ছাড়া স্মার্ট দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সম্ভব না। এ ছাড়া ভূমিকম্পের প্রস্তুতিটা আমরা এখনো সেভাবে নিতে পারিনি। বিশেষ করে ঢাকা শহরের ব্যবস্থাপনা খুবই জটিল। এখানে বড় ধরনের ভূমিকম্প হলে ব্যবস্থাপনা কঠিন হবে। সর্বোপরি আইনিভাবে আমরা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় অনেক এগিয়ে আছি। আমাদের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইন আছে, পরিপত্র আছে, ম্যানেজমেন্টের নীতিমালা আছে। নেই শুধু প্রশিক্ষিত পেশাদার জনবল। স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে স্মার্ট জনবল কাঠামো দরকার।

সর্বশেষ খবর