বিদেশি সোনার অলংকারে সয়লাব দেশের জুয়েলারি বাজার। এতে কমে গেছে দেশি অলংকারের চাহিদা। ফলে কর্মহীন হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন হাজার হাজার কারিগর ও শ্রমিক। কাজের অভাবে পেশা বদল করেছেন অনেক কারিগর। কারিগর ও শ্রমিকদের স্বার্থে ব্যাগেজ রুলের আওতায় বিদেশি অলংকার আনার প্রথা বাতিলের দাবি জানিয়েছেন কারিগর ও শ্রমিকরা। তারা বলছেন, দেশে বিপুল সংখ্যক আন্তর্জাতিক মানের দক্ষ কারিগর রয়েছেন। বর্তমানে ২৫ হাজার স্বর্ণের দোকান এবং এই খাতে যুক্ত রয়েছেন ৪৪ লাখ মানুষ। সঠিক দিকনির্দেশনা এবং প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হলে আগামী পাঁচ বছরে অন্তত ২ কোটি মানুষ এই খাতের সঙ্গে সংযুক্ত হতে পারবেন। টিকে থাকবেন দেশের ঐতিহ্যবাহী জুয়েলারি শিল্পের কারিগর ও শ্রমিকরা। কারণ ‘একমাত্র এ উপমহাদেশেই গহনার কাজ এত নিখুঁতভাবে হাতে করা হয়। বাংলাদেশের শিল্পীদের হাতের কাজের কদর বিশ্বজোড়া। মেশিনে আপনি যত যাই করুন, নিখুঁত ডিজাইন করতে দক্ষ হাতের বিকল্প নেই। দেশে এমন অনেক ডিজাইনার আছেন, যারা ভারতীয় বা অন্যান্য দেশের ডিজাইনারদের মতো ভালো, ক্ষেত্রবিশেষে তাদের থেকেও ভালো কাজ করে থাকেন।’ রাজধানীর পুরান ঢাকার তাঁতিবাজার ঘুরে দেখা যায়, বাংলাদেশেই আছেন বিশ্বমানের কারিগর। সোনার গহনা গড়ার কাজে সিদ্ধহস্ত এমন অনেক কারিগর বাস করেন এই তাঁতিবাজারেই। এখানে অনেক কারিগর আছেন যাদের কাজের খ্যাতি বিশ্বজোড়া। এদের মধ্যে অনেক কারিগরই প্রায় ৫০ বছর ধরে গহনা গড়ার কাজ করছেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা স্বর্ণশিল্পী শ্রমিক সংঘের সাধারণ সম্পাদক দীনেশ পাল বলেন, তাঁতিবাজারের সোনার দোকানগুলোতে অনেক ভালো কারিগর কাজ করেন। নতুন কিছু করার চেষ্টা আছে সবার মধ্যেই। আমাদের দেশের মানুষ আগে মনে করত দুবাই, ভারত, সিঙ্গাপুর, সৌদি আরবের সোনার অলংকারের ডিজাইন ও মান বাংলাদেশের থেকে ভালো। অনেকেই ওইসব দেশ থেকে গহনা কিনত। আমাদের কারিগররা তখন জানিয়ে দিলেন, দেশেই বিশ্বমানের ডিজাইনের গহনা তৈরি করা সম্ভব। বর্তমানে তারা করছেনও। কিন্তু দেশের বাজার বিদেশি অলংকারে সয়লাব হওয়ার কারণে দেশি অলংকারের চাহিদা বাড়ছে না।
তিনি আরও বলেন, এতে অনেক কারিগর ও শ্রমিক মানবেতর জীবনযাপন করছেন। জীবিকার তাগিদে অনেক শ্রমিক পেশাও বদল করেছেন। বর্তমানে যারা সোনার কারিগর আছেন তারাও কাজের সময় এক প্রকার কষ্টে জীবন কাটান। আমাদের এমন অনেক রাত গেছে কাজ করতে করতে কাঠের মোড়ার ওপর মাথা দিয়ে ঘুমিয়ে গেছি। আমাদের নির্দিষ্ট কোনো বেতন নেই। গহনাভিত্তিক আয় হয়। এতে অনেক কারিগরই কাক্সিক্ষত মজুরি পান না।’
সরকার চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ব্যাগেজ রুলস বিধিমালা অনুযায়ী ১১৭ গ্রাম ওজনের সোনার বার আনার সুযোগ দিয়েছে। এ জন্য ৪০ হাজার টাকা শুল্ক কর দিতে হয়। তবে ১০০ গ্রাম অলংকার আনার ক্ষেত্রে কোনো বিধিনিষেধ নেই। ফলে একটি চক্র বিদেশফেরত যাত্রীদের এই সুযোগ নিয়ে বিদেশি অলংকার দেশে এনে বিক্রি করছে। এতে দেশে তৈরি সোনার অলংকারের চাহিদা কমে যাচ্ছে। বেকার হচ্ছেন কারিগর ও শ্রমিকরা। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশন-বাজুসের মুখপাত্র ও কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য আনোয়ার হোসেন বলেন, হুন্ডি বন্ধ করতে হলে সোনা চোরাচালান বন্ধ করতে হবে। এ জন্য সোনা চোরাচালানের সঙ্গে জড়িতদের ধরতে চিরুনি অভিযান পরিচালনা করতে হবে সরকারকে। ব্যাগেজ রুলের অপব্যবহার বন্ধ করতে হবে। দেশে বড় বড় আকারের বিদেশি সোনা এবং হীরার অলংকার কোথা থেকে কীভাবে আসে, এই সোনার বৈধ উৎস কী, কোনো বৈধ কাগজপত্র আছে কি না, তা খতিয়ে দেখতে হবে। বাংলাদেশ জুয়েরার্স অ্যাসোসিয়েশন-বাজুসের প্রাথমিক ধারণা- প্রবাসী শ্রমিকদের রক্ত-ঘামে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রার অপব্যবহার করে প্রতিদিন সারা দেশের জল, স্থল ও আকাশ পথে কমপক্ষে প্রায় ২৫০ কোটি টাকার অবৈধ সোনার অলংকার, সোনার বার, ব্যবহৃত পুরনো জুয়েলারি (যা ভাঙ্গারি হিসেবে বিবেচিত হয়) ও হীরার অলংকার (ডায়মন্ড জুয়েলারি) চোরাচালানের মাধ্যমে বাংলাদেশে আসছে, যা ৩৬৫ দিন বা এক বছর শেষে দাঁড়ায় প্রায় ৯১ হাজার ২৫০ কোটি টাকা বা তার অধিক। এর মধ্যে প্রতিদিন গড়ে ২২০ কোটি টাকার সোনা ও সোনার অলংকার এবং ৩০ কোটি টাকার হীরা ও হীরার অলংকার বাংলাদেশে আসছে। সে হিসাবে ৩৬৫ দিন বা এক বছরে ৮০ হাজার ৩০০ কোটি টাকার সোনা ও ১০ হাজার ৯৫০ কোটি টাকার হীরা অবৈধভাবে বাংলাদেশে আসছে। এই পুরো টাকাটাই হুন্ডির মাধ্যমে সোনা ও হীরা চোরাকারবারিরা বিদেশে পাচার করে থাকে। ফলে সরকার রেমিট্যান্স হারাচ্ছে এবং সোনা ও হীরা চোরাকারবারিরা তাদের অবৈধ অর্থ বিদেশে পাচার করে যাচ্ছে।