৫ আগস্ট, ২০২১ ১৩:১৪

গত দুই বছরে জম্মু-কাশ্মীরে যে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটেছে

জাভেদ বেগ

গত দুই বছরে জম্মু-কাশ্মীরে যে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটেছে

প্রতীকী ছবি

আজ ৫ আগস্ট, ভারতশাসিত জম্মু-কাশ্মীরের জন্য একটি ঐতিহাসিক দিন। গত দুই বছর আগে এই দিন অর্থাৎ  ২০১৯ সালের ৫ আগস্ট সংবিধানের ৩৭০ ধারা ও ৩৫-এ ধারা বাতিল করে ভারত সরকার। এর মধ্য দিয়ে জম্মু-কাশ্মীরের বিশেষ সাংবিধানিক মর্যাদা রোহিত করা হয়, যা ওই অঞ্চলে একটি নতুন যুগের সূচনা করে।

ভারত সরকারের এই পদক্ষেপ জম্মু-কাশ্মীরকে রাজ্য থেকে একটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে এবং লাদাখ অঞ্চলকে পূর্ববর্তী রাজ্যের বাকি অংশ থেকে বিভক্ত করা হয়। এরপর অনেকের মনেই একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং সুস্পষ্ট প্রশ্ন জাগে, এটি কি কাশ্মীর এবং এর জনগণের কল্যাণ বয়ে এনেছে নাকি পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে?

যখন ভারত সরকার এই পদক্ষেপ নিয়েছিল, তখন কাশ্মীরের অধিকাংশ স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরা সেখানে হত্যা, সহিংসতা, পাথর নিক্ষেপ, ধর্মঘট, রক্তপাত এবং বিক্ষোভ বেড়ে যাওয়ার পূর্বাভাস দিয়েছিলেন, যা কাশ্মীর উপত্যকাকে গ্রাস করতে পারে, যেমন সবশেষ ২০১৬ সালে বুরহান ওয়ানি হত্যার পর ঘটেছিল।

কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে সেগুলোর কোনওটিই ঘটেনি। গত দুই বছরে বড় কোনও ঘটনাই ঘটেনি। তাহলে, কি কাশ্মীরিরা ভারতের সংবিধানের ৩৭০ ও ৩৫-এ অনুচ্ছেদ বাতিলকে আনন্দের সাথে গ্রহণ করেছিল?

এমন একটি জটিল প্রশ্নের উত্তর সত্যিই সাদামাটাভাবে দেওয়া যাবে না। কিন্তু কাশ্মীর উপত্যকায় গত দুই বছরে যে সাধারণ সামাজিক চিত্র ফুটে উঠেছে তা এবং সেখানকার মানুষই এর মোক্ষম জবাব দিতে পারে। 

গত দুই বছরে কাশ্মীর উপত্যকায় যে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনগুলো ঘটেছে তার মধ্যে একটি হল সেখানকার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে প্রান্তিক জাতি ও সম্প্রদায় ও সম্প্রদায়ের ক্ষমতায়নের সাধারণ অনুভূতির উদ্ভব। তাদের আচরণের আমুল পরিবর্তন ঘটেছে। কিছুটা এভাবে বলা যায় যে কাশ্মীর উপত্যকার লোকেরা এমন আচরণ আগে করেনি। তাদের অতীত ইতিহাস ছিল সহিংসতার ইতিহাস।

এটা বোঝা গুরুত্বপূর্ণ যে, ধনী কাশ্মীরি পন্ডিত ব্রাহ্মণ ধর্মান্তরিত উচ্চবর্ণের কাশ্মীরি মুসলমানদের একটি ক্ষুদ্র অভিজাত, সৈয়দ এবং মাল্লা কাশ্মীরি মুসলমান, শ্রীনগর শহর ভিত্তিক ধনী কাশ্মীরি হিন্দু পণ্ডিত এবং কাশ্মীরি শিখদের জমিদার অংশ ঐতিহ্যগতভাবে সব ক্ষেত্রে কাশ্মীর উপত্যকার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব দখল করেছিল।

স্বাধীনতার পর থেকে কাশ্মীরের মধ্যবিত্ত বা কাশ্মীরের নিম্নবিত্তের কেউ কখনওই জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্য শাসন করেনি। ওয়াটালদের মতো দলিত কাশ্মীরি মুসলমানদের কথা ভুলে যান, এমনকি মধ্যস্থতাকারী কাশ্মীরি মুসলিম সম্প্রদায় যেমন লোনস, ওয়ানিস, খান্দি ইত্যাদি তাদের মধ্যেও কেউ কখনও জম্মু ও কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার সাহস করেননি।  কিন্তু ২০১৯ সালের ৫ আগস্টের থেকে রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের একটি স্রোত কাশ্মীর উপত্যকায় সংঘটিত হচ্ছে।  বর্তমানে প্রশাসনের উৎসাহে অনেক দরিদ্র যুবক, বৃদ্ধ, মধ্যস্থতাকারী জাতিগোষ্ঠীর মানুষ রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতায়নের দিকে ধাবিত হচ্ছে। কাশ্মীরের দলিত ও ওবিসি বর্ণের মুসলমান, পাহাড়ি মুসলমানদের পাশাপাশি গুজ্জর ও বাকরওয়ালা সম্প্রদায়ের মানুষও এখন জম্মু ও কাশ্মীরের রাজনৈতিক দৃশ্যপট পরিবর্তনে অংশ নেবে। ফলস্বরূপ, প্রত্যাখানের পরিবর্তে জম্মু ও কাশ্মীরের সদ্য অনুষ্ঠিত ডিডিসি নির্বাচনে কাশ্মীরি জনগণ বিপুল সংখ্যায় অংশ নিয়েছিল। যার মাধ্যমে প্রথমবারের মতো জেলা পর্যায়ে রাজনৈতিক প্রতিনিধি নির্বাচিত হয়।

ডিডিসি নির্বাচনের সাফল্যের একটি প্রধান কারণ ছিল, এটি কাশ্মীরের অ-অভিজাত উচ্চবর্ণের অনেক প্রার্থীকে এই তাৎপর্যপূর্ণ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ দিয়েছিল। বিপুল সংখ্যক প্রার্থী ছিলেন মধ্যস্থতাকারী বা পাসমণ্ডা মুসলিম বর্ণের, যারা ২০১৯ সালের আগে এই ধরনের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অংশ নেওয়ার কথা কল্পনাও করত না।

কাশ্মীরি মুসলমানরা মূল ভূখণ্ডের রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অনেক বেশি আগ্রহ নিয়ে এই নতুন জাগরণকে আরও উন্নত করেছে। ২০১৯ সাল থেকে, কাশ্মীরি মুসলমানরা, যারা পূর্বে মূল ভূখণ্ডের রাজনৈতিক ঘটনাবলীতে বিচ্ছিন্ন ছিল, তারা এখন মূল ভূখণ্ডের সামাজিক ও রাজনৈতিক উন্নয়নে সক্রিয়ভাবে অংশ নিচ্ছে, তা হোক দিল্লিতে সিএএ বিরোধী প্রতিবাদ কিংবা গোটা ভারতে কোভিড রোগীদের জন্য অক্সিজেন সিলিন্ডার এবং ওষুধ বাড়ানো দাবি।

মূল ভূখণ্ডের রাজনীতিতে এই নতুন পাওয়া আগ্রহ কাশ্মীর উপত্যকায় তাদের নিজস্ব রাজনৈতিক বাস্তবতা সম্পর্কে কাশ্মীরি জনগণের মতামত প্রকাশের ক্ষেত্রেও রাজনৈতিক অবদান রেখেছে। কাশ্মীরের মানুষ এখন প্রশ্ন করতে শুরু করেছে, শুধু ব্রাহ্মণ থেকে ধর্মান্তরিত উচ্চবর্ণের কাশ্মীরি মুসলিম পরিবার এবং সৈয়দ মাল্লারাই কেন এই কয়েক দশক ধরে কাশ্মীর উপত্যকায় শীর্ষস্থানীয় রাজনৈতিক পদই অর্জন করেছে। শুধু তারাই কেন প্রশাসন ও উপত্যকায় ব্যবসা-বাণিজ্যে আধিপত্য বিস্তার করেছে।

২০১৯ সালের ৫ আগস্টের পর থেকে, জম্মু-কাশ্মীরের লোকেরা রাজনৈতিক বাস্তবতাকে ভালোর জন্য গ্রহণ করতে শুরু করেছে, যা মূল ভূখণ্ড ভারতের সঙ্গে তাদের দীর্ঘ বিলম্বিত মনস্তাত্ত্বিক সংহতি ব্যাখ্যা করে।

কাশ্মীরের মুসলমানরা এখন ভারতের সব বড় শহরে সাংবাদিকতা, চিকিৎসা, আইন, সিনেমা, টিভি শিল্পের সম্মুখভাগে রয়েছে। এই প্রক্রিয়াটি গত দুই বছরে আরও ত্বরান্বিত হয়েছে।

২০১৯ সালের পর সবচেয়ে বড় পরিবর্তন এসেছে, জম্মু অঞ্চল এবং কাশ্মীর উপত্যকার প্রান্তিক জাতি এবং সম্প্রদায়গুলো তাদের রাজনৈতিক শক্তিকে দৃঢ় করতে সক্ষম হয়েছে, যা উচ্চবর্ণের হিন্দু এবং মুসলিম অভিজাতদের আধিপত্যের কারণে তাদের আগে করা কঠিন ছিল। পুরাতন কাশ্মীরের মত নয়, নতুন কাশ্মীর আর কখনও ক্ষমতাবান জাতিগোষ্ঠী ও বিশেষ গোষ্ঠীকে একচেটিয়া রাজনৈতিক ক্ষমতা দেবে না। জম্মু ও কাশ্মীরের জনগণের রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষার গণতন্ত্রিকীকরণ ২০১৯ সালের এই ভূমিকা কাশ্মীরের সবচেয়ে বড় সাফল্যের গল্প হিসেবে রয়ে যাবে।

লেখক: তরুণ রাজনীতিবিদ ও কলাম লেখক

বিডি প্রতিদিন/কালাম

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর