রবিবার, ১৬ ডিসেম্বর, ২০১২ ০০:০০ টা

শীতের রোগবালাই ও সতর্কতা

অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ

শীতের রোগবালাই ও সতর্কতা
শীতের ঠাণ্ডা হাওয়া যেমন আরামদায়ক, আবার এর সঙ্গে কিছু স্বাস্থ্যঝুঁকিও রয়েছে। ঘুম থেকে উঠলেই দেখা যায় প্রকৃতি কুয়াশাচ্ছন্ন, আর সবুজ ঘাসে জমে আছে বিন্দু বিন্দু শিশির। তবে শুষ্ক আবহাওয়ার সঙ্গে কম তাপমাত্রার সংযোজন আর ধুলাবালির উপদ্রব_ সব মিলিয়েই সৃষ্টি করে কিছু স্বাস্থ্যগত সমস্যা। শীতে প্রধানত বাড়ে শ্বাসতন্ত্রের রোগ। তাপমাত্রা হ্রাসের সঙ্গে সঙ্গে বাতাসের আদর্্রতাও কমে, যা শ্বাসযন্ত্রের স্বাভাবিক কার্যে ব্যাঘাত ঘটায়। আর ভাইরাস দ্বারা আক্রমণের ঝুঁকি বাড়ায়। অন্যান্য ব্যাকটেরিয়ায় আক্রমণেরও প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। ঠাণ্ডা, শুষ্ক বাতাস আর ধুলাবালি সব মিলিয়ে যারা শ্বাসকষ্টের রোগে ভোগেন, যেমন হাঁপানি, ব্রংকাইটিস উপসর্গগুলো আরও বেশি হয়। সাধারণ ঠাণ্ডাজনিত সর্দি-কাশি বা কমন কোল্ড শীতের সময়ই বেশি দেখা যায়। শীতের শুরুতে তাপমাত্রা যখন কমতে থাকে তখনই এর প্রাদুর্ভাব বেশি হয়। শুরুতে গলা ব্যথা, খুশখুশ ভাব ও শুকনা কাশি দেখা দেয়, নাক দিয়ে অনবরত পানি ঝরতে থাকে এবং ঘন ঘন হাঁচি আসে। হালকা জ্বর, শরীর ব্যথা, মাথাব্যথা, শরীর ম্যাজ ম্যাজ করা, দুর্বল লাগা ও ক্ষুধামন্দা দেখা দেয়। এ রোগ এমনিতেই ভালো হয়ে যায়। সৈয়দ মুজতবা আলীর ভাষায়, 'চিকিৎসা করলে ৭ দিন লাগে, না করলে ১ সপ্তাহ লাগে'। এক্ষেত্রে প্যারাসিটামল এবং এন্টি হিসটামিন জাতীয় ওষুধ খেলেই যথেষ্ট। পাশাপাশি দেশজ ওষুধ যেমন : মধু, আদা, তুলসীপাতা, কালিজিরা ইত্যাদি রোগের উপসর্গ কমাতে সাহায্য করবে। হাঁচি-কাশির মাধ্যমে এই রোগ আবার আরেকজনের মধ্যেও ছড়ায়। তাই রোগ যাতে অন্যদের আক্রান্ত করতে না পারে, সে লক্ষ্যে আরোগ্য না হওয়া পর্যন্ত বাসায় থাকাই ভালো। বিশেষ করে স্কুলের ছাত্র-ছাত্রী যারা আক্রান্ত, তাদের অবশ্যই বাসায় রাখতে হবে। নেহাত বাইরে যেতে হলে মাস্ক ব্যবহার করা ভালো। অন্যদিকে এ সময় ইনফ্লুয়েঞ্জাও বেশিমাত্রায় দেখা যায়। এই রোগটি মূলত ভাইরাসজনিত। ঠাণ্ডার অন্যান্য উপসর্গ ছাড়াও এ রোগের ক্ষেত্রে জ্বর ও কাশিটা খুব বেশি হয় এবং শ্বাসকষ্টও হতে পারে। এ ছাড়া ভাইরাসে আক্রান্ত দেহের দুর্বলতার সুযোগে অনেক সময় ব্যাকটেরিয়াও আক্রমণ করে থাকে। বিশেষ করে নাকের সর্দি যদি খুব ঘন হয় বা কাশির সঙ্গে হলুদাভ কফ আসতে থাকে, তা ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণকেই নির্দেশ করে। এ রোগেরও তেমন কোনো চিকিৎসার প্রয়োজন হয় না, লক্ষণ অনুযায়ী চিকিৎসা দিলেই হয়। শুধু ব্যাকটেরিয়ায় আক্রান্ত হলেই এন্টিবায়োটিকের প্রয়োজন হয়। শীতের প্রকোপে নাকের এলার্জি, নাক দিয়ে রক্ত পড়া, সাইনুসাইটিস, মধ্যকর্ণে প্রদাহ, টনসিলাইটিস ইত্যাদি বেড়ে যায়। এসব ক্ষেত্রে ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করে চিকিৎসা নেয়াই ভালো। এ ছাড়া যাদের হাঁপানি বা অনেক দিনের কাশির সমস্যা যেমন ব্রংকাইটিস আছে, ঠাণ্ডা আবহাওয়ায় তাদের কষ্টও বাড়ে। নিউমোনিয়াও এ সময় প্রচুর দেখা যায়। ঠাণ্ডা ও হাঁপানি প্রতিরোধে করণীয় : ঠাণ্ডা খাবার ও পানীয় পরিহার করা। িকুসুম কুসুম গরম পানি পান করা ভালো। হালকা গরম পানি দিয়ে গড়গড়া করা উচিত। িপ্রয়োজন মতো গরম কাপড়, তীব্র শীতের সময় কানটুপি পরা এবং গলায় মাফলার ব্যবহার করা। িধুলাবালি এড়িয়ে চলা। িধূমপান পরিহার করা। িঘরের দরজা-জানালা সব সময় বন্ধ না রেখে মুক্ত ও নির্মল বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা রাখা। িহাঁপানির রোগীরা শীত শুরুর আগেই চিকিৎসকের পরামর্শ মতো প্রতিরোধমূলক ইনহেলার বা অন্যান্য ওষুধ ব্যবহার করতে পারেন। িযাদের অনেকদিনের শ্বাসজনিত কষ্ট আছে তাদের জন্য ইনফ্লুয়েঞ্জা এবং নিউমোক্কাস নিউমোনিয়ার টিকা নেওয়া উচিত। িতাজা, পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ এবং পর্যাপ্ত পানি পান করা, যা দেহকে সতেজ রাখবে। শীতে অন্যান্য রোগ : কাশির মতো প্রকট না হলেও শীতে আরও অনেক রোগেরই প্রকোপ বেড়ে যায়। যেমন : িআথর্্রাইটিস বা বাতের ব্যথা শীতে বাড়তে পারে। মূলত বয়স্কদেরই এ সমস্যা হয়। ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ সেবনের পাশাপাশি ঠাণ্ডা থেকে বাঁচার জন্য গরম কাপড়, ঘরে রুম হিটার থাকলে ব্যবহার, গ্লাভস ব্যবহার, কানটুপি ব্যবহার করতে হবে। প্রতিদিন হালকা গরম পানিতে গোসল করা ভালো। িঅনেক সময় কড়া রোদও ত্বকের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। তাই বাইরে গেলে সানস্ক্রিন ব্যবহার করলে ভালো হয়। অনেকক্ষণ কড়া রোদ না পোহানোই ভালো। িকিছু কিছু রোগে তীব্র শীতে অনেকের হাতের আঙ্গুল নীল হয়ে যায়। তারা অবশ্যই বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করবেন যেন কোনোভাবেই ঠাণ্ডা না লাগে। িঠাণ্ডা আবহাওয়ায় রক্তচাপ বাড়তে পারে। ঠাণ্ডার ওষুধে সিউডোএফেড্রিন বা ফিনাইলেফ্রিন জাতীয় ওষুধ রক্তচাপ বাড়ায়। িশীতের আরেকটি মারাত্দক সমস্যা হাইপোথার্মিয়া অর্থাৎ শরীরের তাপমাত্রা অতিরিক্ত কমে যাওয়া, যা মৃত্যুও ঘটাতে পারে। মূলত যারা পর্যাপ্ত শীতবস্ত্র ব্যবহার করে না এবং শিশু ও বয়োবৃদ্ধ যারা নিজেদের যত্ন নিতে অপারগ, তারাই এর শিকার। তাই এ সময় যত্নবান হতে হবে। লেখক : ডিন, মেডিসিন অনুষদ, মেডিসিন বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়

সর্বশেষ খবর