মঙ্গলবার, ১৬ জুলাই, ২০২৪ ০০:০০ টা

রিকেটস : বাড়ন্ত শিশুর হাড়ের রোগ

রিকেটস : বাড়ন্ত শিশুর হাড়ের রোগ

রিকেট কী : বাড়ন্ত হাড়ের গঠনগত ত্রুটি, যা খনিজ পদার্থ ক্যালসিয়াম এবং ভিটামিন ‘ডি’-এর অভাবে হয়। ফলে শিশুর হাড় বেঁকে যায়, হাড়ে ব্যথা হয়, পায়ের বিকৃতি দেখা যায়; এমনকি হাড় নরম হয়ে ভেঙে যেতে পারে। মূলত শারীরিক বৃদ্ধি বাধাপ্রাপ্ত হয় শিশুটির।

কারণ : মূলত দেহে ক্যালসিয়াম এবং ভিটামিন ‘ডি’-এর অভাব এর মূল কারণ। পাশাপাশি ফসফরাসের অভাবে এই রোগ হতে দেখা যায়। সূর্যালোকের অভাব, খাবারে ভিটামিন ‘ডি’-এর ঘাটতি, খাদ্যজনিত ভিটামিন ‘ডি’ শোষণ হ্রাস পাওয়া এই রোগকে ত্বরান্বিত করে। পাশাপাশি লিভার ও কিডনির রোগের কারণে এই রোগ হতে পারে। বিভিন্ন ওষুধের কারণে বিশেষ করে খিঁচুনির ওষুধ দিলেই এর প্রতিক্রিয়ায় শিশুরা রিকেটস রোগে আক্রান্ত হতে পারে।

কীভাবে হয় : সূর্যের আলোর উপস্থিতিতে দেহে ভিটামিন ‘ডি’ তৈরি হয়। পাশাপাশি বিভিন্ন খাবার থেকে যেমন তৈলাক্ত মাছ, মাছের তেল, মাখন, ডিম ইত্যাদিতে ভিটামিন-‘ডি’ পাওয়া যায়। রক্তে ভিটামিন-‘ডি’ শোষণের পর লিভার এবং কিডনিতে বিভিন্ন জৈব রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে ভিটামিন-‘ডি’ পরিণত অবস্থায় পৌঁছায়। রক্তে কোনো কারণে ক্যালসিয়ামের মাত্রা কমে গেলে এর পরিণতি ভিটামিন-‘ডি’ খাদ্যনালি থেকে রক্তে ক্যালসিয়ামের শোষণ বৃদ্ধি করে এবং হাড়ে থাকা ক্যালসিয়াম শোষণ করে রক্তে নিয়ে আসে। ফলে হাড়ে ক্যালসিয়ামের ঘাটতিতে হাড় নরম হয়ে যায়। এ সময় শিশুর শারীরিক বৃদ্ধিতে ওই নরম হাড় ভার বহন করতে না পেরে ধীরে ধীরে বেঁকে যেতে দেখা যায়। এভাবেই রিকেটস রোগের সৃষ্টি হয়।

আমাদের দেশের শিশুদের রিকেটেসের প্রধান কারণ হলো খাবারে ক্যালসিয়ামের ঘাটতি।

লক্ষণ : প্রথম বছর শেষ না হতে এবং দ্বিতীয় বছরের শুরুতেই শিশুর এই রোগের লক্ষণগুলো দেখা যায়। একই রোগে আক্রান্ত মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানো হয় এমন শিশুদের দুই থেকে তিন মাসের মধ্যে যে লক্ষণগুলো দেখা যেতে পারে- ১. খুলির হাড়গুলো নরম হয়ে যাওয়া। ২. মাথার খুলির আকৃতি চারকোনা বাক্সের মতো হওয়া।

৩. দুধ দাঁত উঠতে দেরি হওয়া, দাঁত ক্ষয়প্রাপ্ত হওয়া। ৪. বুকের পাঁজরের হাড়গুলো বুকের সামনে বৃদ্ধি পাওয়া। ৫. বুকের খাঁচা আবার পরিবর্তিত হওয়া- কবুতরের বুকের মতো।

৬. কবজি ও গোড়ালির হাড়গুলো বেড়ে যাওয়া। ৭. হাঁটু থেকে গোড়ালি পর্যন্ত পা সামনের দিকে বেঁকে যাওয়া। ৮. হাঁটুর কাছ থেকে দুই পা দুই দিকে বেঁকে যাওয়া।

৯. পা ধনুকের মতো বেঁকে যাওয়া। ১০. দুই পা একই সঙ্গে একই দিকে বেঁকে যাওয়া।

১১. শরীরের উচ্চতা স্বাভাবিকের চেয়ে কম হলে মাংসপেশি শুকিয়ে গিয়ে দুর্বল হয়ে যাওয়া। ১২. টিটানিতে আক্রান্ত হওয়া।

রোগ শনাক্তকরণ : রোগের লক্ষণগুলো চিহ্নিত করে, হাড়ের এক্স-রে করে ও রক্ত পরীক্ষা করে রোগটি শনাক্ত করা যায়।

জটিলতা : শ্বাসনালির প্রদাহ, ব্রংকাইটিস নিউমোনিয়া, আয়রন ঘাটতিতে রক্তস্বল্পতা, শারীরিক উচ্চতা স্বাভাবিকের চেয়ে কমে যাওয়া, টিটানি রোগে আক্রান্ত হওয়া (রক্তে ক্যালসিয়াম কমে যাওয়া, হাড় নরম হয়ে গিয়ে ভেঙে যাওয়া প্রভৃতি জটিলতা হতে পারে।

চিকিৎসা : শিশুর খাবারের তালিকায় পরিবর্তন আনতে হবে। দৈনন্দিন খাবারে ক্যালসিয়াম-সমৃদ্ধ খাবার দিতে হবে। বিভিন্ন রকম সবজি যেমন- ঢ্যাঁড়শ, কুমড়া বিভিন্ন রকম শাক এবং কাঁটাওয়ালা ছোট মাছ খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। দুধ অথবা দুধ জাতীয় খাবার দৈনিক ৬০০ মিলি লিটার খাওয়াতে পারলে ক্যালসিয়ামের দৈনিক চাহিদা পুরোপুরি মেটানো যাবে। দৈনিক ক্যালসিয়াম-সমৃদ্ধ খাবার এবং পাশাপাশি ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট খাওয়াতে হবে। এ ছাড়া ভিটামিন ‘ডি’-এর ব্যবহার ও রিকেট রোগের চিকিৎসায় প্রচলিত রয়েছে। শিশুকে নিয়মিত সকাল ১০টা থেকে বেলা ৩টার মধ্যে রৌদ্রে ৩০ মিনিট রাখলে রিকেটস রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব। পুষ্টি চিকিৎসার সঙ্গে ভিটামিন ডি এবং ক্যালসিয়াম ব্যবহারের ফলে ৭৫ ভাগ শিশুই সুস্থ হয়। তবে বয়স ছয় বছরের বেশি হলে এবং পা বেঁকে যাওয়ার পরিমাণ ১৫ থেকে ৩০ ডিগ্রি হলে ব্রেস চিকিৎসা, আবার কখনো কখনো শল্য চিকিৎসার প্রয়োজন পড়ে। রিকেট রোগ প্রতিরোধে প্রধানত খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের সচেষ্ট হতে হবে। গর্ভবতী ও প্রসূতি মাকে ভিটামিন ‘ডি’ দিতে হবে। শিশুদের দুধ ও খাবারে ভিটামিন ‘ডি’ সংযুক্ত করতে হবে। স্বল্প ওজনের অপরিণত শিশুর জন্মের পর দুই সপ্তাহ থেকে ভিটামিন ‘ডি’ দিতে হবে।

-অধ্যাপক ডা. ইমনুল ইসলাম ইমন, শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ, আলোক হেলথ কেয়ার লিমিটেড, মিরপুর-১০, ঢাকা।

সর্বশেষ খবর