মঙ্গলবার, ৭ নভেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

পোশাক খাতে সংকট : সমাধান কোন পথে

পোশাক খাতে সংকট : সমাধান কোন পথে

দেশের অর্থনীতির চাকাকে গতিময় করে বিশ্ববাজারে গৌরবের সঙ্গে বাংলাদেশকে তুলে ধরে তৈরি পোশাকশিল্প। সম্প্রতি এ খাতে দেখা দিয়েছে সংকট। পোশাক কারখানাগুলোতে ঘটেছে হামলা-ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগের ঘটনা। ‘পোশাক খাতে সংকট : সমাধান কোন পথে’ এ বিষয়ে বাংলাদেশ প্রতিদিন আয়োজন করেছিল গোলটেবিল বৈঠক। আলোচনায় উপস্থিত বক্তারা বলেছেন, হামলা-মামলা নয়, দুই পক্ষকে আলোচনার মাধ্যমে খুঁজতে হবে শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথ। লিখেছেন- শাহেদ আলী ইরশাদ, জয়শ্রী ভাদুড়ীরাশেদ হোসাইন। ছবি তুলেছেন - জয়ীতা রায়

 

শ্রমিকদের সুষ্ঠু জীবিকার চেষ্টা করেন প্রধানমন্ত্রী

শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন  সাবেক সভাপতি, বিজিএমইএ

এফবিসিসিআই ও বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি এবং সংসদ সদস্য শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন বলেন, শিল্প ও শ্রমিক বান্ধব প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শ্রমিকদের জীবন-জীবিকা সব সময় সুষ্ঠুভাবে যাতে চলে সেই চেষ্টাই করেন। তারই আলোকে পোশাক খাতের জন্য করোনার সময় শ্রমিকদের জন্য দুই শতাংশ সুদে ৫ হাজার কোটি টাকা প্রণোদনা ঋণ দিয়েছিলেন। সবকিছু হিসাব করতে হবে বাস্তবতার ওপর ভিত্তি করে। কারণ বাজার অর্থনীতিতে চাহিদা ও সরবরাহের ওপর দাম নির্ধারণ হয়। কভিড-পরবর্তী রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতি বাড়িয়ে দিয়েছে। ডলারের বিনিময় হার বৃদ্ধির কারণে কাঁচামালের দাম বাড়ায় তৈরি পোশাকের দাম বাড়লেও বিশ্ববাজারে চাহিদাও কমেছে। ভূ-রাজনীতির কারণে আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশের প্রতি আগ্রহ বেড়েছে। শ্রমিকদের আন্দোলনকে রাজনৈতিক রূপ দেওয়া হচ্ছে। দেশি-বিদেশি চক্রান্তের শিকার হচ্ছে, যৌক্তিক আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করতে হবে। সংকটময় সময়ে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। কারণ আমরা আরও বেশি খুশি হই যখন দেখি আমাদের শ্রমিকদের জীবনযাত্রার মান আরও বেশি ভালো থাকে।

 

আলোচনায় মিলবে সমাধান

ড. জামাল উদ্দিন আহমেদ  অর্থনীতিবিদ

দেশের পোশাক খাতকে এগিয়ে নিতে মালিক-শ্রমিক এক টিম হয়ে কাজ করতে হবে। স্বাধীন দেশে আন্দোলনের ধরন এবং আচরণে পরিবর্তন আনতে হবে। এটা কোনো ঔপনিবেশিক শাসক কিংবা পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে কোনো আন্দোলন নয়। এই কারখানা মালিকরা এদেশেরই মানুষ। কৃষিনির্ভর দেশ থেকে পোশাকশিল্প নির্ভর অর্থনীতিতে যাওয়ার এই অবদান উদ্যোক্তা এবং শ্রমিক উভয়ের। কিন্তু অন্য দেশের তুলনায় দক্ষতায় আমরা পিছিয়ে আছি। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের গবেষণায় উঠে এসেছে অন্য দেশের শ্রমিকদের দক্ষতার তুলনায় বাংলাদেশের শ্রমিকরা অনেকটা পিছিয়ে আছে। চীনে মজুরি বেড়ে যাওয়ায় উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে। এ জন্য বিনিয়োগকারীদের অন্যতম আকর্ষণের জায়গা বাংলাদেশ। এই অর্ডারগুলো করতে দক্ষতা বাড়ানোই এখন চ্যালেঞ্জ। আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতামূলক পোশাকের বাজারে টিকে থাকতে সহিংসতা বন্ধ করতে হবে। ভাঙচুরের মাধ্যমে সমাধান করা সম্ভব নয়। দুই পক্ষকে আলোচনার মাধ্যমেই সমাধানের পথ খুঁজতে হবে। প্রতিযোগীরা বাংলাদেশের পোশাক বাজারের প্রতি ঈর্ষাপরায়ণ হয়ে উঠেছে। ধৈর্য ধরে সমাধানের পথ বের করতে হবে।

 

বেতন নির্ধারণের আগে আন্দোলন কাম্য নয়

সিদ্দিকুর রহমান  সাবেক সভাপতি, বিজিএমইএ

দেশের পোশাক খাতে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করা হচ্ছে। মালিকদের সঙ্গে পোশাক শ্রমিকদের সম্পর্ক ভালো না হলে এ খাত এত দূর এগিয়ে যেত না। শ্রমিক-মালিক দুই পক্ষের অধিকার আছে। শ্রম আইন, বিধি সবাইকে মানতে হবে। শ্রমিকরা নিয়মতান্ত্রিকভাবে আন্দোলন করতেই পারে। গার্মেন্টগুলোতে ব্যাঙের ছাতার মতো সংগঠন গড়ে উঠেছে। অনেক সংগঠনের রেজিস্ট্রেশন নেই। তারা শ্রমিকদের আন্দোলনের উসকানি দেয়। এসব উসকানিতে কারখানা ভাঙচুর করা হয়, আগুন দিয়ে জানমালের ক্ষতি করা হয়। সন্ত্রাসী কর্মকান্ড করলে মামলা তো হবেই। নৈরাজ্যকর অবস্থা সৃষ্টি করা কাম্য নয়। এর সুষ্ঠু তদন্ত চাই। বহিরাগত বা রাজনৈতিক ইস্যু বা এনজিও দিয়ে শ্রমিকদের আন্দোলনে নামানো হচ্ছে। বেতন নির্ধারণের আগে এ ধরনের আন্দোলন কখনো হয়নি। আগামীকাল (মঙ্গলবার) সমাধানযোগ্য বেতন নির্ধারণ করা হবে। চাহিদার থেকেও যথেষ্ট ভালো হবে বেতন। যারা ভাঙচুর করবে, যারা আইন নিজেদের তুলে নেবে তাদেরকে আইনের আওতায় আসতে হবে। মজুরি বোর্ডে বেতন চূড়ান্ত হওয়ার আগে ষড়যন্ত্রের উদ্দেশ্যে রাজপথে নামানো হয়েছে শ্রমিকদের। কারখানাগুলো ভাঙচুর না করতে শ্রমিকদের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।

 

দুই পক্ষ মিলে সংকটের সমাধান করতে হবে

নঈম নিজাম  সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন

দেশজুড়ে চলছে রাজনৈতিক দলগুলোর নানা কর্মসূচি। এর আগে ইউক্রেন রাশিয়া যুদ্ধ নিয়ে চ্যালেঞ্জে পড়েছিল দেশের শিল্প খাত। তৈরি পোশাকের খাত সব সময় আমাদের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। কিন্তু সম্প্রতি এ খাতে দেখা দিয়েছে সংকট। এই সংকট ও এর সমাধান নিয়ে কথা বলার জন্য আমরা আমন্ত্রণ জানিয়েছি বিজিএমইএ, শ্রমিক সংগঠন, অর্থনীতিবিদ, সমাজবিজ্ঞানীসহ সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে। মালিক-শ্রমিক সবার সম্মিলিত শ্রম-মেধা এ খাতকে উল্লেখযোগ্য অবস্থানে নিয়ে এসেছে। সবাই যার যার অবস্থান থেকে চায় এ শিল্পের আগামীর পথচলা আরও গতিময় হোক। কিন্তু যে সংকট তৈরি হয়েছে তা কীভাবে আমরা সমাধান করতে পারি- তা নিয়েই এখন মূল আলোচনা। নতুন মজুরি কাঠামো ঘোষণার পর আমাদের গার্মেন্ট শ্রমিক ভাই-বোনেরা এটাকে ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করবে বলে প্রত্যাশা করি। কারণ ভাঙচুর সংকটের সমাধান নয়। আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া সংকটের সমাধান নয়। দাবি নিয়ে দরকষাকষি করতে হবে। মালিক ও শ্রমিক দুই পক্ষ মিলেই আমাদের পোশাক খাতকে রক্ষা করতে হবে। অর্থনীতির স্বার্থে, আগামী দিনের বাংলাদেশের স্বার্থে ইতিবাচক একটা অধ্যায়ের পক্ষে আমাদের অবস্থান গ্রহণ করতে হবে।

 

সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে

শহীদুল্লাহ আজিম  সহসভাপতি, বিজিএমইএ

বিজিএমইএর সহ-সভাপতি শহীদুল্লাহ আজিম বলেন, বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত দাঁড়িয়েছে সাহসী উদ্যোক্তা, কর্মঠ শ্রমিক আর অনুকূল পরিবেশের কারণে। শ্রমিকদের মজুরি বাড়াতে হবে, এটা নিয়ে কাজ চলছে। সময় আছে পুরো নভেম্বর মাসজুড়ে। নতুন মজুরি কার্যকর হবে ডিসেম্বরে। কিন্তু সিদ্ধান্ত হওয়ার আগেই অতি উৎসাহী হয়ে হামলা, ভাঙচুর করা হচ্ছে। কভিড, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট বিশ্বমন্দায় শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। আমরা চাইব আমাদের শ্রমিকরা অবশ্যই ভালো থাকুক। শ্রমিকদের সঙ্গে মালিকদের সম্পর্ক ভালো না হলে ৬০০ শ্রমিক আর ১২ হাজার ডলার রপ্তানি পোশাক খাতে বর্তমানে ৪০ লাখের বেশি শ্রমিক কাজ করে ৪৫ বিলিয়ন ডলারের পোশাক রপ্তানি হতো না। অনেক সময় শ্রমিকদের উসকানি দিয়ে কারখানা ভাঙচুর, নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি তৈরি করে আমাদের বলির পাঁঠা বানানো হয়। সবকিছু নির্ভর করে শিল্পের সক্ষমতার ওপর। তাই এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখার জন্য সুবিধাভোগী সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। প্রয়োজনে একটি কমিটি করে সবকিছু নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করতে হবে।

 

সক্ষমতা বিবেচনা করে বেতন কাঠামো নির্ধারণ করতে হবে

মোহাম্মদ হাতেম  নির্বাহী প্রেসিডেন্ট, বিকেএমইএ

বিকেএমইএ’র নির্বাহী প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ হতেম বলেন, আমাদের সক্ষমতা বিবেচনা করেই বেতন কাঠামো নির্ধারণ করতে হবে। নির্বাচনকে সামনে রেখে বেতন নির্ধারণ করলে হবে না, আমাদের সক্ষমতাকে আমলে নিতে হবে। ইন্ডাস্ট্রিকে বাঁচাতে হবে। বাংলাদেশ ছাড়া পৃথিবীর কোথাও শ্রমিকদের সাতটি গ্রেড  নেই। পৃথিবীর কোথাও মেশিনের সঙ্গে হেলপার থাকে না। শুধু কি বেতন কাঠামো শ্রমিকদের কারখানায় বাড়াতে হবে, অন্য কোথাও দরকার নেই? মাস্টার্স পাস করা একটা ছেলে ১২ হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকা স্যালারি নিয়ে চাকরিতে প্রবেশ করছে। সবকিছু বিবেচনা করেই বেতন কাঠামো বাড়াতে হবে। অন্যান্য দেশে অ্যাপারেল ইন্ডাস্ট্রিজে কাজ না করলেও হাই টেক ইন্ডাস্ট্রিজে কাজ করার সুযোগ আছে। আমাদের দেশে তো এ ধরনের সুযোগ নেই। এই সেক্টরে শেষ হলে অন্য সেক্টরে কাজ করার জন্যও শ্রমিকরা যেতে পারবে না। ভিয়েতনামে ভোকেশনাল ট্রেনিং দিয়ে ফ্যাক্টরিতে লোক নিয়োগ দেয়। আর আমরা গার্মেন্টে এনে ট্রেনিং দেই। এতে দামি মেশিনের ঝুঁকি থাকে।

 

ধ্বংসাত্মক কাজ শ্রমিকদের হতে পারে না

সালেউদ জামান খান জিতু  ভাইস প্রেসিডেন্ট, বিটিএমইএ

বিটিএমইএ’র ভাইস প্রেসিডেন্ট সালেউদ জামান খান জিতু বলেন, ইউক্রেন যুদ্ধে মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে গেছে। মালিকরা শ্রমিকদের সন্তুষ্ট রাখতে আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। ডিসেম্বর মাসে নতুন মজুরি আসার কথা, তার আগেই আন্দোলনে নামছে শ্রমিকরা। ফ্যাক্টরির শ্রমিকদের জোর করে বের করছে। কারা করছে তাদের খুঁজে বের করতে হবে। তাদের মজুরি বাড়াতে গত কয়েক বছর ধরে কাজ চলছে। যেসব কারখানার শ্রমিক আন্দোলন করছে না সেখানেও ভাঙচুর হচ্ছে।

এটা শ্রমিকদের আন্দোলন না, ধ্বংসাত্মক আগুন জ্বালাও শ্রমিকের কাজ হতে পারে না। শ্রমিক নেতারা বিষয়গুলো ভালোভাবে দেখবে। আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা সম্ভব। ফ্যাক্টরি বন্ধ হয়ে গেলে শ্রমিকরা কোথায় যাবে। ইন্ডাস্ট্রি বাঁচাতে হবে। শ্রমিকদের ভুল মেসেজ ও উসকানি না দেয় সেদিকে সবাইকে খেয়াল রাখতে হবে। এক ধরনের গুজব ছড়ানো হচ্ছে তাদের মাঝে। ন্যায্যতার ভিত্তিতে এই মজুরি নির্ধারণ করা হবে। সরকার ও মালিক পক্ষ তা নিয়ে কাজ করছে।

 

সব কিছু বিবেচনা করেই ২০ হাজার ৩৯৩ টাকা প্রস্তাব করেছি

সিরাজুল ইসলাম রনি  সভাপতি, বাংলাদেশ জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক লীগ

                                        সদস্য, নিম্নতম মজুরি বোর্ড, গার্মেন্টস শিল্প সেক্টর

বাংলাদেশ জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক লীগের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম রনি বলেন, আমরা পোশাকশিল্পের জন্য যে মজুরি প্রস্তাব করেছি তা বাস্তব ভিত্তিতেই প্রস্তাবনা দেওয়া হয়েছে। শ্রম আইনের ১৪১ ধারা অনুযায়ী পোশাক শ্রমিকদের ক্রয়ক্ষমতার কথা বলা আছে। আমরা সব কিছু বিবেচনা করে ২০ হাজার ৩৯৩ টাকা প্রস্তাব করেছি। এটা তথ্য উপাত্ত নিয়ে করা হয়েছে। আমরা সাতটা গ্রেডের জায়গায় ৫টা গ্রেডের কথা বলেছি। এবার রেশনিং এর কথাও বলা হয়েছে। মালিকরাও এ বিষয়ে একমত পোষণ করেছেন। যেসব অঞ্চলে বাড়ি ভাড়া বেড়ে যায় সে অঞ্চলে সরকারের প্রতিনিধি, স্থানীয় প্রতিনিধি মিলে সম্বন্বিত মনিটরিংয়ের ব্যবস্থ্যা চালু করার কথা বলা হয়েছে। আমাদের ১৩টি দাবি রয়েছে। গ্র্যাচুরিটি অনেকে পায় না, আমরা বলেছি এই সুবিধা চালু করতে হবে। ২০ থেকে ৩০ বছর কাজ করে যেন শ্রমিকরা খালি হাতে না যায়। সব বিষয়ে বিবেচনা করে আমরা মজুরি বোর্ডে প্রস্তাবনা দিয়েছি। ২০০ গ্রিন ফ্যাক্টরি হয়েছে কিন্তু শ্রমিকদের দীর্ঘমেয়াদি কাজ করার জন্যও টাকা বাড়ানোর প্রয়োজন রয়েছে।

 

মালিক-শ্রমিক একে অন্যের পরিপূরক

মহসীন উদ্দিন আহমেদ নীরু  সাবেক সহসভাপতি, বিজিএমইএ

বিজিএমইএর সাবেক সহ-সভাপতি মহসীন উদ্দিন আহমেদ নীরু বলেন, শ্রমিক এবং মালিক মিলেই গার্মেন্ট। শ্রমিক ছাড়া গার্মেন্ট নেই এবং মালিক ছাড়া গার্মেন্ট হবে না। আমরা একে অন্যের পরিপূরক। আমি দেখেছি মালিকদের কোনো সমস্যা হলে শ্রমিকরা সব সময় মালিকদের পাশে থাকত। শ্রমিককে বাদ দিয়ে কোনো গার্মেন্ট চলতে পারে না। তাই আমি মনে করি শ্রমিকদের উন্নয়নের জন্য মালিক এবং আমাদের সংগঠনকে সব সময় তৎপর থাকতে হবে। শ্রমিকরা ভালোভাবে থাকতে পারে, খেতে পারে সেটা দেখতে হবে। এখন জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে। আবার অনেক অর্ডার বাতিল হচ্ছে। বৈশ্বিক সমস্যা। এর মধ্যেই আবার সময় এসেছে মজুরি নির্ধারণের। সরকারের সহযোগী এবং শ্রমিকরা ছাড়া গার্মেন্ট চালাতে পারব না। তাই আমরা চেষ্টা করছি এই দুটির সমন্বয় করতে। এ জন্য তো একটু সময় লাগবেই। সবাইকে ধৈর্য ধরা উচিত। কারণ এখনো তো সবকিছু সেটেল হয়ে যায়নি। আলোচনা চলছে। শ্রমিক ভাইদের প্রতি অনুরোধ একটু সময় দেয়া হোক। সরকার মজুরি নির্ধারণ করুক। আমরাও শ্রমিকদের সঙ্গে সমন্বয় করি।

 

বেতন সমন্বয় করে রেশনিং চালু করা জরুরি

নাজমা আক্তার  সভাপতি, সম্মিলিত গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশন

যুদ্ধ, সংঘাত, মূল্যস্ফীতি চলছে বিশ্বজুড়ে। বিভিন্ন দেশ বিভিন্ন কৌশলে সেটা মোকাবিলা করছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের এ বাজারে শ্রমিকদের প্রয়োজনীয় খাবারের চাহিদা পূরণ হচ্ছে না। প্রতিদিন একজন পোশাক শিল্প শ্রমিকের ৩ হাজার ক্যালোরি খাবার গ্রহণ করা উচিত। কিন্তু তাদের বেতনে সে পরিমাণ খাবার গ্রহণ করার সামর্থ্য থাকে না। এ জন্য মানসম্মত বেতনের পাশাপাশি রেশনিং চালু করতে হবে। কারখানার বাইরে গাড়ি থাকবে, সেখান থেকে নির্ধারিত ন্যায্যমূল্য দিয়ে শ্রমিকরা পণ্য কিনবে। বেতনের সঙ্গে জীবনযাপন ব্যয়ের সমন্বয় জরুরি। দেশ এগিয়ে যাচ্ছে কিন্তু শ্রমিকদের জীবন-জীবিকার কোনো পরিবর্তন নেই। ওভারটাইম ছাড়া শ্রমিকদের চলার কোনো অবস্থা থাকে না। শ্রমিকদের ওপরে গুলিবর্ষণ আমরা আশা করিনি। গুন্ডাপান্ডা, রাজনৈতিক কর্মীদের দিয়ে শ্রমিকদের পেটানো হয়েছে। দেশে ট্রেড ইউনিয়ন হয়েছে কিন্তু কতটা মানসম্মত হয়েছে। কোম্পানির পকেট ইউনিয়ন করা হয়েছে।

শ্রমিক ঠকানোর জন্য অনেকেই প্রস্তত থাকেন। আমরা চাই শ্রমিকদের মজুরি ২৩ হাজার টাকা নির্ধারণ করা হোক। অন্যন্য সবদেশ পোশাক শ্রমিকদের মানসম্মত বেতন দিতে পারলে আমার দেশের শ্রমিকরা কেন নিম্নমজুরি পাবে? তারা সবসময় কেন দারিদ্রসীমার নিচে জীবনযাপন করবে?

 

বায়াররা কম টাকায় পণ্য চান শ্রমিকদের বেতন বাড়াতে চান না

অধ্যাপক সালমা আকতার  অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সালমা আকতার বলেছেন, বায়াররা কম টাকায় পণ্য চান, কম দামের লেবার চান। আন্তর্জাতিক মার্কেটে পণ্য নিয়ে যেতে চান কিন্তু তারা আমাদের শ্রমিকদের দায়িত্ব নিতে চান না। আন্তর্জাতিক মার্কেটের ধারণা নিয়ে আমাদের বেতন-ভাতা ও কাঠামো নির্ধারণ করতে হবে। উইন উইন অবস্থা তৈরি করতে হবে। গার্মেন্ট সেক্টর একটা মাল্টি স্টেকহোল্ডার সেক্টর। আমাদের এখানে দুই ধরনের সমস্যা রয়েছে। একটা আন্তর্জাতিক, আরেকটা জাতীয় সমস্যা। কিছু কিছু ফ্যাক্টরিতে ডে মিল, চাইল্ড কেয়ার সেন্টার, সাবসিডি দেওয়া- এ ধরনের ব্যবস্থা করতে পারে। শ্রমিকদের নিউট্রিশনের দিকেও দেখতে হবে। পুষ্টি ভালো না থাকলে শ্রমিকরা ভালো কাজ করতে পারবে না। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের জন্য আমাদের তৈরি হতে হবে।

 

পোশাক খাত অনেক সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে

হাসনাত আলম  অর্থনীতিবিদ, পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশ

পলিসি একচেঞ্জ বাংলাদেশের অর্থনীতিবিদ হাসনাত আলম বলেন, সংকটের কথা চিন্তা করলে শ্রমিক আন্দোলন একটা বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। পাশাপাশি আমাদের পোশাক খাত অনেক সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। এর মধ্যে জ্বালানি, অর্ডার সংকট হচ্ছে। একই সঙ্গে চীন, ভিয়েতনামের তুলনায় প্রযুক্তিগতভাবে অনেক পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ। যে কারণে আমাদের শ্রমিক সহজলভ্য হলেও ওইসব প্রযুক্তি দিয়ে তারা এগিয়ে যাচ্ছে। শ্রমিক সংকট সমাধানে আমাদের একটি গ্রহণযোগ্য সমাধানে আসতে হবে। একটি নিরপেক্ষ বেতন নির্ধারণ করা যেতে পারে। স্বল্পমেয়াদি মূল্যস্ফীতি বাংলাদেশের প্রধান সমস্যা। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে দুই তিন মাসের জন্য পোশাক শ্রমিকদের একটা রেশনিংয়ের আওতায় আনা যেতে পারে। এ জন্য সরকার এবং পোশাক কারখানার মালিকরা বসে প্রধান সমস্যাগুলো সমাধানে আলোচনা করতে পারেন।

 

শ্রমিকদের সম্মানজনক মজুরি নির্ধারণ করতে হবে

শহিদুল ইসলাম সবুজ, ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক, গার্মেন্টস শ্রমিক ঐক্য ফোরাম

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির এ বাজারে উচ্ছিষ্ট মাছ, সবজি কিনে জীবনযাপন করে শ্রমিকরা। দৈনন্দিন খরচ কুলাতে না পেরে মজুরি বাড়ানোর দাবিতে শ্রমিকরা আন্দোলন করছে। গার্মেন্ট খাতে বিশ্বে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। দেশের অর্থনীতিতে এ খাতের ব্যাপক ভূমিকা। দেশের প্রবৃদ্ধি বাড়ছে, মধ্যম আয়ের দেশে রূপান্তরিত হচ্ছে কিন্তু শ্রমিকদের মজুরি অন্য সব দেশের তুলনায় অনেক কম। গার্মেন্ট খাতে এ সংকট নতুন নয়। আমরা গত বছর এই দিনে স্মারকলিপি দিয়েছি। নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন চলছিল। পরে মজুরি বোর্ড গঠন হয়। কিন্তু মালিকরা ১১ হাজার ৪০০ টাকা বেতন বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছেন। অথচ এখনই শ্রমিকরা ১১ হাজার টাকা বেতন পায়। তাহলে শ্রমিকরা তো মাঠে নামবেই। এ জন্য উসকানির দরকার নেই। সম্মানজনক মজুরি না পেলে শ্রমিকদের রাস্তা থেকে কারখানায় ফেরানো যাবে না। শ্রমিকদের বেতন অন্য খাতের সঙ্গে তুলনা করে নির্ধারণ করবেন। আমরা যেন শ্রমিকদের বলতে পারি যে সম্নানজনক মজুরী নির্ধারণ হয়েছে সে বিষয়টা আপনারা দেখবেন। শ্রমিকদের উপরে গুলিবর্ষণ হয়েছে, বেশ কিছু জায়গায় মামলা হয়েছে। হাজার হাজার শ্রমিক আসামি। এগুলো সমাধান জরুরি।

সর্বশেষ খবর