বুধবার, ২৭ ডিসেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

বুকে ব্যথা : বিলম্বে বিপদ সংকেত

ডায়াবেটিক রোগীর স্নায়ু দুর্বল বা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় অনেক সময় রোগী ব্যথা অনুভব করেন না। তাই হার্ট অ্যাটাকের ব্যথাও ঠিকমত বুঝতে পারেন না

বুকে ব্যথা : বিলম্বে বিপদ সংকেত

বয়স ৩০ হলে বুকে বা বুকের আশপাশে যে কোনো ধরনের ব্যথা বা অস্বস্তি হলে সেটা প্রথমে ধরে নিতে হবে হার্টের ব্যথা। কারণ হার্টের ব্যথা অন্য কোনো  ব্যথা থেকে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এ জন্য গুরুত্বপূর্ণ যে, হার্টের সমস্যায় মৃত্যু ঝুঁকি অনেক বেশি এবং হার্টের রোগের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো দ্রুত চিকিৎসা না নিলে হার্টের মাংসপেশি দ্রুত ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

ঘটনা-১ : আজাদ সাহেবের (ছদ্ম নাম) বয়স সাঁইত্রিশ। অফিসে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এমন সময় বুকে ব্যথা অনুভব করলেন। কী করা উচিত বুঝে ওঠার আগেই ঘরের মেঝেতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলেন। তাঁকে দ্রুত হাসপাতালের জরুরি বিভাগে আনা হলো। সেখানে একটি ইসিজি করেই ডিউটিরত ডাক্তার ফোন দিয়ে বললেন- ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক! আমি ৩০০ মিগ্রাম ডিসপ্রিন (এসপিরিন), ১৮০ মিগ্রাম টিকারেল এবং ৮০ মিগ্রাম অ্যাটোভা খাইয়ে দিয়ে দ্রুত সিসিইউ তে পাঠাতে বললাম। এদিকে এ্যানজিওগ্রাম করার জন্য ক্যাথল্যাব টিমকে প্রস্তুত হতে বললাম। রোগী সিসিইউতে প্রবেশ করা মাত্র দেখি বুকে তীব্র ব্যথা, শরীর ঘর্মাক্ত, প্রেসার কম, পালসের গতি বেশি। আমি পুরো বিষয়টি তাঁর স্ত্রীকে বলা মাত্র তিনি বললেন, ‘সবচেয়ে যা ভাল সেটা করুন, আমাদের কোন আপত্তি নেই। ওকে বাঁচান প্লিজ!’ অনতিবিলম্বে আজাদ সাহেবকে ক্যাথল্যাবে নিয়ে গেলাম। দ্রুত এনজিওগ্রাম করে দেখি তাঁর সবচেয়ে বড় রক্তনালি (LAD) শতভাগ বন্ধ হয়ে আছে। আমি তৎক্ষণাৎ সেটি খুলে দিয়ে যাতে আবার বন্ধ না হতে পারে সেজন্য একটি রিং (Stent) বসিয়ে দিলাম। সঙ্গে সঙ্গে আজাদ সাহেবের বুকের ব্যথা কমে গেল, ইসিজি স্বাভাবিক হয়ে এলো, প্রেসার বাড়ল, পালস সীমার ভিতর চলে এলো। পুরো প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হতে ২০ মিনিট সময় ব্যয় হলো। সিসিইউতে একদিন রেখে মোট তিন দিনের মাথায় তাঁকে ছুটি দিয়ে দেওয়া হলো। পরবর্তী ফলো আপে দেখা গেল তার হার্টেরপাম্পিং সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। পুরোপুরি উপসর্গমুক্ত। গত সাত বছর হয়ে গেল তিনি নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন। ওষুধ নিয়মিত খাচ্ছেন।

ঘটনা ২ : আবুল কালাম। বয়স ষাট। ডায়াবেটিক রোগী। রাত ১০টা থেকে হঠাৎ শ্বাসকষ্ট। বুকে কোনো ব্যথা নেই। পরিবারের লোকজন ভাবল অ্যাজমা অ্যাটাক হয়েছে। তারা কালাম সাহেবকে নিয়ে রাত ১টার দিকে জরুরি বিভাগে নিয়ে এলেন। ইসিজি করা মাত্র দেখা গেল হার্ট অ্যাটাক। রোগীকে তৎক্ষণাৎ ভর্তি হতে বলা হলো। কিন্তু রোগী বা পরিবার রাজি না। তাঁদের বক্তব্য “ছাছের কষ্ট অইছে, ছাছের ওছুদ দ্যান!” যাই হোক অনেক বুঝাবার পরে এবং নেবুলাইজার দেওয়ার পরেও যখন দেখল শ্বাসকষ্ট কমছে না, তখন বাধ্য হয়েই কালাম সাহেবকে সিসিইউ তে ভর্তি করা হলো। ডিউটিরত কার্ডিওলজিস্ট আমাকে রাত দেড়টায় কালাম সাহেবের খবরটি দিলেন। বললাম যদি তারা রাজি থাকেন তাহলে জরুরি ব্লক অপসারণ (primary angioplasty) করা যেতে পারে। কিন্তু কোনো মতে রোগী বা তার পরিবার রাজি হলেন না। বাধ্য হয়েই দ্বিতীয় অপশন streptokinase  দিতে বললাম। কিন্তু ওষুধ ব্লক অপসারণে ব্যর্থ হলো। সকালের দিকে রোগীর পরিস্থিতি দ্রুত খারাপ হতে শুরু করল। প্রেসার কমে গেল, পালস কমে গেল, কিডনির কার্যকারিতা কমল। রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা কমে যাওয়ায় বাধ্য

হয়েই লাইফ সাপোর্টে দেওয়া হলো। দুদিন লড়াই করে রোগীর লোকজন হৃদস্পন্দনহীন  আবুল কালামকে নিয়ে বাড়ি ফিরল।

শিক্ষণীয় বিষয়সমূহ: ১। ৩০ বছর বয়সের কোনো ব্যক্তির বুকে বা বুকের আশপাশে কোনো ব্যথা হলে অবশ্যই গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে। ২। ডায়াবেটিস রোগীর স্নায়ু দুর্বল বা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় অনেক সময় রোগী ব্যথা অনুভব করেন না। তাই হার্ট অ্যাটাকের ব্যথাও ঠিকমতো বুঝতে পারেন না। ৩। বুকে ব্যথা অনুভব না করলেও রোগী বুকে অস্বস্তি বা চাপ বা শ্বাসকষ্ট অনুভব করতে পারেন। সেটাকে অ্যাজমার এ্যাটাক হিসেবে ভুল বুঝলে চলবে  না।  ৪। যে কোনো ধরনের হঠাৎ তীব্র অসুস্থতা বোধ করলে দ্রুত হাসপাতালে যেতে হবে। ইসিজি করে ডাক্তার দিয়ে নিশ্চিত করতে হবে। ৫। জরুরি অ্যানজিওপ্লাস্টি হলো হার্ট অ্যাটাকের আধুনিক চিকিৎসা। এতে মৃত্যুঝুঁকি কমে এবং পাম্পিং ক্ষমতা বজায় থাকে।  সম্ভব হলে এটি প্রয়োগ করতে হবে।

-ডা. মাহবুবর রহমান, সিনিয়র কার্ডিওলজিস্ট, ল্যাবএইড কার্ডিয়াক হসপিটাল, ঢাকা।

সর্বশেষ খবর