শিরোনাম
২৯ এপ্রিল, ২০২৪ ১৯:৩২

লোকসভা নির্বাচন: তাপপ্রবাহই বড় চ্যালেঞ্জ প্রার্থীদের কাছে, মমতার তোপ

দীপক দেবনাথ, কলকাতা

লোকসভা নির্বাচন: তাপপ্রবাহই বড় চ্যালেঞ্জ প্রার্থীদের কাছে, মমতার তোপ

প্রতিপক্ষকে সামলানোর পাশাপাশি ভারতের চলমান লোকসভা নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রার্থীদের কাছে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ তাপপ্রবাহ। দেশটির ১৮তম লোকসভা নির্বাচন মোট সাত দফায় ভোট নেওয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যে দুই দফায় ভোট পর্ব সম্পন্ন হলেও বাকি রয়েছে এখনো পাঁচ দফা। কিন্তু গ্রীষ্মের এই কাঠফাটা রোদ্দুরকে সামলানোই এখন বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রার্থীদের কাছে। কারণ ইতোমধ্যেই গত শুক্রবার দ্বিতীয় দফার নির্বাচনে তাপপ্রবাহের কারণে পাঁচ জনের মৃত্যু হয়েছে কেরালায়, সোমবার আরো ২ জনের মৃত্যু হয়। 

প্রচণ্ড দাবদাহের কারণে ইতোমধ্যেই পশ্চিমবঙ্গের সমস্ত সরকারি ও সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত স্কুলে ছুটি ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। বেসরকারি স্কুলগুলোর কেউ কেউ অনলাইনের মাধ্যমে পড়াশোনা চালাচ্ছে? কিছু কিছু বেসরকারি স্কুলে আবার সকাল সাতটা থেকে এগারোটা পর্যন্ত ক্লাস চালু থাকছে। 

সকাল ১১টার পর থেকেই রাস্তাঘাট কার্যত খাঁখাঁ করছে। প্রয়োজন ছাড়া কেউই ঘরের বাইরে বের হচ্ছে না। আর নিতান্তই যারা বেরোচ্ছেন, সূর্যের প্রখর তাপ থেকে বাঁচতে সারা শরীর কাপড়ে মুড়িয়ে নিচ্ছেন। বাইরে বেরোলেও তাপপ্রবাহের হাত থেকে রক্ষা পেতে সকাল-সকাল কাজ সেরে বাড়ি ফেরার চেষ্টা করছেন সাধারন মানুষ। চাকরিজীবীরাও রোদের তাপ বাড়ার আগেই তাদের নির্দিষ্ট কর্মস্থলে পৌঁছানোর চেষ্টা করছেন। কিন্তু তাতেও নিস্তার নেই। প্রচণ্ড গরমে অসুস্থ হয়ে পড়ছে সাধারণ মানুষ। চিকিৎসকরা বলছেন এই ধরনের আবহাওয়ায় হিট স্ট্রোকের আশঙ্কাও রয়েছে। হতে পারে ডিহাইড্রেশনের সমস্যাও। 

রৌদ্রের তাপে শুকিয়েছে নদীর পানি। শুকিয়ে যাচ্ছে মাঠ-ঘাট-রাস্তা। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত রাস্তায় দাঁড়িয়ে যারা যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ করছেন, সেই পুলিশের অবস্থা আরো দুর্বিষহ। কলকাতার বিভিন্ন এলাকায় কর্মরত ট্রাফিক পুলিশ কর্মকর্তাদের দেখা গেল বারবার মুখে ও মাথায় পানি ব্যবহার করছেন, যাতে গরম থেকে কিছুটা রেহাই পাওয়া যায়। 

আবহাওয়া দপ্তর বলছে তাপপ্রবাহের হাত থেকে এখনই নিস্তার পাচ্ছে না পশ্চিমবঙ্গের মানুষ। এই তাপপ্রবাহ চলবে আরো ৪-৫ দিন। আলিপুর আবহাওয়া দপ্তরের আঞ্চলিক কর্মকর্তা সোমনাথ দত্ত জানান, 'দক্ষিণবঙ্গে তাপপ্রবাহ চলবে। বুধবার পর্যন্ত আট জেলাতে তীব্র তাপ প্রবাহের লাল সতর্কবার্তা জারি করা হয়েছে। বৃহস্পতি এবং শুক্রবারেও বেশ কয়েক জেলায় চরম তাপপ্রবাহের কমলা সতর্কবার্তা। নতুন করে তাপমাত্রা বাড়ার সম্ভাবনা নেই। ৫ মে থেকে দক্ষিণবঙ্গে বৃষ্টি শুরু হবে। রবিবার দুপুর ২.৩০ টা পর্যন্ত তাপমাত্রা ছিল ৪১.৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। রাজ্যটির পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় গত রবিবার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৪৪.৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস, বাঁকুড়ায় ৪৩.৫ ডিগ্রি, কলকাতায় ৪১.৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস।' 

উড়িষ্যা বিহার এবং ঝাড়খণ্ডের কিছু জায়গাও এই তাপপ্রবাহ চলতে থাকবে। তাপপ্রবাহের হাত থেকে মুক্তি পাবে না দিল্লী, মুম্বাই, বেঙ্গালুরু, কর্ণাটক, তামিলনাড়ু, অন্ধপ্রদেশ তেলেঙ্গানাও। আগামী ১ মে পর্যন্ত এই তাপপ্রবাহ চলতে থাকবে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া দপ্তর। 

দিল্লিতে সোমবার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা পৌঁছতে পারে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কাছাকাছি। মুম্বাইতেও ৩৯ ডিগ্রির কাছাকাছি থাকবে পারদ। বেঙ্গালুরুতে সবচেয়ে উষ্ণতম দিন গেছে রবিবার, তাপমাত্রা ছিল ৩৮.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। 


তাপপ্রবাহ চলছে ওড়িশাতেও, রাজ্যের অন্তত ২৭ টি জায়গায় তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রির বেশি রেকর্ড করা হয়েছে, যার মধ্যে আবার বারোটি জায়গায় ৪৩° বেশি তাপমাত্রা রয়েছে। ত্রিপুরাতেও সমস্ত রাজ্য সরকারই স্কুলগুলিতেই গরমের ছুটি বাড়িয়ে ১ মে পর্যন্ত করা হয়েছে। 


স্বাভাবিক ভাবেই প্রচারণায় বেরিয়ে তীব্র দাবদাহে মেজাজ হারাচ্ছে তারকা প্রার্থীরাও। কেউ আবার অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। দু'দিন আগেই বীরভূম জেলার দুবরাজপুর ব্লকের হেতমপুর পঞ্চায়েত এলাকায় এক নির্বাচনী প্রচারণে গিয়ে মেজাজ হারান বীরভূম কেন্দ্রের তৃণমূল প্রার্থী শতাব্দীর রায়। উন্নয়ন নিয়ে প্রশ্ন করায় নিজের দলের কর্মীকেই ইডিয়ট বলেন শতাব্দী রায়।

কিন্তু ভোট বড় বালাই! তাই গরমের মধ্যেও নিজেদের ফিট রাখতে, ভোটারদের কাছে পেতে প্রচারণার সময় তালিকায় বদল ঘটিয়েছেন প্রার্থীরা। কেউ সকাল ছয়টা থেকে বেরোচ্ছেন, কেউবা ৭টা থেকে তিন ঘণ্টার জন্য প্রচারণা সেরে ১০টার মধ্যেই বাড়িতে কিংবা দলীয় কার্যালয় ফিরে আসছেন। রোদের তাপ পড়তেই ফের বিকেলবেলায় প্রচারণায় বেরোচ্ছেন তারা। 

প্রচণ্ড গরমের হাত থেকে বাঁচতে প্রচারের ফাঁকে ফাঁকে ডাবের পানি, আইসক্রিম, জুস, ঠাণ্ডা পানি খেতে দেখা যাচ্ছে প্রার্থীদের। মাথা রাখতে হচ্ছে বড় টুপি, কেউ আবার ছাতা মাথায় দিচ্ছে প্রচার সারছেন। দুপুরের খাবারেও রাখা আছে খুব হালকা মসলা-বিহীন বা কম মসলাযুক্ত খাবার। 

যেমন গরম থেকে বাঁচতে তারকা ক্রিকেটার বহরমপুর কেন্দ্রের তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থী ইউসুফ পাঠান খাচ্ছে সাধারণ খাবার। সাধারণ বাঙালি খাবারই তার বেশি পছন্দ। গুজরাটি ক্রিকেটার হলেও এখন বর্তমানে আলুভাজা, ভাতসহ মাছ এবং পাঁচ তরকারি সবজি থাকছে তার পাতে। পাশাপাশি গরম থেকে বাঁচতে পাতে থাকছে টক দই। ইউসুফ পাঠানের কথায় 'বাংলা ও বাঙালিয়ানার সঙ্গে আমার যোগ দীর্ঘ দিনের। আলু ভাজা ও ডাল আমার পছন্দ। কলকাতা নাইট রাইডার্সে খেলেছি অনেক দিন। বাঙালি খাবার আমার ভালই লাগে।' 

দাবদাহের কারণে প্রার্থীদেরও যে কষ্ট হচ্ছে সে কথা স্বীকার করে নিয়েছেন রাজ্যের সেচ মন্ত্রী এবং ব্যারাকপুর লোকসভা কেন্দ্রের তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থী পার্থ ভৌমিক। তিনি জানান 'আমার খুব খারাপ লাগছে যে এত তাপ প্রবাহের মধ্যে কর্মীদের নিয়ে আমাকে প্রচারণা করতে হচ্ছে। কিন্তু কষ্ট স্বীকার করতেই হবে। আমরা চেষ্টা করছি যত তাড়াতাড়ি অর্থাৎ রোদের তাপ বাড়ার আগেই সকাল-সকাল আমাদের প্রচারণাটা শেষ করে দেওয়া যায়।' 

ব্যারাকপুর লোকসভা কেন্দ্রের বিজেপি প্রার্থী অর্জুন সিং জানান 'গরমের কারণে ঘুমটা কম হচ্ছে তাছাড়া অন্য কোন অসুবিধা হচ্ছে না। তবে দলীয় কর্মীদের এই গরমে বের হতে একটু সমস্যা হচ্ছে।' 

প্রচন্ড দাবদাহের মধ্যে নির্বাচন করা নিয়ে ইতোমধ্যেই মুখ খুলেছেন তৃণমূল কংগ্রেস প্রধান মমতা ব্যানার্জিও। নির্বাচনি প্রচারণা থেকেই তাকে বলতে শোনা গেছে 'আমাদের দুর্ভাগ্য প্রতিবছর ঠিক এই সময়টাতেই নির্বাচন ফেলা হয়। আর অন্যবার যদিও বা ৮ থেকে ১০ মে'এর মধ্যে হয়ে যায়, এবার তো ১ জুন পর্যন্ত নির্বাচন চলবে। তারপর ৪ জুন গননা হবে। মমতার প্রশ্ন 'কাকে সুবিধা করে দেওয়ার জন্য? বিজেপিরা কি বুঝতে পারে না এত গরমে মানুষের কষ্ট হচ্ছে। বিজেপি ঘুরে বেড়াবে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও সারা দেশে ঘুরে বেড়াবেন দলের হয়ে প্রচার করবেন তাই তাকে সময় দেওয়ার জন্য।...' 

তবে শুধু মানুষই নয়, তীব্র দাবদাহে হাসপাতাল অবস্থা পশু-পাখিদেরও। রাজ্যের চিড়িয়াখানাগুলোতে বন্য প্রাণীদের সবল ও সুস্থ রাখতে একাধিক পদক্ষেপ নিয়েছে বন দপ্তর। বদল করা হয়েছে ডায়েট চার্ট। প্রাণীরা সাধারণভাবে যা খাবার খায় তার থেকে ৫০-৭০ শতাংশ কম খাবার দেওয়া হচ্ছে, যাতে পেট গরম না হয়। সেই সঙ্গে খাবার পানিতে থাকছে ORS, গ্লুকোজ। হরিণকে বেশি করে খাওয়ানো হচ্ছে শসা, কচি পাতা। ভাল্লুককে দেওয়া হচ্ছে লাল তরমুজ। তালিকায় এমন কিছু খাদ্য রাখা হয়েছে, যাতে পানির পরিমাণ বেশি রয়েছে। বন্যপ্রাণীদের খেলা করার জন্য ওয়াটার পুল তৈরি করা হয়েছে। সেই সঙ্গে মাথার ওপর সবুজ আচ্ছাদনে রঙবাহারি ছাতায় তৈরি হয়েছে একেবারে শীতল আবহ। চৌবাচ্চায় সব সময় ঠাণ্ডা পানি রাখা হচ্ছে যাতে হরিণসহ বন্যপ্রাণীর দল তৃষ্ণা নিবারণ করতে পারে। বাঁদর ও পাখিদের মতো প্রাণীকে Sprinkler System এর মাধ্যমে স্নান করানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে বন বিভাগের পক্ষ থেকে।


বিডি প্রতিদিন/নাজমুল

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর