২৫ জুন, ২০২৪ ২৩:০০

পানি বণ্টন নিয়ে কেন্দ্র ও রাজ্যের পাল্টাপাল্টি অভিযোগে উত্তাল ভারতের রাজনীতি

দীপক দেবনাথ, কলকাতা

পানি বণ্টন নিয়ে কেন্দ্র ও রাজ্যের পাল্টাপাল্টি অভিযোগে উত্তাল ভারতের রাজনীতি

মমতা ব্যানার্জির প্রধান উপদেষ্টা ও রাজ্যের সাবেক মুখ্য সচিব আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়

বাংলাদেশকে তিস্তা ও গঙ্গার পানি বণ্টন নিয়ে সোমবার ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারকে নিশানা করেছিলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। এ নিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে চিঠিও পাঠান মমতা। তার অভিযোগ ছিল, রাজ্যের সাথে কোনোরকম আলোচনা না করেই ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার বাংলাদেশকে পানি বিক্রি করতে চাইছে। এমনকি হুঁশিয়ারি দিয়ে মমতা এটাও বলেন, কেন্দ্র যদি একতরফাভাবে সিদ্ধান্ত নেয়, তবে তার প্রতিবাদে গোটা দেশজুড়ে আন্দোলন গড়ে তোলা হবে।

কিন্তু মঙ্গলবারই মমতার এই দাবিকে সম্পূর্ণ নস্যাৎ করে দিয়ে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার জানায়, এই সম্পর্কিত সমস্ত আলোচনাই রাজ্য সরকারের সাথে করা হয়েছিল। আর এদিন বেলা গড়াতেই সংবাদ সম্মেলন করে মমতা ব্যানার্জির সরকার জানিয়ে দিল, কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে যে চিঠির কথা বলা হচ্ছে, দু-একটি টেকনিক্যাল বিষয় ছাড়া পানি বণ্টন নিয়ে বিস্তারিত আলোচনাই হয়নি।

বিশ্বস্ত সূত্রের বরাত দিয়ে মঙ্গলবার সংবাদ সংস্থা পিটিআই জানিয়েছে, গঙ্গার পানি চুক্তি পুনর্নবীকরণ নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে আগেই অবহিত করা হয়েছিল। কেন্দ্রীয় সরকার সূত্রে খবর, এই বিষয় নিয়েই গত ২০২৩ সালের ২৪ জুলাই পশ্চিমবঙ্গকে সরকারকে চিঠি লিখেছিল কেন্দ্র। তাতে ১৯৯৬ সালে স্বাক্ষরিত ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তির পুনর্নবীকরণ বিষয়ে আভ্যন্তরীণ পর্যালোচনা করার জন্য গঠিত কমিটিতে রাজ্যের তরফে মনোনীত প্রতিনিধি চাওয়া হয়েছিল। ওই বছরেরই ২৫ আগস্ট রাজ্য সরকারের তরফ থেকে কমিটির জন্য রাজ্যের সেচ ও জলপথ মন্ত্রণালয়ের প্রধান প্রকৌশলী (নকশা ও গবেষণা)-কে মনোনীত করা হয়। চলতি বছরের ৫ এপ্রিল, রাজ্য সরকারের সেচ ও জলপথ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব চিঠি দিয়ে ফারাক্কা ব্যারাজের ভাটির (downstream) অংশ থেকে পরবর্তী ৩০ বছরের জন্য তাদের মোট পানির চাহিদার বিষয়টি জানিয়েছিলেন।

বাংলাদেশের সাথে পানি বণ্টন নিয়ে ভারতের কেন্দ্র ও পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মধ্যে যে মনোমালিন্য শুরু হয়েছে, তাতে মমতা ব্যানার্জিকে দায়ী করেছে কেন্দ্রীয় সরকার। রাজ্য সরকারকে অন্ধকারে রেখে কেন্দ্র পানি বিক্রি করতে চাইছে মমতার এই অভিযোগকে ‘মিথ্যা দাবি’ বলে আখ্যায়িত করেছে কেন্দ্র। সূত্রের বরাত দিয়ে সংবাদ সংস্থা এএনআই জানিয়েছে, পশ্চিমবঙ্গ সরকার মিথ্যা দাবি ছড়িয়েছে, ফারাক্কায় গঙ্গার পানি ভাগাভাগি নিয়ে ১৯৯৬ সালের ভারত-বাংলাদেশ চুক্তির অভ্যন্তরীণ পর্যালোচনাতে তাদের সাথে পরামর্শ করা হয়নি।

মঙ্গলবার দিনভর ভারতের বিভিন্ন গণমাধ্যমে এই বিষয়টি আলোচিত হয়ে থাকে। এরপর বেলা গড়াতেই কেন্দ্র সরকারের তরফে মমতাকে জানানোর বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে যে খবর সম্প্রচারিত হয় তা নিয়ে আসরে নামে রাজ্য সরকার। রাজ্য সরকারের সচিবালয় নবান্ন থেকে সংবাদ সম্মেলন করে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির প্রধান উপদেষ্টা ও রাজ্যের সাবেক মুখ্য সচিব আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায় এর বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেন।

আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, মঙ্গলবার বিভিন্ন গণমাধ্যম সূত্রে কিছু তথ্য সম্প্রচারিত হয়েছে। সেখানে যে চিঠির বিষয়ে ভারত সরকারের তরফে বলা হচ্ছে, সেটি হচ্ছে ২০২৩ সালের ২৪ জুলাই ভারতের কেন্দ্রীয় জলশক্তি মন্ত্রণালয় একটি টেকনিক্যাল কমিটি তৈরি করেছিল। তাতে এবং তার পরবর্তী পত্রে মোট ১২ জন সদস্যের টেকনিক্যাল কমিটি গঠন করা হয়। যার মধ্যে একজন পশ্চিমবঙ্গের সরকারের চিফ ইঞ্জিনিয়ার পদমর্যাদার কর্মকর্তা আছেন। এরপর চলতি বছরের ১৪ জুলাই এর একটি চিঠি প্রেরণের কথা বলা হয়েছে, তাতে টেকনিক্যাল কমিটি ভারতের কেন্দ্রীয় পানি কমিশনকে তাদের রিপোর্ট দেয়। যেটা ভারতের কেন্দ্রীয় জলশক্তি মন্ত্রণালয় জমা পড়ে। তারা বলছেন, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের চিফ ইঞ্জিনিয়ার তার মতামত দিয়েছেন। কিন্তু রাজ্য সরকারের চিফ ইঞ্জিনিয়ার বা জয়েন্ট সেক্রেটারির কাছে দু-একটি ছোট টেকনিক্যাল ইনপুট ছাড়া কিছু চাওয়া হয়নি। অনলাইন বৈঠকে এবং পরে ই-মেইল মারফত আমাদের দুই একটি ছোট টেকনিক্যাল ইনপুট ছাড়া এই রিপোর্টে আর কিছু প্রতিফলিত হয়নি। এই রিপোর্ট পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সাময়িক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলনের কোনো প্রয়াস করে না। এই রিপোর্টে কয়েকজন প্রকৌশলী তাদের কিছু টেকনিক্যাল মতামত দেয়। যেখানে তিস্তা, পুনর্ভবা, আত্রেয়ীসহ রাজ্যের উত্তরবঙ্গ ও মধ্যবঙ্গের মধ্য দিয়ে যে-সব নদী পশ্চিমবঙ্গ হয়ে বাংলাদেশে যায় তার উল্লেখ মাত্র নেই।

আলাপন আরও জানান, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ভারত সরকারের জলশক্তি মন্ত্রণালয় এই কমিটির রিপোর্ট পাওয়ার পর সেই মন্ত্রণালয় পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে কোনো চিঠি দেয়নি, এ বিষয়ে কোনো যোগাযোগকারী টিম পাঠায়নি বা কোনো আলোচনা করেনি।

মুখ্যমন্ত্রীর প্রধান উপদেষ্টা আরও জানান, মমতা ব্যানার্জি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে যে-সকল গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক পানিবণ্টন সম্পর্কিত এবং রাজ্যের মানুষের অন্ন, বস্ত্র, সংস্থানের সাথে যুক্ত নদী ক্ষয়, নদী ভাঙনজনিত যে সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার কথা তুলে ধরেছেন, টেকনিক্যাল রিপোর্টে সেসব উল্লেখ নেই। তাছাড়া এই বিষয়ে কেন্দ্রীয় জলশক্তি মন্ত্রণালয় পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে কোনো বিষয়ে জানায়নি।

আলাপনের দাবি, ভারত-বাংলাদেশ চুক্তি বা সামগ্রিকভাবে ভারত-বাংলাদেশ পানি বণ্টন ইস্যুকে নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ ও ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের নীতি নির্ধারক ও নীতি নির্ণায়ক স্তরে কোনো যোগাযোগ নেই।

উল্লেখ্য, গত শনিবার বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিল্লি সফরকালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ঘোষণা দেন, ২০২৬ সালের গঙ্গা নদীর পানি বণ্টন চুক্তির মেয়াদ উত্তীর্ণ হবে। তার পুনর্নবীকরণের জন্য উভয় দেশের কারিগরি বিশেষজ্ঞরা আলোচনা শুরু করবেন। একইসঙ্গে তিনি এটাও জানান, তিস্তা উন্নয়ন প্রকল্প সমীক্ষার ব্যাপারে ভারতের একটি কারিগরি দল খুব শিগগিরই বাংলাদেশ সফর করবে।

বাংলাদেশের সাথে গঙ্গা কিংবা তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই আপত্তি জানিয়ে আসছেন মমতা ব্যানার্জি। তার বক্তব্য, ফারাক্কা চুক্তির কারণে আমরা ১৯৯৬ সাল থেকে কষ্ট ভোগ করছি। বাংলার পানি বিক্রি দেওয়ার অর্থ হলো আগামী দিন গঙ্গার ভাঙন বাড়বে, মানুষের ঘরবাড়ি পানির তলায় তলিয়ে যাবে। এমনিতে ফারাক্কায় ড্রেজিং না করার ফলে কলকাতা বন্দরের নাব্যতা কমে গেছে, টান পড়েছে লাখ লাখ মানুষের জীবিকায়। আবার তিস্তার পানি নিয়ে তার অভিমত তিস্তায় পানি নেই। ওখান থেকে পানি দিলে উত্তরবঙ্গের একাংশের মানুষ আগামী দিনে খাবার পানি পাবে না, বিশাল অংশের মানুষের কৃষি কাজে সমস্যা হবে। অর্থাৎ রাজ্যের স্বার্থ ক্ষুণ্ন করে কোনোভাবেই পানি দেওয়া সম্ভব নয়।

মোদিকে লেখা তিন পাতার চিঠিতেও গোটা বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত উল্লেখ করে মমতা লেখেন, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সাম্প্রতিক ভারত সফরে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সাথে অনুষ্ঠিত বৈঠকে গঙ্গা ও তিস্তা নদীর পানি বণ্টন নিয়ে আলোচনা হয়েছে। রাজ্য সরকারের পরামর্শ ও মতামত ছাড়া এ ধরনের একতরফা আলোচনা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য বা কাম্য নয়।

মমতার অভিমত, এ ধরনের চুক্তির প্রভাবে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আমি বুঝতে পেরেছি যে, ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার ভারত-বাংলাদেশ ফারাক্কা চুক্তি (১৯৯৬) পুনঃনবীকরণের প্রক্রিয়াধীন অবস্থায় রয়েছে, কারণ এই চুক্তির মেয়াদ ২০২৬ সালে শেষ হবে। এটি এমন একটি চুক্তি যা বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে পানি বণ্টনের নীতিগুলি বর্ণনা করে এবং আপনি জানেন, রাজ্যের মানুষের জীবন-জীবিকা বজায় রাখার জন্য ফারাক্কা থেকে পাওয়া পানির বিশাল প্রভাব রয়েছে এবং ফারাক্কা ফিডার ক্যানেল এর মাধ্যমে যে পানি আসে তা কলকাতা বন্দরের নাব্যতা বজায় রাখতে সাহায্য করে। তা না হলে গঙ্গায় পলি পড়ে কলকাতা বন্দর তার জাহাজ চলাচলের উপযোগী নাব্যতা হারাবে।

বিডিপ্রতিদিন/কবিরুল

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর