৮ জুলাই, ২০২৪ ২১:১৬

তিস্তার পানি ও চুক্তি নিয়ে যা বললেন মমতা ব্যানার্জি

দীপক দেবনাথ, কলকাতা

তিস্তার পানি ও চুক্তি নিয়ে যা বললেন মমতা ব্যানার্জি

মমতা ব্যানার্জি

বর্ষার পানি দেখে আমরা যেন তিস্তা নদীর পানির পরিমাণের বিষয়টি না ভাবি। প্রতিবেশী বাংলাদেশকে তিস্তা নদীর পানি বন্টন নিয়ে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারকে এই পরামর্শ পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির। 

মমতা আরো অভিযোগ করেছেন যে, বাংলাকে না জানিয়ে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার বাংলাদেশের সাথে ফারাক্কা চুক্তি পুনর্নবীকরণ করতে চাইছে, একই সাথে তিস্তার পানিও দিতে চাইছে। 

সোমবার রাজ্য সরকারের সচিবালায় নবান্নে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি।

মুখ্যমন্ত্রী মমতা বলেন, ‘বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সাথে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর যে কথা হলো আমাদের কাউকে জানানো হলো না। খুবই দুর্ভাগ্যজনক। যাইহোক, আবার বলছে তিস্তার পানি দিয়ে দেব। তিস্তায় কি পানি আছে যে দেবে? তাহলে তো আমাদের রাজ্যের উত্তরবঙ্গের মানুষ খাবার পানি পাবে না। বর্ষার পানি দেখে যেন আমরা পানির কথা না ভাবি।’ 

এ সময় সিকিমে তিস্তা নদীর উপর জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের বিষয়টি উত্থাপন করে মমতা বলেন, ‘সিকিমের ওখানে তিস্তার উপরে ১৪টা হাইড্রো পাওয়ার (জলবিদ্যুৎ) করেছে তাতে সমস্ত পানি টেনে নিয়েছে। যখন সিকিম ওই জলবিদ্যুৎ প্রকল্প করলো, তখন কেন্দ্রীয় সরকারের সযত্ন হওয়া উচিত ছিল। ওরা জানে যে সিকিম বা অরুনাচল সীমান্ত কতটা ভয়ানক আমাদের দেশের জন্য। কিন্তু সরকারের কোনো মনিটরিং সিস্টেম নেই। আমরা বারবার বিষয়টি জানিয়েছে, কিন্তু কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। যার জন্য মানুষকে আজও সমস্যার মুখোমুখি হতে হচ্ছে।’ 

গঙ্গা নদীর ভাঙ্গন রোধে কেন্দ্রীয় সরকারকে নিশানা করে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘গঙ্গার ভাঙ্গন রোধের বিষয়টি ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের দেখার কথা। কিন্তু দীর্ঘ ১২ বছর ধরে তারা দেখছে না। গঙ্গার ভাঙ্গন রোধে তারা এক পয়সাও খরচ করেনি। ফারাক্কাতেও ড্রেজিং করেনি। বাংলাদেশের সাথে যখন আমাদের চুক্তি হয়েছিল তখন কথা ছিল বাংলাদেশের দিকে যে পানিটা যাচ্ছে সেটাকে যাতে রিভাইভ করা হয়, যাতে আমাদের এখানে কোনো সমস্যা তৈরি না হয়। ড্রেজিং করা, ভাঙ্গন রোধ, এলাকার উন্নয়নের জন্য ৭০০ কোটি রুপির একটা প্যাকেজ তৈরি হয়েছিল। আমি তখন সাংসদ ছিলাম, আমি ঘটনাটা জানতাম। কিন্তু আজ পর্যন্ত সেই অর্থ দেয়নি। উপরন্ত আমাদের না জানিয়ে আবার বলছে ফারাক্কা চুক্তি পুনর্নবীকরণ করবে।’

মমতার অভিমত ফারাক্কায় ড্রেজিং না করার ফলে শুধু বাংলায় ক্ষতি হয় না, বিহারও বন্যায় ভেসে যায়। কিন্তু সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত আমরা।  

সংবাদ সম্মেলন থেকে পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার বালুরঘাটের উপর দিয়ে বয়ে চলা আত্রেয়ী নদীর উপর বাংলাদেশের তরফে তাদের সীমানায় বাঁধ দেওয়া নিয়েও কেন্দ্রীয় সরকারের পাশাপাশি প্রতিবেশী দেশকে নিশানা করেছেন মমতা। 

এদিন মমতা বলেন, ‘আত্রেয়ী নদীর উপরে যে বাঁধটা দেওয়া হয়েছে-বাংলাদেশ এবং চীন মিলে সেটা করার সময় আমাদেরকে জানানো হয়নি। আর তাতে কিন্তু অনেক অনেক মানুষ খাবার পানি পাচ্ছে না। পানির একটা তীব্র সংকট তৈরি হয়েছে। আমি এই বিষয়টি ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে অনেকবার বলেছি। তাছাড়া পূর্বের ভারত-বাংলাদেশ যে বৈঠকগুলোতে আমাকে ডাকা হতো, সেখানে আমি বারবার এই বিষয়টি উত্থাপন করেছি। কিন্তু তা সত্বেও আজ পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।’

মমতার অভিমত ‘রাজ্যের জলপাইগুড়ি শহরের মানুষরা নিশ্চয়ই জানে যে আগে করোলা নদীর পানিতে কিভাবে ভেসে যেত। আমরা বিশ কোটি রুপি খরচ করে করোলা নদীর উপর প্রজেক্ট তৈরি করে ভাঙ্গনটা কিছুটা রোধ করতে পেরেছি। কিন্তু ভুটান থেকে পানি চলে আসার ফলে আলিপুরদুয়ার, জলপাইগুড়ি ভেসে যায়। তার সাথে যুক্ত হয় বৃষ্টির পানি। সবকিছু মিলেমিশে বন্যায় পরিণত হয়। সেই কারণে আমরাই বেশি ভুক্তভোগী।’

গত ২২ জুন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিল্লি সফরে দুই দেশের মধ্যে ১০ চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। ওই দিন দিল্লিতে হায়দরাবাদ হাউসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ঘোষণা দেন তিস্তা উন্নয়ন প্রকল্প সমীক্ষার ব্যাপারে ভারতের একটি কারিগরি দল খুব শিগগিরই বাংলাদেশ সফর করবে। একই সঙ্গে তিনি এও জানান, ২০২৬ সালের গঙ্গা নদীর পানি বন্টন চুক্তির মেয়াদ উত্তীর্ণ হবে। তার পুনর্নবীকরণের জন্য উভয় দেশের কারিগরি বিশেষজ্ঞরা আলোচনা শুরু করবেন। 

এরপরই এই ইস্যুতে সপ্তাখানেক আগেই কেন্দ্রীয় সরকারকে নিশানা করেছিলেন মমতা। মমতার অভিযোগ ছিল বাংলাকে না জানিয়েই ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার বাংলাদেশকে পানি বিক্রি করতে চাইছে। হুঁশিয়ারি দিয়ে মমতা এও বলেছিলেন, ‘কেন্দ্র যদি একতরফাভাবে সিদ্ধান্ত নেয় তবে তার প্রতিবাদে গোটা দেশজুড়ে বড় আন্দোলন গড়ে তোলা হবে।’ 

বিষয়টি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে চিঠিও লিখেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। যদিও ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তরফে মমতার ওই অভিযোগকে ‘ভিত্তিহীন’ বলে দাবি করেছে, মন্ত্রণালয় থেকে পরিষ্কার জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল ‘মমতা ব্যানার্জির সরকারের প্রতিনিধির সাথে আলোচনা করেই সরকার এই ইস্যুতে সমস্ত সিদ্ধান্ত নিচ্ছে।’

উল্লেখ্য, ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে গঙ্গার পানি বণ্টনের চুক্তি স্বাক্ষরিত হলেও আলোচনায় রয়েছে আরও একাধিক নদী। যার মধ্যে অন্যতম তিস্তার পানি চুক্তি বন্টন। ২০১১ সালে তিস্তা চুক্তির স্বাক্ষরের ব্যাপারে সমস্ত প্রস্তুতি নেওয়া হলেও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির বিরোধিতায় সেই চুক্তি বাস্তবে রূপ নেয়নি বলে মনে করা হয়। 

রাজ্যের স্বার্থ দেখিয়ে ২০১১ সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং-এর সাথে ঢাকার সফর সঙ্গী হননি মমতা ব্যানার্জি। ফলে ওই সফরে তিস্তা চুক্তি বাস্তবায়নের সম্ভাবনা থাকলেও তা সফল হয়নি। এরপর নানা সময়ে ভারত সরকারের তরফে একাধিকবার প্রচেষ্টা নিলেও মমতা রাজ্যের স্বার্থ দেখিয়ে সেই চুক্তিতে সহমত পোষণ করেননি। বছর কয়েক আগেই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিল্লি সফরকালে তার সাথে একান্ত বৈঠক করেছিলেন মমতা। সে সময় তিস্তার পানির বদলে বিকল্প নদীর পানি দেওয়ার প্রস্তাব দেন তৃণমূল নেত্রী। কিন্তু বাংলাদেশ মমতার সেই প্রস্তাবে রাজি হয়নি। 

বিডি-প্রতিদিন/বাজিত

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর