সোমবার, ৬ নভেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

ফুসফুস ক্যান্সার নিয়ে কিছু কথা

অঅধ্যাপক ডা. কাজী মুশতাক হোসেন

ফুসফুস ক্যান্সার নিয়ে কিছু কথা

বিশ্বে নভেম্বর মাস ফুসফুস ক্যান্সার সচেতনতা মাস হিসেবে পালিত হয়। বর্তমানে বিশ্বে প্রধান ক্যান্সার এই ফুসফুসের ক্যান্সার এবং ক্যান্সারজনিত মৃত্যুর সংখ্যায়ও এটি সবচেয়ে বেশি। সাধারণত একটু বয়স্কদের মধ্যে অর্থাৎ গড়ে ৭০ বছর বয়সে এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি তবে অল্প বয়সেও হতে পারে। উত্তর আমেরিকা এবং পূর্ব ইউরোপীয় এলাকায় এর প্রাদুর্ভাব বেশি হলেও পৃথিবীর সব অঞ্চলেই এই রোগ দেখা যায়। ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ অন ক্যান্সার (IARC)-এর তথ্য অনুযায়ী পৃথিবীতে প্রতি ৫ জনে ১ জন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়। পুরুষদের প্রতি ৮ জনে ১ জন এবং মহিলাদের প্রতি ১১ জনে ১ জন মৃত্যুবরণ করছেন। অনুমান করা যায় যে বর্তমানে বিশ্বে প্রায় ৫০ মিলিয়ন মানুষ ক্যান্সারে আক্রান্ত। ২০২০ সালে নতুন আক্রান্ত ১৯,৩ মিলিয়ন এবং মারা গেছেন ১০ মিলিয়ন মানুষ। ২০৪০ সাল নাগাদ ২৯.৫ মিলিয়ন মানুষ ক্যান্সারে আক্রান্ত হবেন এবং ১৬.৪ মিলিয়ন মানুষ ক্যান্সারে মৃত্যুবরণ করবেন।

যদিও অন্যান্য ক্যান্সারের মতো সঠিক কারণ অজানা কিন্তু ধূমপান এই রোগের প্রধান কারণগুলোর একটি। যারা নিজেরা ধূমপান করেন এবং যারা ধূমপায়ীর কাছাকাছি থেকে পরোক্ষভাবে ধূমপান করেন প্রত্যেকেই ঝুঁকিতে রয়েছেন। এছাড়া যারা এসবেস্টস বা এ জাতীয় ডাস্ট তৈরিকারী কলকারখানায় কাজ করেন বা বিভিন্ন খনিতে কাজ করেন বা রেডন নামের ভারী গ্যাসের সংস্পর্শে দীর্ঘ সময় থাকেন বা বায়ু, পানি অর্থাৎ পরিবেশদূষণের শিকার তারা প্রত্যেকেই এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছেন। অনেকে ইলেকট্রনিক সিগারেট বা ই-সিগারেট খান বা ভেপ নেন যা সমান ক্ষতিকারক। ই-সিগারেটে অ্যাক্রোলিন নামের একটি কেমিক্যাল থাকে যা আগাছা নিধনকারী। এ বিষ ধোঁয়ার সাহায্যে শরীরে প্রবেশ করে ক্যান্সারসহ নানা অসুখ হতে পারে।

সাধারণত কাশি, কাশির সঙ্গে রক্ত যাওয়া, শ্বাসকষ্ট বা বুকে ব্যথা এবং দুর্বলতা এ রোগের লক্ষণ হিসেবে দেখা দিতে পারে। এ ছাড়া ক্যান্সার শরীরের অন্যান্য অঙ্গে ছড়িয়ে পড়লে সেই অঙ্গে লক্ষণ দেখা দেয়। যেমন জন্ডিস বা অল্প আঘাতেই পা বা হাত ভেঙে যেতে পারে; মাথাব্যথা, চোখে দেখতে অসুবিধা বা বমি হতে পারে। এছাড়াও শরীরে অনেক রকম লক্ষণ দেখা দিতে পারে। যদি জ্বর কাশি বা উপরের কোনো সমস্যা দীর্ঘস্থায়ী হয় তবে সঙ্গে সঙ্গেই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। এই রোগ নির্ণয়ের জন্য কিছু নির্দিষ্ট পরীক্ষা করতে হয়। প্রধানত সিরিঞ্জের সাহায্যে ফুসফুস থেকে টিস্যু নিয়ে পরীক্ষা করে ক্যান্সারের বিভিন্ন ধরন নির্ণয় করা হয়। বিভিন্ন ধরনের ফুসফুস ক্যান্সারের লক্ষণ এবং চিকিৎসার মধ্যেও পার্থক্য রয়েছে। এ জন্য এই টিস্যু ডায়াগনোসিস খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। এছাড়া রক্ত পরীক্ষা এবং রোগটি শরীরের অন্যত্র ছড়িয়ে পড়েছে কিনা তা দেখার জন্য কিছু পরীক্ষা করতে হয়। চিকিৎসা দেয়ার আগে লিভার, কিডনি এবং হার্ট ভালো আছে কিনা সেটিও দেখে নিতে হয়। এভাবে কিছু পরীক্ষার সাহায্যে নির্ণয় করা হয় রোগের বিস্তার বা স্টেজ। অর্থাৎ এটি কি ফুসফুসের মধ্যেই আছে নাকি এর বাইরে ছড়িয়ে পড়েছে। কেননা এই স্টেজের ওপর নির্ভর করে চিকিৎসা। একেবারেই যদি প্রাথমিক পর্যায়ে থাকে সে ক্ষেত্রে শুধু সার্জারি করেই এ রোগের চিকিৎসা করা যেতে পারে। এরকম ক্ষেত্রে ৫ বছর বেঁচে থাকার সম্ভাবনা প্রায় ৭০ শতাংশ।  আর যদি আরেকটু বিস্তৃত হয় তাহলে আগে কেমোথেরাপি দিয়ে টিউমারটিকে ছোট করে নিতে হয় এবং তার পড়ে সার্জারি এবং রেডিওথেরাপি দিয়ে চিকিৎসা করতে হয়। এ সব ক্ষেত্রে ৫ বছর বেঁচে থাকার সম্ভাবনা কমে ৫০ থেকে ৩০ ভাগে নেমে আসে। আর যদি শরীরের অন্যত্র ছড়িয়ে পড়ে সেক্ষেত্রে চিকিৎসার পদ্ধতিটাই অন্যরকম হয়ে যায়। তখন ভালো হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা কমে ১৫ ভাগে নেমে আসে। দেখা যায় এ অবস্থায় রোগী চিকিৎসা নেওয়ার মতো সবল থাকেন না। চিকিৎসার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সহ্য করতে না পেরে বরং আরও অসুস্থ হয়ে পড়তে পারেন। তাই এই স্টেজে রোগীকে উপশমকারী বা কষ্ট কমানোর জন্য  চিকিৎসা দেওয়া হয়, যাকে প্যালিয়েটিভ চিকিৎসা বলা হয়। এভাবে চিকিৎসা নেওয়ার পর রোগীকে নিয়ম মতো ফলোআপ করতে হবে, যেন রোগটি আবার ফিরে আসার সঙ্গে সঙ্গেই নির্ণয় করা যায় এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসা নেওয়া যায়। বর্তমানে নতুন নতুন অনেক ওষুধ আবিষ্কৃত হয়েছে যেমন টার্গেটেড থেরাপি, ইমিউন থেরাপি এবং নিত্যনতুন ওষুধ আসছে। ফলে আশা করা যায়, অদূর ভবিষ্যতে আমরা এই মরণব্যাধিকে জয় করতে পারব। তাই এর আগেই আমাদের অবশ্য সতর্ক থাকতে হবে এবং এই রোগ থেকে রক্ষা পাওয়ার চেষ্টা করতে হবে। আর তার প্রধান উপায় হলো ধূমপান না করা এবং অন্যকে এ থেকে বিরত রাখা। হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী ধূমপান কমিয়ে ফেলার কারণে পশ্চিমা দেশগুলোতে ফুসফুস ক্যান্সারের প্রকোপ কমতে শুরু করেছে। তাই সবাই মিলে ধূমপান বর্জনের আন্দোলন গড়ে তুলুন। প্রধান কারণ ধূমপান বর্জনই সহজ কাজ। এছাড়া পরিবেশ রক্ষা করা, ব্যায়াম করা, স্ক্রিনিং টেস্ট করা, ভ্যাকসিন নেওয়া এবং সর্বোপরি নিজেকে এবং সমাজকে সচেতন করার মাধ্যমে আমরা এ রোগসহ অনেক রোগ থেকেই দূরে থাকতে পারি। আমরা লক্ষ্য করেছি, পাশ্চাত্যে যেখানে ধূমপায়ীর হার কমছে সেখানে আমাদের দেশে এর হার বাড়ছে। এছাড়া স্কুল-কলেজের পাঠ্যসূচিতেও ক্যান্সার সচেতনতার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা দরকার। মনে রাখতে হবে ক্যান্সার চিকিৎসা ব্যয়বহুল এবং দীর্ঘমেয়াদি। চিকিৎসা নিয়ে ভালো হয়ে গেলেও আবার তা ফিরে আসতে পারে। পরিবার, সমাজ এবং দেশের অর্থনীতিতে এর বিরাট রকমের নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে। সচেতন হোন, অন্যকে সচেতন করুন সবাই মিলে সুস্থ থাকুন।

লেখক : সাবেক পরিচালক, জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইন্সটিটিউট এবং সিনিয়র কনসালট্যান্ট, ল্যাবএইড ক্যান্সার হসপিটাল।

সর্বশেষ খবর