১৯ এপ্রিল, ২০২২ ০৯:২৪
বিবিসি বাংলার প্রতিবেদন

ডোনবাসে হামলা শুরু রুশ বাহিনীর, পুতিন কেন এই অঞ্চল নিয়ন্ত্রণে নিতে চান?

অনলাইন ডেস্ক

ডোনবাসে হামলা শুরু রুশ বাহিনীর, পুতিন কেন এই অঞ্চল নিয়ন্ত্রণে নিতে চান?

ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলীয় লুহানস্ক ও ডোনেটস্ক, যা একত্রে ডোনবাস নামে পরিচিত, এলাকা দখল করতে রাশিয়া হামলা শুরু করেছে বলে জানিয়েছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদামির জেলেনস্কি।

রকেট ও আর্টিলারি দিয়ে ডোনবাসের শহরগুলোর ওপর মস্কো বোমা হামলা করছে বলে এক ভিডিও বার্তায় জানান জেলেনস্কি।

কিয়েভ দখলে রাশিয়া ব্যর্থ হওয়ার পর এই হামলার ব্যাপারে বহুদিন ধরেই আশঙ্কা করা হচ্ছিল।

প্রথম দিকে ইউক্রেনের বড় শহরগুলোর নিয়ন্ত্রণ আর দেশটির সরকার উৎখাতের পরিকল্পনা করেছিল রাশিয়া।

কিন্তু শক্ত প্রতিরোধের মুখে পড়ার পর রাশিয়ার প্রতিরক্ষা দফতর জানিয়েছে, তাদের অভিযানের প্রথম ধাপ ‘সাধারণভাবে সম্পূর্ণ হয়েছে’। এখন তারা রাজধানীর আশেপাশের এলাকা থেকে সৈন্যদের সরিয়ে নিচ্ছে।

সেই সময় রাশিয়া ঘোষণা করেছিল যে, এখন তাদের মনোযোগ থাকবে রুশ ভাষাভাষী ‘সদ্যমুক্ত’ ডোনবাস এলাকার দিকে।

ধারণা করা হচ্ছে, সেখানে এই যুদ্ধ অনেক দিন ধরে চলতে পারে।

প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বলেছেন, ইউক্রেনের এই প্রাচীন শিল্পাঞ্চলকে ‘মুক্ত’ করতে হবে।

এদিকে সোমবার ইউক্রেনের বেশ কয়েকটি শহরের ওপর গত রাতে রুশ বাহিনী বোমাবর্ষণ করেছে।

পশ্চিমাঞ্চলীয় লাভিভ শহরে ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় অন্তত ৭ জন নিহত হয়েছে।

এছাড়া খারকিভ শহরে আবাসিক ভবনের ওপর রুশ বাহিনী গোলাবর্ষণ করলে অন্তত দু’জন বেসামরিক লোক নিহত হয়। রাজধানী কিয়েভেও বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে।

বিবিসির সংবাদদাতারা জানাচ্ছেন, হামলা সম্পর্কে সতর্ক করতে প্রায় সারাক্ষণই বিভিন্ন শহরে বাজছে যুদ্ধের সাইরেন।

রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বলছে, তাদের সামরিক বাহিনী ইউক্রেনের ভেতরে মোট ৩১৫টি লক্ষ্যবস্তুর ওপর আঘাত হেনেছে।

উত্তরের খারকিভ এবং দক্ষিণের বন্দরনগরী ওডেসার কাছে মাইকোলায়েভের ওপরও আক্রমণ হয়েছে।

সামরিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পূর্বাঞ্চলীয় ডোনবাস অঞ্চলের ওপর পূর্ণমাত্রার আক্রমণ চালানোর আগে ইউক্রেনের সামরিক স্থাপনাগুলোকে দুর্বল করে দেওয়ার চেষ্টা করছে রাশিয়া।

ডোনবাস কোথায় এবং কেন গুরুত্বপূর্ণ

বিবিসির পল কারবি একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছেন, প্রেসিডেন্ট পুতিন যখন ডোনবাসের কথা বলেন তখন তিনি ইউক্রেনের কয়লা এবং ইস্পাত উৎপাদনকারী অঞ্চলের কথা উল্লেখ করেন।

তিনি পূর্বাঞ্চলের বৃহৎ দুটো অঞ্চল লুহানস্ক এবং ডোনেটস্কের সমগ্র এলাকাকে বোঝান। এই এলাকা দক্ষিণের মারিউপোল বন্দর-শহর থেকে শুরু করে উত্তরে রুশ সীমান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত।

পশ্চিমা দেশগুলোর প্রতিরক্ষা জোট ন্যাটো মনে করে রাশিয়া এই অঞ্চল দখল করে নেওয়ার মাধ্যমে ডোনেটস্ক থেকে ক্রিমিয়া পর্যন্ত দক্ষিণ উপকূলে একটি স্থল করিডোর প্রতিষ্ঠার করতে চায়।

“মূল বিষয় হচ্ছে ক্রেমিলন এই অঞ্চলকে ইউক্রেনে রুশভাষীদের অংশ বলে চিহ্নিত করেছে যার অর্থ এই অঞ্চল ইউক্রেনের চেয়েও অনেক বেশি রাশিয়া,” বলেন ব্রিটেনে প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা বিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইন্সটিটিউট বা রুসির স্যাম ক্র্যানি-ইভান্স।

এসব অঞ্চলে হয়তো রুশভাষী লোকেরাই বসবাস করেন, কিন্তু তারা এখন আর রুশপন্থী নন।

“মারিউপোল একসময় ছিল ইউক্রেনের সবচেয়ে বেশি রুশপন্থী শহরগুলোর একটি এবং এটি এমন মাত্রায় ছিল যা আমার ধারণাতেও ছিল না,” বলেন পোল্যান্ডে অবস্থিত নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত আঞ্চলিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান রোচান কনসাল্টিং এর প্রধান কনরাড মুজাইকা।

এক মাসেরও বেশি সময় ধরে চলা যুদ্ধের পর রাশিয়া দাবি করছে যে তারা লুহানস্ক অঞ্চলের ৯৩% এবং ডোনেটস্কের ৫৪% এলাকায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে।

এখন এই পুরো অঞ্চলকে আয়ত্তে নিতে হলে রুশ প্রেসিডেন্টকে আরও লম্বা পথ পাড়ি দিতে হবে এবং তিনি যদি একসময় বিজয় অর্জন করতেও সক্ষম হন, ওই অঞ্চল এতো বৃহৎ যে সেখানে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা সহজ হবে না।

পুতিন কেন ডোনবাস নিয়ন্ত্রণে নিতে চান

রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন ইউক্রেনের বিরুদ্ধে বারবার অভিযোগ তুলেছেন যে তারা পূর্বাঞ্চলে গণহত্যা পরিচালনা করছে, যদিও তার এই অভিযোগের পক্ষে কোনও তথ্যপ্রমাণ নেই।

যুদ্ধ যখন শুরু হয় তখন পূর্বদিকের এসব অঞ্চলের দুই-তৃতীয়াংশ ছিল ইউক্রেনের হাতে। বাকি অংশ বিচ্ছিন্নতাবাদীরা পরিচালনা করতো যারা সেখানে আট বছর আগে শুরু হওয়া যুদ্ধে রাশিয়ার সমর্থনে ক্ষুদ্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছে।

যুদ্ধ শুরু হওয়ার ঠিক আগেভাগে প্রেসিডেন্ট পুতিন ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলীয় দুটো এলাকাকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন।

রাশিয়া যদি এই দুটো বৃহৎ অঞ্চল জয় করতে পারে, তাহলে প্রেসিডেন্ট পুতিন দেখাতে পারবেন যে এই যুদ্ধ থেকে তিনি কিছু একটা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন।

পরবর্তী পদক্ষেপ হবে ডোনবাসকে রাশিয়ার সঙ্গে একীভূত করে নেওয়া। ২০১৪ সালে বিতর্কিত এক গণভোটের মাধ্যমে ক্রিমিয়াকে তিনি ঠিক যেভাবে রাশিয়ার অংশ করে নিয়েছেন।

লুহানস্কে রাশিয়াপন্থী নেতা এর মধ্যেই “অদূর ভবিষ্যতে” সেখানে গণভোট আয়োজনের ব্যাপারে কথা বলেছেন, যদিও রণক্ষেত্রে এখনই এরকম একটি ছলের আয়োজন করা অসম্ভব হবে।

পুতিনের কৌশল কী

রাশিয়ার সৈন্যরা উত্তর, পূর্ব এবং দক্ষিণ দিক থেকে অগ্রসর হয়ে ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনীকে ঘিরে ফেলার চেষ্টা করছে।

“নিয়ন্ত্রণ করার জন্য এই অঞ্চল অনেক বৃহৎ। এছাড়াও এর ভৌগলিক জটিলতাকেও ছোট করে দেখা যাবে না,” বলেন লন্ডনে কিংস কলেজে সংঘাত ও নিরাপত্তা বিষয়ক অধ্যাপক ট্রেসি জার্মান।

সাত সপ্তাহের যুদ্ধের পরেও রাশিয়া তাদের সীমান্তের কাছে ইউক্রেনের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর খারকিভ দখল করতে পারেনি। কিন্তু তারা ইজিউম শহরে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে। বিচ্ছিন্নতাবাদীদের নিয়ন্ত্রিত পূর্বাঞ্চলে প্রবেশের জন্য এই শহরটি কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ।

“আপনি যদি দেখেন ইজিউমে তারা যা করছে, এখান দিয়েই প্রধান মহাসড়কগুলো গেছে, যার অর্থ হচ্ছে তারা তাদের যুদ্ধসামগ্রী এসব রাস্তা ও রেলপথে নিয়ে আসবে,” বলেন অধ্যাপক জার্মান।

রুশ সমর্থিত বিচ্ছিন্নতাবাদীরা ডোনবাসের বিস্তৃত এলাকা প্রথমবারের মতো দখল করে নেওয়ার পর থেকে রাশিয়ার নিকটবর্তী শহরগুলোতে কয়েক বছর ধরে যুদ্ধ চলছে।

রাশিয়ার এরপরের বড় টার্গেট হবে স্লোভিয়ান্সকের একটি সড়ক। এই শহরে সোয়া এক লাখ মানুষের বাস। রুশ-সমর্থিত বাহিনী ২০১৪ সালে শহরটি দখল করে নিয়েছিল। কিন্তু পরে সেটি ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর দখলে চলে যায়।

রাশিয়ার আরও একটি বড় টার্গেট হবে দক্ষিণ দিকে ক্রামাটরস্ক শহর দখল করে নেওয়া। সূত্র: বিবিসি বাংলা

বিডি প্রতিদিন/কালাম

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর