মঙ্গলবার, ২৪ এপ্রিল, ২০১৮ ০০:০০ টা
কাল ম্যালেরিয়া দিবস

ম্যালেরিয়া প্রতিরোধযোগ্য

অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ

ম্যালেরিয়া প্রতিরোধযোগ্য

বিশ্ব ম্যালেরিয়া দিবস কাল। এবারের প্রতিপাদ্য, ‘ম্যালেরিয়া নির্মূলে আমরা প্রস্তুত’। ম্যালেরিয়া সম্পর্কে মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করতে প্রতি বছর সারা বিশ্বে একযোগে দিবসটি পালন করা হয়। ম্যালেরিয়া বিশ্বের প্রাচীনতম এবং ভয়ঙ্কর এক সংক্রামক ব্যাধি। শক্তিশালী রোমান সাম্রাজ্যের পতনের অন্যতম কারণ ছিল এই ম্যালেরিয়া। গ্রিক বীররাও বারবার পরাজিত হয়েছে ম্যালেরিয়া নামক এ দানবের কাছে। মিসরীয় ইবার প্যাপিরাসে, সুমেরীয় কিউনিফর্ম ট্যাবলেটে, হিপোক্রেটিসের চিকিৎসা শাস্ত্রে, এমনকি শেকসপিয়ারের অন্তত আটটি নাটকে উচ্চারিত হয়েছে নাম না জানা এই শত্রুর কথা। জনশ্রুতি আছে আলেক্সান্ডার দ্য গ্রেটের সৈন্য বাহিনীর সঙ্গে এটি ছড়িয়ে পড়েছিল পৃথিবীব্যাপী। এমনকি ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ায় ইউরোপ, আফ্রিকা, এশিয়া, আমেরিকাসহ সব মহাদেশেই সৈন্যবাহিনীর মূল ঘাতক প্রতিপক্ষ নয়, বরং ম্যালেরিয়া। তখন থেকে সারা বিশ্ব ম্যালেরিয়ার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে শামিল।

কারণ : মশাবাহিত যতগুলো সংক্রামক রোগ রয়েছে তার মধ্যে ম্যালেরিয়া অন্যতম। ম্যালেরিয়ার মূলে রয়েছে প্লাজমোডিয়াম গোত্রের এক ধরনের অণুজীব। এটি সংক্রমিত স্ত্রী আনোফেলিস মশার কামড়ে হয়। আনোফেলিস ছাড়াও ভাইভাক্স, ওভাল বা ম্যালেরি এর যেকোনো একটি জীবাণু বহনকারী মশার দংশনে ম্যালেরিয়া হতে পারে। সংক্রমিত মশা যখন কোনো ব্যক্তিকে কামড়ায়, তখন ওই ব্যক্তির রক্তে ম্যালেরিয়ার জীবাণু প্রবেশ করে এবং সে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়। ম্যালেরিয়া আক্রান্ত ব্যক্তি যদি কাউকে রক্ত দান করে, তবে রক্ত গ্রহীতারও ম্যালেরিয়া হওয়ার আশঙ্কা থাকে। কোনো গর্ভবতী নারী যদি ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হন, তবে তার অনাগত সন্তানেরও ম্যালেরিয়া হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। কেননা গর্ভের সন্তানের মধ্যেও তখন এর জীবাণু ছড়ায়। এ মশা মূলত সন্ধ্যা থেকে ভোরের মধ্যে কামড়ায়। যারা ম্যালেরিয়া প্রবণ এলাকায় থাকেন তারা অথবা যারা ওই সব এলাকায় বেড়াতে যান, অল্প বয়স্ক এবং শিশুরা, গর্ভবতীদের সংক্রমণের ঝুঁকি বেশি।

লক্ষণ : কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসা এই রোগের প্রধান লক্ষণ। জ্বর ১০৫-১০৬ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত হতে পারে। তবে অনেক সময় নিয়মিত ও নির্দিষ্ট বিরতিতে জ্বর আসা-যাওয়া করে যেমন-একদিন পর পর জ্বর, তা তিন চার ঘণ্টা দীর্ঘ হওয়া এবং এরপর ঘাম দিয়ে জ্বর কমে যায়। এ ছাড়াও মাঝারি থেকে তীব্র কাঁপুনি বা শীত শীত অনুভব, মাথাধরা, অনিদ্রা, খাবারের প্রতি আগ্রহ কমে যাওয়া বা ক্ষুুধামন্দা, কোষ্ঠকাঠিন্য, বমিবমি ভাব অথবা বমি, হজমে গোলযোগ, অত্যধিক ঘাম হওয়া, খিঁচুনি, পিপাসা লাগা, ক্লান্তি বা অবসাদ অনুভব করা, মাংসপেশি, তলপেটে ব্যথা অনুভব, লাল রক্তকণিকা ধ্বংস হওয়ার কারণে অ্যানিমিয়া বা রক্তশূন্যতা, রক্তে শর্করার কম উপস্থিতিসহ বিভিন্ন উপসর্গ দেখা দেয়।

রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা : ম্যালেরিয়া সন্দেহ হলে প্রথমবার পরীক্ষায় যদি ম্যালেরিয়ার কিছু না পাওয়া যায়, তবে পর পর তিন দিন পরীক্ষাটি করা উচিত। যদি ম্যালেরিয়া শনাক্ত হয়, তাহলে দেরি না করে বা উদ্বিগ্ন না হয়ে দ্রুত চিকিৎসকের স্মরণাপন্ন হওয়া উচিত।

প্রতিরোধে করণীয় : ম্যালেরিয়া প্রতিরোধের জন্য এখন পর্যন্ত কার্যকর কোনো টিকা আবিষ্কৃত হয়নি। তবে এই রোগ সম্পূর্ণ প্রতিকার ও প্রতিরোধযোগ্য। মশাবাহিত রোগ থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকতে হলে সচেতনতা অবলম্বন প্রয়োজন। মশার কামড় থেকে দূরে থাকাই এই রোগ প্রতিরোধের উপায়। এজন্য কিছু করণীয় রয়েছে। যেমন—দিনে বা রাতে ঘুমানোর সময় অবশ্যই মশারি বা কয়েল ব্যবহার করা। দরজা-জানালায় মশক নিরোধক জাল, প্রতিরোধক ক্রিম, স্প্রে ব্যবহার করা। ঘরের আশপাশে কোথাও যেন পানি জমে মশা বংশবিস্তার না করতে পারে, সেদিকে খেয়াল রাখা বা স্থির জলাধার, জলাবদ্ধ এলাকা নিয়মিত পরিষ্কার করা। জমা পানিতে মশা ডিম পাড়ে বেশি। এসব স্থানে কীটনাশক বা কেরোসিন ছিটিয়ে দেওয়া। ম্যালেরিয়াপ্রবণ এলাকায় বেড়াতে গেলে, আগে থেকেই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া বা ম্যালেরিয়া প্রতিরোধী ওষুধ সঙ্গে রাখা। আমাদের উদ্যম, চেষ্টা ও প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করার মাধ্যমে আমরা মানব ইতিহাসের সবচেয়ে পুরনো ও ভয়ঙ্করতম এই রোগকে মোকবিলা করতে পারি।

লেখক : ডীন, মেডিসিন অনুষদ, বঙ্গবন্ধু শেখ

মুজিব মেডিকেল  বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।

সর্বশেষ খবর