বাংলাদেশের মানুষ যুগে যুগে নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে যুদ্ধ করে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে। এবার সারা বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশও যুদ্ধ করছে নতুন এক দুর্যোগের বিরুদ্ধে, যার নাম করোনাভাইরাস। এ এমন এক শত্রু যাকে চোখে দেখা যায় না; যাকে ভাইরাসটি আক্রমণ করে তার জ্ঞাতি-গুষ্টিসহ আশপাশের মানুষের জীবনও করে ফেলে বিপন্ন। মহামারী আকারে ছডিয়ে পড়া মারাত্মক রকম ছোঁয়াচে এ ভাইরাস পৃথিবী থেকে এ পর্যন্ত কেড়ে নিয়েছে প্রায় তিন লাখ মানুষের জীবন। বাংলাদেশের যে কোনো দুর্যোগ তা সে বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, অগ্নিকান্ড, ভবনধস যাই হোক ; সে সব দুর্যোগ মোকাবিলার জন্য সবার আগে ছুটে যায় জেলা প্রশাসন ও পুলিশ বাহিনী। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। তবে এবারের যুদ্ধ কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিরুদ্ধে নয়, বিন্দু কণার মতো ক্ষুদ্র এক অদৃশ্য শত্রুর বিরুদ্ধে। এই ভাইরাসের ছোঁয়ায় প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ অসুস্থ হচ্ছে ও মারা যাচ্ছে, সেহেতু মূল বিষয়টি স্বাস্থ্য সম্পর্কিত ও এ যুদ্ধের মূল ভূমিকা চিকিৎসকদের হলেও জেলা প্রশাসন ও পুলিশ বাহিনীর ভূমিকা এ ক্ষেত্রে কোনো অংশেই কম নয়।
করোনার কোনো ওষুধ বা ভ্যাকসিন এখনো আবিষ্কার হয়নি, বিজ্ঞানী ও গবেষকরা নিরন্তর কাজ করে চলেছেন ভ্যাকসিন আবিষ্কারের লক্ষ্যে। যেহেতু এটি অত্যন্ত ছোঁয়াচে রোগ যা অতি দ্রুত অন্যদের ভিতর ছড়িয়ে যায়; তাই এর সংক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) বিশ্বের সব দেশের জন্য স্বাস্থ্য বিষয়ক যে গাইড লাইন বেঁধে দিয়েছে তা বাস্তবায়নের জন্য অক্লান্তভাবে কাজ করে চলেছে প্রশাসন ও পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা। তাদের সঙ্গে আছেন সেনাবাহিনীর সদস্যরাও। আরও আছেন সাংবাদিক সমাজ। মৃত্যুভয় উপেক্ষা করে সাংবাদিকরা ছুটে যাচ্ছেন করোনার নানা তথ্য সংগ্রহের জন্য। তাদের অনুসন্ধানের কারণেই প্রকাশ পাচ্ছে বিভিন্ন সংস্থার সমন্বয়হীনতা, ত্রাণ বিতরণে অনিয়মসহ স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালনে মানুষের অনীহাসহ নানারকম ঘটনা। তাদের দেওয়া তথ্য-পরবর্তী অনেক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে সহায়ক হচ্ছে। করোনাভাইরাস কি মারাত্মক রোগ, এটি কীভাবে একজন থেকে অন্যজনে সংক্রমিত হয়, এ রোগ থেকে দূরে থাকার জন্য কীভাবে সামাজিক বা শারীরিক দূরত্ব পালন করতে হবে, মাক্স কেন পরতে হবে- এ সব বিষয়ে প্রতি জেলায় জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, উপজেলা নির্বাহী অফিসার, থানার ভারপ্রাপ্তে কর্মকর্তা (ওসি) সহ পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা প্রতিনিয়ত মানুষকে উদ্বুদ্ধ করছেন, মাইকে প্রচার করছেন, লিফলেট বিতরণ করছেন। তারা অত্যন্ত ধৈর্যের সঙ্গে রাস্তায় দাঁড়িয়ে অবুঝ মানুষকে অনুনয় বিনয় করে, গায়ে হাত বুলিয়ে তাদের নিজেদের সুরক্ষার জন্য ঘরে থাকার অনুরোধ করছেন, হাঁচি-কাশি দেওয়ার নিয়ম মানাসহ মানুষকে সামাজিক দূরত্ব মেনে চলার জন্য নানাভাবে কাজ করে চলেছেন। এ দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তারাও করোনায় আক্রান্ত হচ্ছেন, মারাও যাচ্ছেন এবং এ সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। ত্রাণ কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হচ্ছে কিনা সেটিও প্রশাসনকেই দেখতে হচ্ছে। করোনা যুদ্ধে তারা সরাসরি নেতৃত্ব দিচ্ছেন। কিন্তু তাদের এই ভূমিকা নিয়ে কোনো উৎসাহব্যঞ্জক কথার বড়ই অভাব দেখতে পাচ্ছি।
না তবে যিনি বোঝার তিনি ঠিকই বুঝেছেন। তিনি আমাদের প্রধানমন্ত্রী, তিনি সে জন্যই করোনার এ দুর্যোগকালে জেলায় জেলায় সমন্বয়কের দায়িত্ব দিয়েছেন সরকারের সচিবদের। অবশ্য সব সচিবই যে একই রকমের দক্ষ তা নয়। তবে প্রশাসন ও পুলিশ ক্যাডারের সদস্যদের মাঠ প্রশাসনে কাজ করার অভিজ্ঞতা থাকার কারণে সবারই কম-বেশি নানা রকম ক্রাইসিস ও ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট সম্পর্কে সাধারণ ধারণা থেকে থাকে।সাধারণত দেখা যায়, প্রশাসন ও পুলিশ ক্যাডারের কর্মকর্তারা যত ভালো কাজই করুক তাদের সে ভালো কাজের প্রশংসা করা হয় কম; বলা হয় তাদের দায়িত্বই তো ভালো কাজ করা। অবশ্যই মানি এ কথা। তবে এ কথাও সবাই মানবেন যে, ভালো কাজের প্রশংসা করলে মানুষের কাজ করার আগ্রহ ও উৎসাহ সাধারণত বেড়ে যায়। কয়েকদিন আগে যশোর থেকে একজন সাংবাদিক ফোনে আমার স্বামীকে বলেন, ‘স্যার আগে তো পুলিশকে গালি দিতাম; কিন্তু এখন রাস্তাঘাটে পুলিশ যেভাবে একটুও উত্তেজিত না হয়ে ঠান্ডাভাবে মানুষকে স্বাস্থ্যবিধি, সামাজিক দূরত্ব বোঝাচ্ছে তা দেখে অভিভূত হয়ে গিয়েছি, পুলিশকে এখন স্যালুট জানাচ্ছি।’ শুনে খুবই ভালো লাগল। সাংবাদিক সাহেব আরও বললেন, করোনা যুদ্ধের ফ্রন্টলাইন যোদ্ধা কেবল ডাক্তার আর স্বাস্থ্যকর্মী নয়, জেলা প্রশাসন, পুলিশ বাহিনী ও সেনাবাহিনীর সদস্যদেরও সামনের সারির যোদ্ধার সম্মান দেওয়া উচিত।
প্রসঙ্গক্রমে একটু পেছনে ফিরে যাই। আমি প্রশাসন ক্যাডারে যোগদান করি ১৯৮৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে। যোগদানের ছয় মাস পর শুরু হয় ভয়াবহ বন্যা। এক পর্যায়ে আমাদের কালেক্টরেট ভবনেও বন্যার পানি ওঠে। সে জন্য বন্যার সময়ে আমাদের অফিস স্থানান্তরিত হয় নতুন নির্মিত তথ্য অফিসে (সেটি তখনো হস্তান্তর হয়নি)। আমরা সকাল ১০টার ভিতরে নৌকা বা স্পিড বোটে করে তথ্য অফিসে হাজির হতাম, ফিরতাম রাত ১০/১১টার দিকে। জেলা প্রশাসক আমাদের কয়েকজনকে অফিসের সাচিবিক কাজের দায়িত্ব দিয়ে তিনি ও অন্য সহকর্মীরা প্রায় প্রতিদিনই নৌকা বা স্পিড বোটে বিভিন্ন দুর্গত এলাকা পরিদর্শনে যেতেন, ত্রাণ দেওয়াসহ যার যে রকম সাহায্য-সহযোগিতা দরকার তা পূরণ করার চেষ্টা করতেন। এভাবে মাথার উপরে রোদ আর নিচে বন্যার পানি- এর মধ্যে বন্যাদুর্গত মানুষের জন্য কাজ করতে গিয়ে তাদের মুখ ও শরীরের চামড়ার রং হয়ে গিয়েছিল তামাটে, তাদের চেহারার স্বাভাবিক রং ফিরতে সময় লেগেছিল ছ’মাস থেকে এক বছর। তখন তারাই ছিলেন ফ্রন্টলাইন যোদ্ধা।
গত মাসের শেষের দিকে বাগেরহাট জেলায় গিয়েছিলাম। সেখানে জেলা প্রশাসক পুলিশ সুপার ও সিভিল সার্জন সমন্বিতভাবে কাজ করছেন, একসঙ্গে সব উপজেলায় ঘুরছেন। সিভিল সার্জন চিকিৎসা বিষয়ে মূল ভূমিকা রাখলেও তাকে হাসপাতালের সুরক্ষা সরঞ্জাম দেওয়াসহ যখন যেভাবে প্রয়োজন তাকে সেভাবে সহযোগিতা করছেন জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার। ত্রাণপ্রাপ্যদের তালিকা সঠিক কিনা, ত্রাণ বিতরণে অনিয়ম হচ্ছে কিনা, মোবাইল কোর্ট পরিচালনা, প্রবাসীসহ সন্দেহভাজনদের কোয়ারেন্টাইনে রাখা, বাজার মনিটর করা, মৃত ব্যক্তিদের জানাজা পড়া, দাফন করা সবই করতে হচ্ছে মাঠ প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও জেলা প্রশাসকদের। এ জেলার কেউ অন্য জেলায় বা অন্য জেলার কেউ এ জেলায় অবাধে আসা-যাওয়া করছে কিনা সে বিষয়ে চব্বিশ ঘণ্টা মনিটর করছেন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা। গাজীপুরের পুলিশ সুপার শামসুন নাহার আমার নিকটাত্মীয়। নিরলস ও একনিষ্ঠভাবে দায়িত্ব পালন করায় আজ দেশের সচেতন প্রায় প্রতিটি মানুষই তাকে চেনেন। গাজীপুর একটি শিল্প অঞ্চল, অসংখ্য গার্মেন্ট ফ্যাক্টরি সেখানে। গার্মেন্ট খোলার ঘোষণা দেওয়ার পর দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে গার্মেন্ট কর্মীরা কাজে যোগ দেন। এদের কেউ কেউ করোনা আক্রান্ত ছিলেন। শামসুন নাহারের কাছ থেকে শুনেছি, কীভাবে সে ও তার অফিসাররা ওই সব কর্মীর নাম-পরিচয় সংগ্রহ করে বিভিন্ন গার্মেন্টে গিয়ে তাদের চিহ্নিত করে চিকিৎসা দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে। আমার উদ্দেশ প্রশাসন বা পুলিশের অহেতুক প্রশংসা করা নয়। যে কোনো দুর্যোগ মোকাবিলা করার জন্য প্রয়োজন সবার সম্মিলিত প্রয়াস, কারও একার পক্ষে তা মোটেও সম্ভব নয়। ডাক্তার, প্রশাসন, পুলিশ ও সেনাবাহিনীর পাশাপাশি নীরবে কাজ করে যাচ্ছেন আমাদের কৃষক। তারা মাঠে না গেলে আমাদের খাবারের জোগান বন্ধ হয়ে যাবে। তাই করোনার সঙ্গে যুদ্ধে তাদের অবদান কোনো অংশেই কম নয়। এছাড়া আছে নানা বেসরকারি ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, তারাও মানুষকে সচেতন করা, খাবার দেওয়াসহ নানাভাবে মানুষের দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। কারও ভূমিকাই ছোট করে দেখার কোনা অবকাশ নেই। লেখক : অতিরিক্ত সচিব (অব.)।