২৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ ১৫:৪৪

ডেঙ্গুতে আক্রান্ত-মৃতের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে, সর্বমহলে সতর্কতা প্রয়োজন

সৈয়দ ফারুক হোসেন

ডেঙ্গুতে আক্রান্ত-মৃতের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে, সর্বমহলে সতর্কতা প্রয়োজন

ইনসেটে সৈয়দ ফারুক হোসেন

রাজধানীসহ সারাদেশে এডিস মশার উপদ্রুব বৃদ্ধি পেয়েছে। আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। এমতাবস্থায় সরকারসহ সর্বমহলে সতর্কতা প্রয়োজন। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে এডিস মশার ঘনত্ব অত্যন্ত বেশি। ফলে দ্রুত আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে, সেই সঙ্গে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে মৃতের সংখ্যা। বর্তমান পরিস্থিতিত চিকিৎসকরা জ্বর হলেই ডেঙ্গু ভাইরাসের পরীক্ষা দিচ্ছে এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পজিটিভ পাচ্ছে। বড়দের পাশাপাশি শিশুরাও ডেঙ্গুতে খুব বেশি আক্রান্ত হচ্ছে।  

সাধারণত জুন থেকে সেপ্টেম্বর মাস ডেঙ্গু রোগের মৌসুম হলেও বর্তমানে প্রায় সারা বছরজুড়েই ডেঙ্গু রোগের প্রকোপ দেখা দিয়েছে। বর্ষা মৌসুমের আগেই হানা দেওয়া ডেঙ্গুর প্রকোপ ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলেছে। এছাড়াও এখন বৃষ্টি হচ্ছে, বৃষ্টি পানি বিভিন্ন জায়গায় জমে এডিস মশার প্রজনন বেশি হয় এবং ডেঙ্গুর বিস্তার ঘটছে। যদি আমরা এই প্রজননস্থলগুলো ধ্বংস করতে না পারি, প্রাপ্তবয়স্ক মশা এবং লার্ভা যদি বিনষ্ট করতে ব্যর্থ হই তাহলে ডেঙ্গুতে মৃত্যুর সংখ্যা এ বছর বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি হবার আশঙ্ক্ষা করছেন কীটতত্ত্ববিদগণ। এই মুহূর্তে আমাদের ডেঙ্গুর হট স্পট ম্যানেজ করা দরকার। রোগীদের ঠিকানা বের করে, ওই ব্যক্তির বাড়ির আশেপাশে ফগিং করে উড়ন্ত মশাগুলোকে মেরে ফেলতে হবে। কারণ এই উড়ন্ত মশাগুলোই এই মুহূর্তে ইনফেক্টেড মশা, এই মশাগুলো যতদিন বেঁচে থাকবে ততদিন জ্যামিতিক হারে ডেঙ্গু ছড়াবে। 

ডেঙ্গু রোগের কোনো লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। ডেঙ্গু পরীক্ষা করে নিশ্চিত হতে হবে। নগরবাসীকেও ডেঙ্গু প্রতিরোধে সম্পৃক্ত হতে হবে। তাদের বাসাবাড়ির ছাদে, আঙিনায় কিংবা অন্য কোনোখানে যাতে এডিস মশা জন্মাতে না পারে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। ডেঙ্গু থেকে বাঁচতে আমাদের কিছু সচেতনতা অবলম্বন করতে হবে তার মধ্যে একটি হলো যে এডিস মশার আবাসস্থল ধ্বংস করা। সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম ১০ দিনে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা অগাস্ট মাসের দ্বিগুণেরও বেশি। আর সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম ১০ দিনে দৈনিক ভর্তি রোগীর গড় সংখ্যা ৩৯৮ জন। 

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে দেখা গেছে, সেপ্টেম্বরের ১০ দিনে সারাদেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১৬ হাজার ৮১৯ জন। এ সময় মৃত্যু হয়েছে ১০২ জনের। সম্প্রতি সারাদেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ডেঙ্গু নিয়ে ভর্তি হয়েছেন ৬১৫ জন রোগী, যা এ বছর একদিনে ভর্তি রোগীর সর্বোচ্চ সংখ্যা। এদিন সারাদেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত ৫ জনের মৃত্যু হয়। এই সংখ্যাও এ বছর একদিনে সর্বোচ্চ। আগস্ট মাসে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৬৫২১ জন, যা জুলাইয়ের প্রায় আড়াইগুণ। আর সেপ্টেম্বরের প্রথম ১০ দিনেই ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়েছেন ৩৯৭৮ জন রোগী।বর্তমানে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি আছেন ১৬৬৪ জন রোগী। একদিনে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রোগীর এই সংখ্যা এ বছর সর্বোচ্চ। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যে দেখা গেছে, গত জানুয়ারি মাসে ডেঙ্গু  আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল ১০৫৫ জন। ফেব্রুয়ারি মাসে ৩৩৯ জন, মার্চ মাসে ৩১১ জন, এপ্রিল মাসে ৫০৪ জন, মে মাসে ৬৪৪ জন রোগী ভর্তি হন হাসপাতালে। জুলাই মাসে ভর্তি হন ২৬৬৯ জন।স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গত কয়েকদিনের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, জানুয়ারি মাসে দৈনিক গড়ে ৩৪ জন, ফেব্রুয়ারি মাসে ১২ জন, মার্চে ১০ জন, এপ্রিলে ১৭ জন, মে মাসে ২১ জন, জুন মাসে ২৭ জন করে রোগী ভর্তি হয়েছিল। জুলাই মাসে তা বেড়ে গড়ে ৮৬ জনে দাঁড়ায়। অগাস্ট মাসে দৈনিক গড়ে ২১৭ জন রোগী ভর্তি হয়েছে হাসপাতালে। 

ডেঙ্গু একটি ভাইরাসজনিত রোগ। এডিস মশার কামড়ে ডেঙ্গু হয়। সাধারণত জুলাই মাস থেকে অক্টোবর মাসের কাছাকাছি সময় ডেঙ্গু হয় যেমন এখন আমরা একটা ডেঙ্গুময় সময়ে আছি। ডেঙ্গু রোগে সাধারণত জ্বর হয় । এই জ্বর ১০২ থেকে ১০৩ ডিগ্রি ফরেনহাউট হতে পারে এবং এই জ্বরের সাথে শরীর ব্যথা, বমি বমি ভাব, পাতলা পায়খানা,  চোখের নিচে ব্যথা, ক্ষুধামন্দা এগুলো হতে পারে। তবে সব রোগীর কিন্তু সব সমস্যা নাও থাকতে পারে। এডিস মশা সাধারণত আমাদের খুব কাছে আমাদের ঘরের চার পাশেই থাকে এবং যেই জিনিসগুলো আমরা সাধারণত ব্যবহার করি সেগুলোতে তারা বংশবৃদ্ধি করে যেমন আমাদের ফুলের টব, ডাবের খোসা, ফ্রিজের জমে থাকা পানি, ফেলে দেওয়া বোতল, টায়ার, ছাদ বাগানের জায়গা। এসব জায়গায় তিন দিনের বেশি পানি জমে থাকলে এডিস মশার বংশবৃদ্ধি হতে পারে। পানি যেন তিনদিনের বেশি জমে থাকতে না পারে সেব্যবস্থা করতে হবে এবং আমরা যদি দিনের বেলা বিশ্রাম নেই তাহলে অবশ্যই মশারি টাঙাতে হবে কারণ এডিস মশা দিনের বেলায় কামড়ায়। ডেঙ্গু রোগ প্রতিরোধে এবং ডেঙ্গু রোগের চিকিৎসায় সচেতনতাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আমরা যদি সচেতন থাকি তাহলে ডেঙ্গু রোগ হওয়াার সম্ভাবনা খুব কম। আর যদি ডেঙ্গু রোগ হয়েও যায় তবে সময়মতো চিকিৎসা নিলে একটি মৃত্যুও আর ডেঙ্গু রোগ থেকে হবে না।  

সবাইকে সচেতন থাকতে হবে। তাহলে হয়তো রক্ষা পাওয়া যাবে। তা না হলে ডেঙ্গু রোগ এবার মহামারি আকার ধারণ করতে পারে। দেশজুড়ে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়তে শুরু করায় রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগী ভর্তি হচ্ছে। দেশে ডেঙ্গু রোগের ধরন বদলেছে। তাতে একদিকে ডেঙ্গু যেমন ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে, তেমনি ‘শহুরে রোগ’ ডেঙ্গু রোগ শহর ছাড়িয়ে ঝুঁকি বাড়িয়েছে দেশজুড়ে। ডেঙ্গু এখন সিজনাল নেই, সারা বছরই হচ্ছে। বৃষ্টি শুরু হলে এটা বাড়ছে। দিন যতই যাচ্ছে, ডেঙ্গু পরিস্থিতি ততই ভয়াবহ হচ্ছে।  ডেঙ্গু  এখন আর বর্ষা মৌসুমের আতঙ্ক নয়। ফলে এর ভয়াবহতা বাড়ছে। এটি মোকাবিলায় দায়িত্বশীল সংস্থাগুলোর তৎপরতার পাশাপাশি সাধারণ মানুষকেও ব্যাপকভাবে সচেতন হতে হবে। 

অসচেতনতা ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার অভাবের কারণেও ছড়ায় ডেঙ্গু রোগের ভাইরাস। এই ডেঙ্গু  ভাইরাসের মাধ্যমে ছড়ায় ডেঙ্গু  জ্বর। এডিস ইজিপ্টাই নামক এক ধরনের মশা এ ভাইরাস বহন করে। এ মশা কাউকে কামড়ালে তিনি চার থেকে ছয়দিনের মধ্যে ডেঙ্গু  জ্বরে আক্রান্ত হন। এরপর ওই আক্রান্ত ব্যক্তিকে কোনো জীবাণুবিহীন এডিস মশা কামড়ালে সেই মশাটি ডেঙ্গু  জ্বরের জীবাণুবাহী মশায় পরিণত হয়। এভাবে একজন থেকে অন্যজনে মশার মাধ্যমে ডেঙ্গু  ছড়িয়ে থাকে।  বাংলাদেশে প্রায় ২৯ প্রজাতির মশা থাকলেও এডিস প্রজাতির মশা দ্বারা সংক্রমিত ডেঙ্গু এ বছর মহামারী আকার ধারণ করেছে। চোখ-কান খোলা রাখুন, বাসার আশেপাশে যাতে এডিস মশা বংশবিস্তার করতে না পারে। আমরা সবাই জানি, এডিস মশা বংশবিস্তার করে পরিষ্কার পানিতে। তাই বাসার, বারান্দার, ছাদের টবে যেন পানি জমতে না পারে। রাস্তায় যেন আমরা ডাবের খোসা, পরিত্যক্ত টায়ার বা পানি জমার মতো কিছু ফেলে না রাখি। বাসার চারপাশ পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। কোরবানির পশুর বর্জ্যও ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব ঘটাতে পারে।সচেতন না হলে চ্যালেঞ্জ হবে সব মানুষের চিকিৎসা নিশ্চিত করা। 

প্রতি বছরই মানুষ ডেঙ্গু নিয়ে উদ্বেগে থাকে। মানুষকে সচেতন থাকতে হবে করতে হবে, নিজের বাড়িতে এডিস মশা না থাকার সর্বাত্মক উদ্যোগ নিতে হবে। আর জ্বরে  হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে বা হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে। যেভাবে ডেঙ্গু  সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছে তাতে পরিস্থিতি আরো খারাপ হতে পারে। বাড়তে পারে মৃত্যুর সংখ্যা। সচেতনতার অভাবেই প্রতি বছর এভাবে ডেঙ্গু হানা দেয়। শিশুদের এই সময়ে হাত পা ঢাকা জামা কাপড় পরানো উচিত। তারা দিনে ঘুমালে মশারি টানিয়ে দেয়া উচিত। ডেঙ্গুর জন্য দায়ী এডিস মশা দিনে কামড়ায়, তখন অধিকাংশ শিশু স্কুলে থাকে। যেহেতু এডিস মশাই এর একমাত্র বাহক সেহেতু এই মশার আবাস ও প্রজননক্ষেত্র ধ্বংস করতে পারলেই কেবলমাত্র আক্রান্ত হওয়ার হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে। 

ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সবাইকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে সচেতন হতে হবে জানিয়ে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যেহেতু মশাই এই রোগের একমাত্র বাহক, সুতরাং মশার আবাস ও প্রজনন ক্ষেত্র ধ্বংস করতে পারলেই এডিস নির্বংশ হবে সমূলে। ডেঙ্গু  প্রতিরোধের সর্বোত্তম উপায় তাই এডিস মশার বংশ নাশ। তাই বসতবাড়ির এ রকম আবদ্ধ জলাধার ধ্বংস করতে হবে। ফ্রিজের বা এসির পানি দুই দিন পরপর পরিষ্কার করতে হবে। বাসার বারান্দায়, টেরিসে বা কার্নিশে খোলা টব থাকলে সেটা পরিষ্কার করতে হবে। বাড়ির আশপাশের খানাখন্দ ভরাট করে ফেলতে হবে। কিন্তু অনেক নগরবাসী সচেতন হলেও এখনও অনেকে আছেন যারা সচেতন হচ্ছেন না। তারা তাদের বাসা-বাড়ি পরিষ্কার রাখছেন না।ডেঙ্গু প্রতিরোধে সবাইকে একসাথে নিজ নিজ অবস্থান থেকে কাজ করতে হবে। পরিবেশ পরিচ্ছন্ন ও মশামুক্ত করতে নিজ নিজ অবস্থান থেকে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। আমাদের শহর আমাদেরকে পরিষ্কার রাখতে হবে। 

সচেতনতা সৃষ্টিতে সিটি কর্পোরেশনের যেমন দায়িত্ব আছে ঠিক তেমনি নাগরিক হিসেবে আমাদের দায়ও কম নেই। ডেঙ্গুর এই ভয়াবহতা সবাইকে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নেমে আসতে হবে। হটস্পট এলাকায় জনসচেতনতা ও জনগণকে সম্পৃক্ত করার জন্য বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রম হাতে নিতে হবে। এলাকায় মাইকিং, পোস্টারিং ও লিফলেট বিতরণ করে জনগণকে ডেঙ্গু  পরিস্থিতি সম্পর্কে জানাতে হবে এবং তাদের সম্পৃক্ত করতে হবে। ডেঙ্গু  সংক্রমণের সময়ে একে অন্যকে দোষারোপ না করে যার যার অবস্থান থেকে নিজের দায়িত্বটুকু সুচারূপে পালন করলে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রিত পর্যায়ে রাখা সম্ভব। 

লেখক: সাবেক রেজিস্ট্রার, বিএসএফএমএসটিইউ

বিডি প্রতিদিন/আরাফাত 

সর্বশেষ খবর