১ জুলাই, ২০২৪ ১১:১০

ইসরায়েলের বিরুদ্ধে পূর্ণমাত্রার যুদ্ধের জন্য কতটা সক্ষম হিজবুল্লাহ?

অনলাইন ডেস্ক

ইসরায়েলের বিরুদ্ধে পূর্ণমাত্রার যুদ্ধের জন্য কতটা সক্ষম হিজবুল্লাহ?

গত বছরের ৭ অক্টোবর থেকে ফিলিস্তিনের গাজায় নির্বিচারে আগ্রাসন শুরু করে ইসরায়েল। এই যুদ্ধের শুরু থেকেই ইসরায়েল-লেবানন সীমান্তেও উত্তেজনা দেখা দেয়। স্বল্পমাত্রায় সংঘাতে লিপ্ত ইসরায়েলি বাহিনী ও লেবানন প্রতিরোধ গোষ্ঠী হিজবুল্লাহ। দীর্ঘ প্রায় নয় মাস ধরে চলা স্বল্পমাত্রার সংঘাতের পর ইসরায়েল ও লেবাননের সশস্ত্র দল হিজবুল্লাহ যুদ্ধের হুমকি দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তাদেরকে শান্ত থাকার জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে এবং কূটনৈতিক সমাধানে তারা আশাবাদী। তবে তারা এ পর্যন্ত সফল হয়নি এবং রাজনৈতিক উপায়ে সমাধানের সময়ও শেষ হতে চলেছে।

যুদ্ধ শুরু হলে ইসরায়েলকে লেবাননে গাজা উপত্যকায় হামাসের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী শত্রুর মুখোমুখি হতে হবে।

হিজবুল্লাহ নেতা হাসান নাসরাল্লাহ গত সপ্তাহে ইসরায়েলকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন- তার গোষ্ঠীর কাছে নতুন অস্ত্র ও ক্ষমতা রয়েছে। তারা নজরদারি ড্রোনের সাহায্যে উত্তর ইসরায়েলের অত্যন্ত গভীর থেকে হাইফা বন্দরের ভিডিও ফুটেজ তুলেছে এবং লেবানন-ইসরায়েল সীমান্ত থেকে দূরের সাইটগুলোর ভিডিও করে তা প্রকাশ করেছে।

এক নজরে দেখে নেওয়া যাক হিজবুল্লাহ কীভাবে ওই অঞ্চলের সবচেয়ে শক্তিশালী নন-স্ট্রেট বা অ-রাষ্ট্রীয় শক্তি হয়ে উঠল।

হিজবুল্লাহ কী?

হিজবুল্লাহ ১৯৮২ সালে লেবাননের গৃহযুদ্ধের সময় প্রতিষ্ঠিত হয়। হিজবুল্লাহর প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল লেবাননের দক্ষিণাঞ্চলে ইসরায়েলের দখলদারিত্বের অবসান ঘটানো এবং তারা ২০০০ সালে ওই লক্ষ্য অর্জনে সমর্থ হয়।

শিয়া মুসলিম হিজবুল্লাহ ‘অ্যাক্সিস অব রেসিস্ট্যান্স’ নামে পরিচিত ইরান-সমর্থিত কয়েকটি গোষ্ঠী এবং সরকারের জোটের অংশ। হিজবুল্লাহ ছিল প্রথম গ্রুপ যাদের ইরান সমর্থন দেয় এবং তাদের রাজনৈতিক ইসলামবাদকে প্রসারিত করার উপায় হিসেবে ব্যবহার করেছিল।

প্রথম দিকে এই গোষ্ঠীটি আমেরিকার লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালিয়েছে, ফলে ওয়াশিংটন হিজবুল্লাহকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করে।

‘ইরানের সমর্থন হিজবুল্লাহকে লেবাননের সবচেয়ে শক্তিশালী রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে এবং সারা মধ্যপ্রাচ্যে সবচেয়ে সুসজ্জিত সামরিক দল হিসেবে তার অবস্থান সুসংহত করতে সাহায্য করেছে,’ বলেন লন্ডনের সোয়াস মিডল ইস্ট ইনস্টিটিউটের পরিচালক লিনা খাতিব।

ইসরায়েলের সাথে লড়াই

হিজবুল্লাহ যোদ্ধারা ২০০৬ সালে টহলরত একটি ইসরায়েলি সেনাদলের ওপর অতর্কিত হামলা চালিয়ে দুই ইসরায়েলি সেনাকে পণবন্দী করে নিয়ে যায়। হিজবুল্লাহ এবং ইসরায়েল মাসব্যাপী এক যুদ্ধে লিপ্ত হয়, যাতে কোনওপক্ষই জয় অর্জন করতে পারেনি। তবে ইসরায়েলের বোমাবর্ষণে দক্ষিণ লেবাননে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ হয়েছিল।

ইসরায়েলের উদ্দেশ্য ছিল হিজবুল্লাহকে নির্মূল করা কিন্তু লেবাননের এই গোষ্ঠীটি আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে এবং ইসরায়েলের উত্তর সীমান্তে হিজবুল্লাহ একটি প্রধান সামরিক ও রাজনৈতিক শক্তি হয়ে দাঁড়ায়।

তবে লেবাননের বিরোধী দলগুলো হিজবুল্লাহর অস্ত্রাগার বজায় রাখা এবং সরকারের উপর তাদের আধিপত্য বিস্তার করার জন্য সমালোচনা করে আসছে। লেবানন সরকার তার বেসরকারি টেলিযোগাযোগ নেটওয়ার্কের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার পরে ২০০৮ সালের মে মাসে হিজবুল্লাহ বৈরুতের একটি অংশ কিছু সময়ের জন্য দখল করে নেয়। ওই সময় হিজবুল্লাহর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয়েছিল।

হিজবুল্লাহর সামরিক সক্ষমতাও বেড়েছে এবং তারা সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদকে ক্ষমতায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তারা সিরিয়া ও ইরাকে ইরান-সমর্থিত মিলিশিয়াদের পাশাপাশি ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীদের প্রশিক্ষণ দিতে সহায়তা করেছে।

হিজবুল্লাহর সামরিক সক্ষমতা কতটুকু?

ইসরায়েলের সাথে তাদের সর্বসাম্প্রতিক সংঘাতের সময় হিজবুল্লাহ ধীরে ধীরে তার অস্ত্রাগারে নতুন আধুনিক অস্ত্র দিয়ে অস্ত্রসম্ভার প্রবর্তন করেছে। বিশেষ করে মে মাসের শুরুতে ইসরায়েল গাজার দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর রাফায় স্থল আক্রমণ শুরু করার পরে।

হিজবুল্লাহ প্রাথমিক পর্যায়ে কর্নেট ট্যাঙ্ক-বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র এবং কাটিউশা রকেট নিক্ষেপ শুরু করলেও, পরে তারা ভারী ওয়ারহেডযুক্ত রকেট ব্যবহার করতে শুরু করে এবং পরিশেষে প্রথমবারের মতো বিস্ফোরক ভর্তি ড্রোন এবং ভূমি থেকে আকাশে নিক্ষেপযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র ছোঁড়া শুরু করেছে।

ড্রোনগুলো স্থানীয়ভাবে তৈরি এবং অনেক সংখ্যক ড্রোন তাদের হাতে রয়েছে।

হিজবুল্লাহ ড্রোন থেকে তোলা হাইফা এবং ইসরায়েলের উত্তরাঞ্চলের নানা সাইটগুলোর দুটি ভিডিও বিশেষভাবে প্রকাশ করেছে। তারা তাদের নতুন পদ্ধতি ব্যবহার এবং সক্ষমতা প্রদর্শন করেছে এটাই তুলে ধরতে যে তারা ইসরায়েলি আক্রমণ প্রতিরোধ করতে সক্ষম এবং সে উদ্দেশে গুরুত্বপূর্ণ বেসামরিক ও সামরিক অবকাঠামোগুলোর ভিডিও তারা দেখিয়েছে।

গত সপ্তাহে টেলিভিশনে সম্প্রচারিত এক ভাষণে নাসরাল্লাহ বলেন, হিজবুল্লাহ এই কৌশল অব্যাহত রাখবে।

“এখন আমাদের নতুন অস্ত্র আছে তবে সেগুলো কী তা আমি বলব না,” তিনি বলেন।

“যখন সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে, তখন সেগুলোকে রণাঙ্গনে দেখা যাবে,” যোগ করেন তিনি।

ইরান-সমর্থিত অন্যান্য গোষ্ঠীর সাথে হিজবুল্লাহর তুলনা কেমন?

হিজবুল্লাহ আরব বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আধা-সামরিক বাহিনী যার শক্তিশালী একটি অভ্যন্তরীণ সাংগাঠনিক কাঠামোর পাশাপাশি একটি বড় অস্ত্রাগার রয়েছে। ইসরায়েল হিজবুল্লাহকে তার প্রতি সবচেয়ে সরাসরি হুমকি হিসেবে দেখে এবং অনুমান করে যে তাদের কাছে প্রেসিশন গাইডেড বা নির্ভুলভাবে-নিয়ন্ত্রিত ক্ষেপণাস্ত্রসহ ১ লাখ ৫০ হাজার রকেট এবং ক্ষেপণাস্ত্রের একটি অস্ত্রাগার রয়েছে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে হিজবুল্লাহ ইরানের মিত্র প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদকে সশস্ত্র বিরোধী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সহায়তা করার জন্য সিরিয়ায় সেনা পাঠিয়েছে। এরা ইরাক, ইয়েমেন ও সিরিয়ায় ইরান-সমর্থিত মিলিশিয়াদের শক্তিশালী করতে সাহায্য করেছে।

লন্ডনের সোয়াস মিডল ইস্ট ইনস্টিটিউটের খতিব হিজবুল্লাহকে ইরান সমর্থিত গোষ্ঠীগুলোর ‘বড় ভাই’র সাথে তুলনা করেছেন, যাদের একই পর্যায়ের অবকাঠামো বা শৃঙ্খলা নেই।

হিজবুল্লাহ মতবাদের ভিত্তিতে ইরানের সাথে সংশ্লিষ্ট। তবে সুন্নি মুসলিম ব্রাদারহুড আন্দোলনের শাখা হামাসের সাথে তাদের সম্পর্ক বাস্তববাদের ওপর প্রতিষ্ঠিত।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে হামাসের সাবেক সেকেন্ড-ইন-কমান্ড সালেহ আল-আরুরিসহ কিছু কর্মকর্তা লেবাননে চলে গেছেন। সেখানে তারা হিজবুল্লাহর নিরাপত্তা পাচ্ছেন এবং লেবাননের একাধিক ফিলিস্তিনি শরণার্থী শিবিরে তারা যেতে পারছেন। জানুয়ারি মাসে বৈরুতের দক্ষিণাঞ্চলীয় একটি শহরতলিতে ইসরায়েলি ড্রোন হামলায় আরুরি নিহত হন।

কে এই হাসান নাসরাল্লাহ?

নাসরাল্লাহ ১৯৬০ সালে বৈরুতের শহরতলী বুর্জ হাম্মুদে একটি দরিদ্র শিয়া পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। কিন্তু সেখান থেকে পরে বাস্তুচ্যুত হয়ে লেবাননের দক্ষিণাঞ্চলে যান। নাসরাল্লাহ ধর্মতত্ত্ব নিয়ে পড়াশুনা করেন এবং হিজবুল্লাহর প্রতিষ্ঠাতাদের একজন হওয়ার আগে তিনি শিয়া রাজনৈতিক ও আধা-সামরিক সংগঠন আমাল আন্দোলনে যোগ দেন।

ইসরায়েলের এক হামলায় ১৯৯২ সালে তার পূর্বসূরি নিহত হওয়ার পর তিনি হিজবুল্লাহ গ্রুপের নেতা হন।

লেবাননের দক্ষিণাঞ্চল থেকে ইসরায়েলের প্রত্যাহার এবং ২০০৬ সালের যুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য নাসরাল্লাহ ব্যাপকভাবে জনপ্রিয়। তার প্রতিকৃতি লেবানন, সিরিয়া ও আরব বিশ্বের অন্যান্য দেশে স্যুভেনিয়ের দোকানগুলোতে বিলবোর্ড এবং গ্যাজেটগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে।

তবে তিনি লেবাননের অনেকের থেকেও বিরোধিতার মুখোমুখি হন, যারা তার বিরুদ্ধে ইরানের সাথে লেবাননের ভাগ্যকে জড়ানোর অভিযোগ তোলেন।

নাসরাল্লাহকে বাস্তববাদী বলেও বিবেচনা করা হয়, যিনি রাজনৈতিক সমঝোতা করতে সক্ষম।

তিনি ইসরায়েলের গুপ্তহত্যার ভয়ে বছরের পর বছর ইচ্ছাকৃতভাবে গোপন স্থানে বসবাস করছেন এবং অজ্ঞাত স্থান থেকে তার বক্তৃতা দিচ্ছেন। সূত্র: ভয়েস অব আমেরিকা

বিডি প্রতিদিন/একেএ

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর