রবিবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২০ ০০:০০ টা

করোনাভাইরাস ও হৃদরোগ

ডা. মাহবুবর রহমান

করোনাভাইরাস ও হৃদরোগ
যাদের হার্টের পাম্পিং ফাংশন ভালো তাদের সমস্যা কম। তারা যেসব ওষুধ নিয়মিত খেতেন তা চালু রাখতে হবে। সামান্য জ্বর, সর্দি, কাশি কিন্তু শ্বাসকষ্ট নেই তারা বাড়িতে থেকেই চিকিৎসা নেবেন। সম্ভব হলে প্রেসার, নাড়ির গতি, তাপমাত্রা পরীক্ষা করবেন

 

করোনা পরিস্থিতি বিশ্বকে এমনভাবে আঁকড়ে ধরেছে, দিন-রাত সর্বক্ষণ এটি আমাদের তাড়া করে ফিরছে। অর্থাৎ আমাদের আসল যুদ্ধের সঙ্গে সঙ্গে এক সুদূরপ্রসারী মনস্তাত্ত্বিক লড়াইও চালিয়ে যেতে হচ্ছে। যেকোনো বৈশ্বিক মহামারিতে এরূপ হওয়াটাই স্বাভাবিক। তবে দিন শেষে আমরা যতই আতঙ্কিত হই না কেন, একটা নতুন আশা নিয়ে অপেক্ষায় থাকি যেন আগামীকালটা আরেকটু ভালো হয়। এখন আসি যাদের হৃদরোগ আছে তাদের যদি করোনা ইনফেকশন হয় তাহলে কী করার আছে।

হৃদরোগীরা দু’ভাবে আক্রান্ত হতে পারেন :

১। যারা আগে থেকে হৃদরোগে ভুগছিলেন।

২। এছাড়া যারা করোনা ইনফেকশন নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে নতুন করে

হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েছেন।

যারা আগে থেকে হৃদরোগে ভুগছেন :

যাদের হৃদরোগ আছে তবে হার্টের পাম্পিং ফাংশন ভালো তাদের সমস্যা কম। তারা যেসব ওষুধ নিয়মিত খেতেন তা চালু রাখতে হবে। সামান্য জ্বর, সর্দি, কাশি কিন্তু শ্বাসকষ্ট নেই তারা বাড়িতে থেকেই চিকিৎসা নেবেন। সম্ভব হলে প্রেসার, নাড়ির গতি, তাপমাত্রা পরীক্ষা করবেন। খাদ্য স্বাভাবিক খাবেন, পানি পর্যাপ্ত খাবেন, সতেজ ফলমূল, শাকসবজি প্রচুর খাবেন। যাদের কোনো উপসর্গ নেই লকডাউন অবস্থায় ঘরের ভিতরে তিরিশ মিনিট খালি পেটে হাঁটবেন। সম্ভব হলে বাড়ির ছাদে রোদের মধ্যে হাঁটবেন। তবে সামাজিক/শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখবেন।

যদি পরিস্থিতি খারাপ হয় যেমন-জ্বর বেড়েই চলছে, শ্বাসকষ্ট হচ্ছে, প্রেসার ওঠানামা করছে তাহলে ডাক্তারকে ফোন করুন। তার নির্দেশ মতো নির্দিষ্ট হাসপাতালে যান। ডাক্তার প্রয়োজনীয় পরীক্ষা যেমন-CBC, Xray chest ইত্যাদি করে সিদ্ধান্তে আসবেন যে, আপনার হাসপাতালে ভর্তি লাগবে কিনা।

ভর্তির পর করণীয় : ভর্তির পরে চিকিৎসা পদ্ধতি পরিস্থিতি অনুযায়ী আপডেট করতে হবে। এখানে রোগীর কাজ হলো স্বাস্থ্যকর্মীদের সঙ্গে সহযোগিতা করা, তাদের নির্দেশনা মেনে চলা। যদি রোগীর প্রেসার, পালস, অক্সিজেন মাত্রা স্বাভাবিক থাকে তাহলে হাইকেয়ার/করোনা ওয়ার্ডে রেখেই চিকিৎসা করা যাবে। অবশ্যই সেটি হতে হবে করোনা নিবেদিত ওয়ার্ড যেখানে পূর্ণ পিপিই নিরাপত্তা থাকবে। রোগীর ইসিজি, সম্ভব হলে বেডসাইড ইকো, ট্রেপোনিন মাত্রা, CBC, Xray chest করে দেখা উচিত। সুযোগ থাকলে procalcitonin, CRP করা যেতে পারে। এগুলো ফলো করলে আমরা বুঝতে পারব কোন রোগীর আইসিইউ/সিসিইউর সাপোর্ট লাগতে পারে।

ডাক্তারদের করণীয় : বুকের এক্স-রে তেমন খারাপ না কিন্তু রোগী হঠাৎ হার্ট ফেইল্যুর ডেভেলপ করতে পারে। এ পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্তে দেখা গেছে, প্রায় ২০% রোগী রেসপাইরোটরি ফেইল্যুর ছাড়াই হঠাৎ হার্ট ফেইল্যুর ডেভেলপ করে। এর কতগুলো কারণ আছে : ক) করোনার প্রভাবে যে সিস্টেমিক প্রদাহ সৃষ্টি হয় তার প্রভাবে স্টেবল প্লাক (চর্বির দলা) আনস্টেবল বা ভঙ্গুর হয়ে ফেটে যেতে পারে। ফেটে গেলে কোয়াগুলেশন চক্র এবং অণুচক্রিকা সক্রিয় হয়ে করোনারি রক্তনালি ব্লক করে হার্ট অ্যাটাক করতে পারে। খ) সিস্টেমিক বা স্থানীয় প্রদাহে হার্টের মাংসপেশির প্রদাহ শুরু হতে পারে, ফলে হার্ট মাসল দুর্বল হয়ে ফেইল্যুরে চলে যেতে পারে। গ) করোনা ভাইরাস সরাসরি হার্ট মাসল দখল করে (direct invasion) তা ধ্বংস করতে পারে। ফলে রোগী সরাসরি হার্ট ফেইল্যুর ডেভেলপ করতে পারে। অর্থাৎ আপাতদৃষ্টিতে রোগীর রেসপাইরেটরি ফেইল্যুর না থাকলেও কিছু কিছু রোগী হঠাৎ করে হার্ট ফেইল্যুর ডেভেলপ করতে পারে। এ বিষয়টি চিকিৎসকদের নজরে রাখতে হবে যাতে রোগী হঠাৎ করে মৃত্যুর দিকে ধাবিত না হয়।

যেসব রোগী হার্ট অ্যাটাক নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হবেন তাদের চিকিৎসাও বিশেষ পদ্ধতিতে করতে হবে। যদি কোনো রোগীর করোনা সংক্রমণের কোনো লক্ষণ না থাকে তাকে আমরা প্রচলিত গাইডলাইন অনুযায়ী চিকিৎসা করব। কিন্তু যেসব রোগী করোনা সংক্রমিত এবং NSTEMI হবে তাদের আমরা প্রচলিত গাইডলাইনভিত্তিক চিকিৎসা দেব। অর্থাৎ LMWH-সহ অন্যান্য প্রচলিত চিকিৎসা। যারা STEMI গ্রুপে পড়বেন তাদের আমরা লাইটিক (thrombolytic) চিকিৎসা দেব। সম্ভব হলে tenectiplase দিয়ে, না পারলে streptokinase দেব। পারতপক্ষে ক্যাথল্যাবভিত্তিক অর্থাৎ জরুরি অ্যানজিওপ্লাস্টি বা রিং লাগানোর পদ্ধতিতে যাব না। পরিস্থিতি উন্নতি হলে প্রয়োজনে আমরা একমাস পরে অ্যানজিওগ্রাম / অ্যানজিওপ্লাস্টি করে চিকিৎসা বিধিবদ্ধ করব।

করোনার প্রতিকার ওষুধ কি : যেহেতু এটি একটি বিশেষ RNA virus বাহিত রোগ তাই সঠিক প্রতিকার হবে সুনির্দিষ্ট এন্টি-ভাইরাল ওষুধ প্রয়োগ করা। সত্যিকার অর্থে এখন পর্যন্ত কোনো সুনির্দিষ্ট এন্টি-ভাইরাল ওষুধ আবিষ্কৃত হয়নি। এত অল্প সময়ে সেটা সম্ভবও নয়। একটি ওষুধ বাস্তব প্রয়োগের আগে অনেকগুলো ধাপ পেরিয়ে আসতে হয়। তার জন্য পর্যাপ্ত সময় দিতে হবে। তা সত্ত্বেও কিছু কিছু HIV চিকিৎসার ওষুধ করোনা চিকিৎসায় প্রয়োগ করে কিছু কিছু ফল পাওয়া গেছে। তবে সর্বশেষ Ravipiravir নামে একটি অ্যান্টি-ভাইরাল ওষুধ বাজারে এসেছে যা অপেক্ষাকৃত বেশি কার্যকর। তবে শতভাগ কার্যকর নয়। এ ছাড়া ম্যালেরিয়ার ওষুধ ক্লোরোকুইন এবং অ্যান্টিবায়োটিক এজিথ্রোমাইসিন ওষুধ নিয়ে সীমিত কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে যার ফলাফল তেমন আশাব্যঞ্জক নয়। তবে এই বিপদের মুহূর্তে খড়কুটো আঁকড়ে ধরার মতো যা হাতের কাছে পাওয়া যাচ্ছে তাই নিয়ে আমাদের চেষ্টা করে যেতে হবে।

এখন কী করণীয় : যেহেতু করোনাভাইরাসটি একটি মনুষ্যবাহিত রোগ তাই মানুষকে পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারলেই ভাইরাসটি ছড়াতে পারবে না এবং নির্দিষ্ট সময় পরে এটি মরে যাবে। নিয়মমতো হাত ধোয়া, কফ-থুথুর স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা, অযথা সার্জিক্যাল মাস্কের পেছনে না ছোটা ইত্যাদি কয়েকটি সহজ নিয়ম মেনে চললেই আমরা নিরাপদে থাকব। বিশ্বব্যাপী করোনার যে মহাঢেউটি উঠেছে তা একদিন নিশ্চিত থেমে যাবে। চীনের উহান সেই আশাব্যঞ্জক বার্তাই আমাদের দিচ্ছে।

লেখক : কার্ডিওলজিস্ট ও সিসিইউ ইনচার্জ,

ল্যাবএইড কার্ডিয়াক হাসপাতাল, ঢাকা।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর