শনিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২০ ০০:০০ টা

কভিড-১৯ : গুরুত্ব দিতে হবে সমন্বিত কর্মসূচিতে

ড. মোহাম্মদ ফজলুর রহমান খান

কভিড-১৯ : গুরুত্ব দিতে হবে সমন্বিত কর্মসূচিতে

কোনো ওষুধ বাজারে আসার আগ পর্যন্ত, উন্নত দেশগুলোর মতো আমাদেরও মূল ফোকাস হওয়া উচিত, করোনার সংক্রমণ সর্বনিম্ন পর্যায়ে রাখার সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) কর্তৃক কভিড-১৯ নামে আখ্যায়িত ভাইরাসজনিত রোগের সংক্রমণে পুরো বিশ্ব এখন নাজেহাল। যুক্তরাষ্ট্রের জনস হপকিন্স ইউনিভার্সিটি বলছে, ২৪ এপ্রিল পর্যন্ত বিশ্বজুড়ে প্রায় ২৭ লাখ মানুষ এই ভাইরাসে সংক্রমিত হয়েছেন এবং মৃত্যুবরণ করেছেন প্রায় এক লাখ ৯৪ হাজার মানুষ। গত সাড়ে তিন মাসে রোগটি ছড়িয়েছে বিশ্বের ২০৯টি দেশ ও অঞ্চলে। বিজ্ঞানীদের নিরন্তর প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকলেও এখনো আবিষ্কৃত হয়নি এই রোগের চিকিৎসায় কার্যকর কোনো ওষুধ। মার্কিন গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) জানায়, নতুন এই ভাইরাসটির জেনেটিক গঠনে দ্রুত পরিবর্তন ঘটছে। এ অবস্থায় কভিড-১৯ এর ভ্যাকসিন বাজারে আসতে অপেক্ষা করতে হবে অন্তত এক বছর। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অত্যন্ত ছোঁয়াচে এই রোগটির বিস্তার রোধে সর্বোত্তম বিকল্প হচ্ছে, WHO কর্তৃক নির্দেশিত সামাজিক দূরত্ব মেনে চলাচল করা। কভিড নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন দেশ লকডাউন বা শাটডাউনের মতো কঠোর কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। ল্যাবরেটরি টেস্টের আওতায় আনা হয়েছে বিপুলসংখ্যক মানুষকে। আর এ সমস্ত কর্মসূচির যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে কভিড-১৯ এর উৎসস্থল উহানসহ কানাডা, সিঙ্গাপুর ও দক্ষিণ কোরিয়া পরিস্থিতি অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়েছে।

কভিড নিয়ন্ত্রণে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে দক্ষিণ কোরিয়া। কোরিয়া সরকার ১৭ মার্চের মধ্যে পাঁচ কোটি জনসংখ্যার ২ লাখ ৭০ হাজার মানুষকে অর্থাৎ প্রতি এক মিলিয়নে পাঁচ হাজার ২০০ জনকে ল্যাবরেটরি টেস্টের আওতায় আনে। তা ছাড়া কোয়ারেন্টাইন বা আইসোলেশনের নিয়ম ভঙ্গকারীদের জন্য দুই হাজার ৫০০ ডলার পর্যন্ত জরিমানার ঘোষণা দেয় সরকার। কোরীয় সরকারের এসব উদ্যোগের ফলে ১৫ এপ্রিল তারিখে নতুন করে আক্রান্তের সংখ্যা কমে দাঁড়ায় ১৮ জনে, যা ২৯ ফেব্রুয়ারি ছিল ৯৯৯ জন। এদিকে বাংলাদেশে কভিড-১৯ আক্রান্ত প্রথম রোগী শনাক্ত হয় ৮ মার্চ। কিছুটা বিলম্বে হলেও করোনা প্রতিরোধে সরকার বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করে। জনসমাগম এড়াতে প্রায় সব অনুষ্ঠান স্থগিত করে সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়। স্বাধীনতা দিবসের প্রোগ্রাম বাতিল করে ২৬ মার্চ থেকে শুরু হয় সাধারণ ছুটি। পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকার বিভিন্ন সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির সম্প্রসারণের পাশাপাশি স্বাস্থ্য, কৃষি ও শিল্প খাতে প্রায় ৯৫ হাজার কোটি টাকায় প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেন। একই সঙ্গে জরুরি সেবা ছাড়া সব ধরনের গণপরিবহন চলাচলে আরোপ করা হয় নিষেধাজ্ঞা। সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে চলাচল করতে আরোপ করা হয় রাষ্ট্রীয় বিধিনিষেধ। এসব বিধিবিধান কার্যকর করতে পুলিশের পাশাপাশি মোতায়েন করা হয়েছে প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্যদের। কিন্তু সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য বলছে, শহরের রাস্তায় লোকসমাগম এখনো আশানুরূপ মাত্রায় হ্রাস পায়নি। আর গ্রামগুলোতে চলছে রীতিমতো আড্ডা। তা ছাড়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এবং ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় করোনা প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় সচেতনতার চেয়ে বিভিন্ন কুসংস্কারের প্রাধান্য পরিলক্ষিত হচ্ছে। সংবাদ মাধ্যমের বরাতে জানা যায়, স্বাস্থ্য অধিদফতর কর্তৃক করোনা সংক্রমণের দিক থেকে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ বলে চিহ্নিত ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ জেলা অবরুদ্ধ ঘোষণা করা হলেও, প্রতিদিনই বিপুলসংখ্যক মানুষ এই জেলাগুলো থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ছেন। এই তথ্য থেকে এটা সহজেই প্রতীয়মান হয় যে, আমাদের লকডাউন কর্মসূচি যথাযথভাবে কার্যকর হচ্ছে না। এর অন্যতম কারণ হতে পারে, এখনো পর্যন্ত দেশে কভিড সংক্রমিত রোগীর সংখ্যা আমাদের জনসংখ্যা অনুপাতে নেহাতই কম। সরকার ইতিমধ্যে ঢাকার রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটসহ (আইইডিসিআর) সারা দেশে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে কভিড-১৯ শনাক্তকরণের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। আইইডিসিআর সূত্রে জানা যায়, ২৪ এপ্রিল পর্যন্ত দেশে চার হাজার ৬৮৯ জন কভিড-১৯ আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছেন, যাদের মধ্যে মৃত্যুবরণ করেছেন ১৩১ জন। এটি বাংলাদেশের কভিড সংক্রমণের বাস্তবতাকে কতটা চিত্রিত করে তা নিশ্চিত হওয়া দরকার।

আর সে লক্ষ্যে, করোনা মোকাবিলায় আমাদের দক্ষিণ কোরীয়ার মতো সমন্বিত জন সম্পৃক্ত কর্মসূচির দিকে এগোতে হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা মোতাবেক দ্রুততম সময়ে ল্যাবরেটরি টেস্টের আওতা সম্প্রসারিত করতে হবে তৃণমূল পর্যায়ে পর্যন্ত। প্রতিটি জেলায় অন্তত একটি করে এবং বিভাগীয় শহরগুলোয় একাধিক ল্যাবে কভিড-১৯ শনাক্তকরণের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রতিদিন ১৫ থেকে ২০ হাজার সম্ভাব্য সন্দেহভাজনকে ল্যাবরেটরি টেস্টের আওতায় এনে দেশের করোনা পরিস্থিতির প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে সবাইকে অবহিত করতে হবে। এছাড়া আমাদের সবাইকে নিশ্চিত করতে হবে আক্রান্তদের চিকিৎসার মানসম্মত ব্যবস্থা। চিকিৎসা কর্মীদের জন্য পর্যাপ্ত ও মানসম্মত সুরক্ষা সরঞ্জামসহ প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। আর এজন্য প্রয়োজন বিপুল পরিমাণ অর্থের। আশায় কথা হচ্ছে, কভিড মোকাবিলায় বিভিন্ন জরুরি ব্যয় মেটাতে প্রয়োজনে উন্নয়ন বাজেটের এক লাখ কোটি টাকা বরাদ্দের সময়োপযোগী পরিকল্পনার কথা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ১৮ এপ্রিল জাতীয় সংসদকে অবহিত করেন।

আর একটি ভাবনার বিষয় হচ্ছে, কভিড-১৯ সংক্রমণের পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের শিক্ষা খাতও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শ্রেণি কার্যক্রম পরিচালনা করে আপাতত এই ক্ষতি কিছুটা কমিয়ে আনা যেতে পারত। কিন্তু এক্ষেত্রে অনেক ক্ষেত্রেই শিক্ষক কর্মচারীদের প্রতিষ্ঠানে যাওয়া-আসার প্রয়োজন হবে। আসতে হবে বহু মানুষের সংস্পর্শে। সেক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টদের এবং তাদের পরিবারবর্গের কভিড সংক্রামিত হওয়ার ঝুঁকির বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিয়ে এগুতে হবে। তাছাড়া আমাদের অধিকাংশ ছাত্রছাত্রীরই তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় শ্রেণি কার্যক্রমে অংশগ্রহণের মতো প্রয়োজনীয় যান্ত্রিক সুবিধাও নেই। এই অবস্থায় সংসদ টেলিভিশনের মাধ্যমে চলমান শিক্ষা কার্যক্রম দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত সম্প্রসারিত করা যেতে পারে। অন্ততপক্ষে কার্যকর কোনো ওষুধ বাজারে আসার পূর্ব পর্যন্ত, উন্নত দেশগুলোর মতো আমাদেরও মূল ফোকাস হওয়া উচিত, করোনার সংক্রমণ সর্বনিম্ন পর্যায়ে রাখার সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা। সেক্ষেত্রে স্বল্পমেয়াদি লাভ-ক্ষতির হিসাবে আটকে না থেকে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবকে প্রাধান্য দিতে হবে। বিচ্ছিন্নভাবে তড়িঘড়ি সিদ্ধান্তের বাস্তবায়ন যেন কোনোভাবেই দীর্ঘমেয়াদি দুর্ভোগ ডেকে আনতে না পারে। সেই লক্ষ্যে ইউরোপ আমেরিকার অভিজ্ঞতা সামনে রেখে, জাতীয়ভাবে বলবত যোগ্য যে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে, এর সম্ভাব্য ফলাফল গভীরভাবে পর্যালোচনা করে দেখতে হবে। ‘জনসাধারণের ঘরে থাকা’ নিশ্চিত করতে পারলে, সীমিত সামর্থ্যরে যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে মহামারীর প্রকোপ লাঘব করা অনেকাংশই সহজতর হবে। তাই প্রয়োজনে কারফিউ জারি করে নিশ্চিত করতে হবে আমাদের ঘরে থাকা। আশা করা যায়, এ সমস্ত সমন্বিত উদ্যোগ আমাদের কভিড-১৯ সংক্রমণের দুর্বিষহ সময়কে অতিক্রম করে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের কর্মমুখর স্বপ্নীল দিনগুলোতে পৌঁছে দেবে। তাই এসব বিষয়ে আমাদের সবাইকে যথেষ্ট সচেতন হতে হবে। কিন্তু অনেকেই সচেতনতাকে অবহেলা করছেন যা মোটেও ঠিক নয়। একটা কথা অবশ্যই মনে রাখতে হবে, এসব ক্ষেত্রে প্রতিকার নয় প্রতিরোধ সর্বদা উত্তম।

লেখক : সহকারী অধ্যাপক, ময়মনসিংহ সরকারি কলেজ, ময়মনসিংহ।

সর্বশেষ খবর