২ মে, ২০২২ ১০:০৫

কে এই সুতোমু, যিনি দুটি পরমাণু বোমা হামলায়ও বেঁচে গিয়েছিলেন!

অনলাইন ডেস্ক

কে এই সুতোমু, যিনি দুটি পরমাণু বোমা হামলায়ও বেঁচে গিয়েছিলেন!

সুতোমু ইয়ামাগুচি

১৯৪৫ সালের ৬ ও ৯ আগস্ট মাত্র তিন দিনের ব্যবধানে জাপানে দুটি পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটায় আমেরিকা। এই ঘটনা জাপানকে কার্যত পঙ্গু করে দিয়েছিল।

৬ আগস্ট জাপানের হিরোশিমায় নিক্ষেপ করা হয় পারমাণবিক বোমা ‘লিটল বয়’ এবং ৯ আগস্ট নাগাসাকিতে আঘাত হানে ‘ফ্যাটম্যান।’ পরপর দুটো পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণে পরের অনেকগুলো বছরের জন্য জাপানের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা স্থবির হয়ে পড়েছিল।

তবে এই দুটি পরমাণু হামলায় বেঁচে গিয়েছিলেন একজন ব্যক্তি, তার নাম সুতোমু ইয়ামাগুচি। তিনি হিরোশিমার পরমাণু বিস্ফোরণের সময় হিরোশিমায় ছিলেন। আবার তার ঠিক তিন দিন পর যখন নাগাসাকিতে পরমাণু বোমা ফেলা হল, তখন সেখানেও উপস্থিত ছিলেন সুতোমু।

অদ্ভুতভাবে প্রতিবারই বিস্ফোরণস্থল থেকে তার দূরত্ব ছিল তিন কিলোমিটারের মতো। ফলে বিস্ফোরণের তীব্রতায় গুরুতর আহত  হন তিনি। সাময়িকভাবে অন্ধ হয়ে যান, শ্রবণশক্তিও হারিয়েছিলেন। তারপরও বেঁচে যান সুতোমু।

পেশায় মেরিন ইঞ্জিনিয়ার সুতোমু জাপানের সংস্থা মিৎসুবিশির জন্য তেলবাহী জাহাজের নকশা করতেন। ১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট কাজের সূত্রেই তিনি ছিলেন হিরোশিমায়। তিন মাসের সফর সেরে সেদিনই তার বাড়ি ফেরার কথা ছিল হিরোশিমা থেকে।

ওই দিন সকালে দুই সহকর্মীকে সঙ্গে নিয়ে হিরোশিমা স্টেশনের দিকে রওনাও হয়ে যান সুতোমু। কিন্তু মাঝপথ থেকে ফিরে আসতে হয় তাকে।

জাপানে যেকোনও সরকারি পরিসেবার জন্য জরুরি যে পরিচয়পত্র তার নাম হ্যাংকো। সুতোমুর হঠাৎই খেয়াল হয় তিনি হিরোশিমায় তার গত তিন মাসের অফিসে নিজের হ্যাংকোটি ফেলে এসেছেন। সহকর্মীদের স্টেশনে যেতে বলে আবার অফিসের দিকে রওনা হন সুতোমু।

ঠিক সকাল সোয়া ৮টায় সুতোমু যখন অফিসের কাছাকাছি প্রায় পৌঁছে যান, তখনই ঘটে ঘটনাটি।

আমেরিকার বোমারু বিমান ‘এনোলা গে’ হিরোশিমা শহরের ঠিক মাঝখানে নিক্ষেপ করে পরমাণু বোমা ‘লিটল বয়’।

পরে নিজের বইয়ে সেই ঘটনার স্মৃতিচারণায় সুতোমু লেখেন, তিনি বোমারু বিমানটিকে আকাশে দেখেছিলেন। ঠিক তখনই দু’টি প্যারাশ্যুটকেও নামতে দেখেন। সুতোমুর কথায়, “তারপরই আকাশে একটা প্রচণ্ড আলোর ঝলকানি দেখা গেল, আর আমি ছিটকে গেলাম।”

হিরোশিমার ওই বিস্ফোরণে কানের পর্দা ফেটে গিয়েছিল সুতোমুর। কিছুক্ষণের জন্য অন্ধও হয়ে গিয়েছিলেন তিনি।

বিস্ফোরণস্থলের কাছে থাকায় রাসায়নিক বিকিরণে শরীরের ঊর্ধ্বাঙ্গ অনেকটাই ঝলসে যায় জাহাজ নকশাকার সুতোমুর। জ্ঞানও হারান তিনি।

জ্ঞান ফিরলে প্রথমেই দুই সহকর্মীর খোঁজ করেন সুতোমু। খুঁজে না পেয়ে জখম শরীরেই উঠে বসেন বাড়ি ফেরার ট্রেনে। পরমাণু বিস্ফোরণে বিধ্বস্ত হিরোশিমায় অদ্ভুতভাবে তখনও ট্রেন পরিসেবা চালু ছিল!

সুতোমুর বাড়ি নাগাসাকিতে। হিরোশিমার দুর্ঘটনার পরের দিনই ৭ আগস্ট নিজের শহর নাগাসাকি পৌঁছান তিনি। মারাত্মক জখম হওয়া সত্ত্বেও গোটা গায়ে ব্যান্ডেজ বেঁধে ৯ আগস্ট হাজির হন কাজে।

তাকে দেখে অবাক হয়ে যান অফিসের সহকর্মীরা। ঊর্ধ্বতন কর্তাকে হিরোশিমার ঘটনার বিবরণ দিতে যাওয়ায় তিনি সুতোমুকে ‘পাগল’ বলে ঠাট্টাও করেন। ঠিক তখন, ৯ আগস্ট বেলা ১১টায় পরমাণু বিস্ফোরণ হয় নাগাসাকিতেও।

সুতোমুর অফিস থেকে ঠিক তিন কিলোমিটার দূরে ফেলা হয় আমেরিকার পরমাণু বোমা ‘ফ্যাট ম্যান’। এবারও বেঁচে যান সুতোমু।

তবে শারীরিক আঘাত না পেলেও নাগাসাকির বিস্ফোরণের পর টানা এক সপ্তাহ প্রচণ্ড জ্বরে আক্রান্ত ছিলেন সুতোমু। টানা বমিও হতে থাকে তার।

এর প্রায় পাঁচ বছর পর ১৯৫০ সালে অনুবাদক হিসেবে কাজ করতে শুরু করেন সুতোমু। পরে পুরনো অফিস মিৎসুবিশিতেও ফিরে আসেন। আগের মতোই আবার জাহাজের নকশা করার কাজ শুরু করেন। শুরু করেন স্বাভাবিক জীবনযাপন।

নাগাসাকি বিস্ফোরণের সময় সুতোমুর স্ত্রীও ছিলেন শহরেই। তিনিও বেঁচে যান। দু’জনে এর পর দুই কন্যা সন্তানের জন্মও দেন। পরে নিজের বইয়ে সুতোমু লিখেছিলেন, সেই সময় নিজের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা একরকম ভুলতে চাইছিলেন তিনি। বিষয়টি যে অতীত এটুকু ভেবেই নিশ্চিন্ত ছিলেন তিনি। কিন্তু ক্রমে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পরমাণু অস্ত্র সম্পর্কে তার একটি স্পষ্ট ধারণা তৈরি হতে শুরু করে।

তখনও সরকারি খাতায় তিনি শুধু নাগাসাকির বিস্ফোরণ থেকে বেঁচে ফেরা মানুষ। তার হিরোশিমার অভিজ্ঞতার কথা তখনও জানেই না জাপান সরকার। অথচ সুতোমুর সন্তানেরা সেই ভয়াবহ অভিজ্ঞতা এবং শারীরিক ক্ষতির ভার বয়ে নিয়ে চলেছে নিজেদের শরীরে।

বয়স যখন প্রায় আশির কোঠায় তখন সুতোমু ঠিক করেন তার অভিজ্ঞতার কথা লিখে রাখবেন। নিজের চোখে দেখা পরমাণু অস্ত্রের ভয়াবহতার কথা জানাবেন দেশের মানুষকে। সুতোমুর সেই বই অবাক করে দেয় জাপানের মানুষকে।

২০০৬ সালে তাকে নিয়ে তৈরি হয় তথ্যচিত্র। ছবিটির প্রদর্শন হয়েছিল আমেরিকাতেও। সেখানে শক্তিশালী দেশগুলোর উদ্দেশে একটি বার্তা দিয়েছিলেন দু’বার পরমাণু বোমাকে ধোঁকা দেওয়া সুতোমু। বলেছিলেন, “আপনারা দয়া করে পরমাণু অস্ত্রের ব্যবহার বন্ধ করুন। অস্ত্র তৈরি করা বন্ধ করুন।”

২০০৯ সালে হলিউডের পরিচালক জেমস ক্যামেরন দেখা করেন তার সঙ্গে। তাকে নিয়ে ছবি বানানোর কথাও বলেন। তবে ততদিনে অসুস্থ হয়ে পড়েন সুতোমু।

পরমাণু বিকিরণের তীব্র প্রভাব পড়েছিল তার শরীরে। শেষ বয়সে ছানি, লিউকোমিয়ার মতো অসুখে আক্রান্ত হন। ২০০৯ সালে সুতোমু জানতে পারেন তিনি পাকস্থলীর ক্যান্সারেও আক্রান্ত। ততদিনে ক্যান্সারে স্ত্রীকেও হারিয়েছেন তিনি।

ঠিক এই সময়েই সুতোমুর মনে হয় তার জোড়া পরমাণু বোমা অভিজ্ঞতার স্বীকৃতি থাকা দরকার। তার নিজের জন্য নয়, ভবিষ্যতে পরমাণু অস্ত্র সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মাঝে সচেতনতা তৈরি করতেই ওই স্বীকৃতি দরকার। সরকারের কাছে তার অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে আবেদন করেন। আর স্বীকৃতি পেয়েও যান। তিনিই একমাত্র ব্যক্তি, যার দু’টি বিস্ফোরণেরই সাক্ষী হওয়ার কথা মেনে নিয়েছে জাপান সরকার।

২০১০ সালের জানুয়ারিতে মারা যান সুতোমু। ওই বছরই ডিসেম্বরে তাকে নিয়ে একটি অনুষ্ঠান করে ব্রিটিশ গণমাধ্যম বিবিসি। অনুষ্ঠানের নাম দেওয়া হয়েছিল ‘দ্য আনলাকিয়েস্ট ম্যান ইন দ্য ওয়ার্ল্ড’। অনুষ্ঠানটিতে সুতোমুর ঘটনাটিকে ব্যঙ্গাত্মকভাবে উপস্থাপন করার জন্য সমালোচিত হয়েছিল বিবিসি। শেষে প্রকাশ্যে ক্ষমাও চাইতে হয় তাদের।

তবে বিবিসির অনুষ্ঠান মৃত সুতোমুকে একটি নতুন নামও দেয়— ‘দ্য আনলাকিয়েস্ট ম্যান’। বাংলা অর্থ দাঁড়ায় ‘সবচেয়ে হতভাগা ব্যক্তি’, যা সুতোমুর জীবদ্দশাতেই স্বীকার করে নিয়েছিল জাপান সরকারও। সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান, নিউ ইয়র্ক টাইমস, টোকিও উইকেন্ডার, ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউকে

বিডি প্রতিদিন/কালাম

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর