২ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ ১৯:৪৬

রবিবার ‌‌‘রাত দখলের পর’ সোমবার জুনিয়র ডাক্তারদের লালবাজার অভিযান

দীপক দেবনাথ, কলকাতা

রবিবার ‌‌‘রাত দখলের পর’ সোমবার জুনিয়র ডাক্তারদের লালবাজার অভিযান

রাত তখন ১ টা! সাধারণত এই সময় কলকাতার প্রাণকেন্দ্র ধর্মতলার রানী রাসমণি অ্যাভিনিউ সুনসান হয়ে যায়। রাস্তায় বাস, সিএনজি বা অন্য পাবলিক ট্রান্সপোর্ট তেমন থাকে না বললেই চলে। মানুষের আনাগোনা তো থাকেই না। কিন্তু রবিবারের রাত ছিল সম্পূর্ণ আলাদা। থিকথিক করছিল ধর্মতলা চত্বর। চারিদিকে অসংখ্য কালো মাথা। সবারই একটাই দাবি ন্যায় বিচার! 

ন্যায় বিচারের দাবিতে গতকাল রাত দখলে নেমেছিল নাগরিক সমাজ। সাধারণ মানুষের পাশাপাশি রাত দখলে সামিল হয়েছিলেন টলিউডের তারকারাও। সোহিনী সরকার, উষসী চক্রবর্তী, বিদিপ্তা চক্রবর্তী, বিরসা দাশগুপ্ত, দেবলীনা দত্ত, স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায় কে নেই! 

সেই মঞ্চ থেকেই মিউজিক সিস্টেমে বেজে উঠল ইথুন বাবুর লেখা সেই প্রতিবাদী গান। 'ও দেশটা তোমার বাপের নাকি করছো ছলাকলা, কিছু বললেই ধরছো চেপে জনগণের গলা।' সেই গানের তালে তালে কেউ গলা মেলালেন, কেউবা হাততালি দিয়ে অন্য আন্দোলনকারীদের উৎসাহিত করলেন। 

গান গাওয়ার পাশাপাশি পথনাটিকা, সড়কের উপর স্লোগান লিখে, মোবাইলের ফ্ল্যাশ লাইট জ্বালিয়ে আন্দোলনের মাত্রাকে আরো তীব্রতর করতে দেখা গেল। কেউ কেউ আবার গেয়ে উঠলেন 'উই শ্যাল ওভারকাম, আমরা করব জয়।' অর্থাৎ প্রতিবাদের ভাষা কখনও স্লোগান, গান, পথনাটিকা। তবে এই রাত দখলে কোন দলীয় পতাকা ছিল না। তবে অনেকের হাতেই দেখা গেছে ভারতের জাতীয় পতাকা। 

আন্দোলনকারীদের হাতে ছিল পোস্টার, প্ল্যাকার্ড- যেখানে লেখা 'শেষ না দেখে ছাড়বো না', 'আমাদের একটাই স্বর, জাস্টিস ফর আরজিকর',  'বিচার চাইতে লড়াই করো, আরজিকরের মাথা ধরো,' আমার রাতটা আমার থাক, ধর্ষকরা নিপাত যাক'। 

রবিবার রাতে কলকাতার ধর্মতলার আন্দোলন মঞ্চের পাশাপাশি সোমবার বিকালে কলকাতা পুলিশের সদর দপ্তর লালবাজার অভিযানে অংশ নেওয়া জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলনেও উচ্চারিত হলো সেই প্রতিবাদী গান। 

গত ৯ আগস্ট কলকাতার আরজিকর মেডিকেল কলেজ এবং হাসপাতাল কর্তব্যরত অবস্থায় মৃত্যু হয় এক তরুণী ডাক্তারের। ওই ঘটনার পর প্রায় ২৪ দিন কেটে গেলেও এখনো ন্যায় বিচার অধরা। গোটা রাজ্যজুড়ে প্রতিবাদ, আন্দোলন, বিক্ষোভ চলছেই। তারই মাঝে রবিবার এই রাত দখল কর্মসূচিতে যোগদান করে নাগরিক সমাজ। এর আগে গত ১৪ আগস্ট মধ্যরাতে রাত দখলের লড়াইয়ে নেমেছিল গোটা বাংলা। 

স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায় জানান 'আমাদের হয়তো খুব বেশি বুদ্ধি নেই। কিন্তু যেটুকু বুদ্ধি আছে তা দিয়ে এইটুকু বিশ্বাস করছি না যে ওই একটা লোকই পুরো কাণ্ডটা ঘটিয়েছে। তাই এই আই-ওয়াশ'কে আমরা কেউই বিশ্বাস করছি না। যেটা ঘটেছে সেই ঘটনার প্রেক্ষিতে আমাদের বিচার চাই। যে নির্যাতিতা মারা গেছে তার বাবা-মায়ের প্রতি সরকারের একটা দায়িত্ব ও দায়বদ্ধতা আছে যে অন্তত বিচারটা হোক।' 

ঊষসী চক্রবর্তী বলেন 'আমাদের রাজপথ ছাড়লে চলবে না। এটা আমার, আপনার, আমাদের সকলের বেঁচে থাকার লড়াই। সরকারি হাসপাতালে কর্তব্যরত চিকিৎসকের যদি সুরক্ষা না থাকে তবে আমার আপনাদের বাড়ির নারীদের কোন সুরক্ষা নেই। আমরা যদি রাজপথে না থাকি, এই ঘটনার যদি বিচার না হয়, তবে আমাদের বেঁচে থাকাটাই কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। ন্যায় বিচার পেয়ে তবেই আমরা থামবো।'

দেবলীনা দত্ত জানান, 'এখন একজন দাবার বোড়েকে লেভেনজুসের মতো ঝুলিয়ে আমাদেরকে শান্ত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। এটাতে আমরা শান্ত হবো না। আমরা চাই, রাজা, রানী, হাতি, ঘোড়া, জাহাজ সবাইকে ধরা হোক। সেটাই আমাদের দাবি। এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হোক।' সেই ন্যায়বিচার যতদিন না হচ্ছে ততদিন আমাদের আন্দোলন চলবে বলেও জানান দেবলীনা। 

বিদিপ্তা চক্রবর্তী জানান, '২৪ দিন হয়ে গেছে, গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে আমরা প্রতিকার চাইছি, সুবিচার চাইছি। আর কতদিন আমাদের রাস্তায় বসে থাকতে হবে, এটাই এখন দেখার!' 

অভিনেত্রী সোহিনী সরকার জানান, 'সরকারের তরফে মুখ বন্ধ করে সকলে বসে আছে। আমাদের রাজ্যের নারীদের সুরক্ষা নিয়ে যে সমস্যা সেটা নিয়ে তারা একটাও কথা বলছে না।' তার অভিমত 'শুধু কলকাতা নয় মহিলাদের জন্য কোন জায়গাই নিরাপদ নয়।' 

পুত্র সন্তান এবং স্বামীকে নিয়ে এই আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন এক নারী। বাবার কোলে সন্তানের হাতে ধরা ছোট্ট একটা প্ল্যাকার্ড যাতে লেখা 'আমাদের এক স্বর, জাস্টিস ফর আরজিকর। সল্টলেকের বাসিন্দা ওই নারী জানালেন '১৪ আগস্টের রাত দখলেও আমি বেরিয়েছিলাম। সারারাত ঘুরেছি। ঠিক সেভাবে আজকেও বেরিয়েছি এবং পারলে রোজই বেরোবো- যতদিন না আমি এর বিচার পাচ্ছি। আমার আর বাড়িতে বসে থাকা সম্ভব হচ্ছে না। আর সেই কারণেই আমি যেখানেই আন্দোলন হচ্ছে, পুত্র সন্তানকে সাথে নিয়ে সেখানেই যোগদান করছি।' তার অভিমত 'বিচার ব্যবস্থার উপর যে খুব একটা আশা আছে তা নয়, কিন্তু মানুষের উপর আশা আছে। যদি সোজা ভাবে বিচারব্যবস্থা না হয়, তবে ছিনিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থাটা করতে হবে। আর আমরা যদি চুপ করে যাই, তবে ওদের পক্ষে সবকিছু ধামাচাপা দিয়ে দেওয়াটা আরও সহজ হয়ে যাবে।' 

আমরা তিলোত্তমা মঞ্চ থেকে আরেক এক নারী আন্দোলনকারী জানিয়েছেন, 'আমাদের রাত দিন সমস্তটাই দখল করার কথা। তার কারণ শুধু রাতেই মেয়েরা সুরক্ষিত নয়, দিনে সুরক্ষিত- এমনটা নয়। সব সময় মেয়েরা অসুরক্ষিত। এতদিন ধরে আমরা কাকুতি মিনতি করে নিজেদের সুরক্ষার ভিক্ষা করে এসেছি, কিন্তু এখন আর সময় নেই। দেওয়ালে আমাদের পিঠ ঠেকে গেছে। আমরা আর ভিক্ষা করবো না। রাজপথের আকাশ বা পাড়ায় পাড়ায়, অলি গলির আকাশ হোক- একটাই কথা শোনা যাবে আমাদের অধিকার। এবার আমরা বুঝে নিতে শিখেছি। একজন চিৎকার করলে শোনা যায় না, তাই আমরা সকলে মিলে চিৎকার করছি, এবার নিশ্চয় শোনা যাবে।'  


জুনিয়র চিকিৎসকদের লালবাজার অভিযান:

এদিকে আরজিকর কাণ্ডে কলকাতা পুলিশের কমিশনার বিনীত গোয়েলের পদত্যাগ চেয়ে লালবাজার অভিযান করে জুনিয়র ডাক্তাররা। 
সোমবার দুপুর ২টা নাগাদ কলেজ স্কোয়ার থেকে মহাত্মা গান্ধী রোড, সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ, বিপিন বিহারী গাঙ্গুলী স্ট্রীট হয়ে লালবাজার অভিমুখের রওনা দেন জুনিয়র চিকিৎসকরা। আন্দোলনকারী চিকিৎসকদের হাতে ছিল লাল গোলাপ, রজনীগন্ধার মালা এবং শিরদাঁড়া। পুলিশ কমিশনারের হাতে সেই লাল গোলাপ তুলে দিয়ে তাকে বিদায় জানাবেন জুনিয়র ডাক্তাররা। 

জুনিয়র চিকিৎসকদের আটকাতে রাজ্যের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও ছিল প্রস্তুত। কলকাতা পুলিশের সদর দপ্তর লাল বাজারকে কার্যতো নিরাপত্তার চাদরে মুড়ে ফেলা হয়। লালবাজারে ঢোকার প্রতিটি প্রবেশ পথেই ৯ ফুটের উচ্চতার লোহার ব্যারিকেড দিয়ে ঘিরে ফেলা হয়। যাতে মাছিও গলতে না পারে। বউবাজার, কলেজ স্কোয়ার মুখে ব্যারিকেড মজবুত করতে লোহার শিকল দিয়ে বাঁধা হয়। পরে সেই শিকলে লাগিয়ে দেওয়া হয় তালা। যদিও সেই ব্যারিকেড ভাঙার চেষ্টা করেননি জুলিয়ার ডাক্তাররা। মিছিল শুরু হওয়ার কিছু পরেই বিবিগাঙ্গুলী ও ফিয়ার্স লেনের সংযোগস্থলে আটকে দেওয়া হয় জুনিয়র ডাক্তারদের সেই মিছিল। এরপর রাস্তায় বসে পড়ে অবস্থান শুরু করে আন্দোলনকারী চিকিৎসকরা। সেখান থেকেই আন্দোলনকারী ডাক্তারদের গলায় প্রতিবাদী সেই গান! 'ও দেশটা তোমার বাপের নাকি করছো ছলাকলা, কিছু বললেই ধরছো চেপে জনগণের গলা।' সেই গানের তালে তালে গলা মেলালেন অন্যরাও। তবে ডাক্তারদের পাশাপাশি অনেক সাধারণ মানুষকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে দেখা যায় এই মিছিলে যোগ দিতে। 

এরপর পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সাথে দফায় দফায় চলে আলোচনা। আন্দোলনকারী চিকিৎসার একটাই দাবি পুলিশ কমিশনারকে ইস্তফা দিতে হবে। 

আরজিকরের ঘটনার প্রতিবাদে এবং নারীদের সুরক্ষা দাবীতে গোটা রাজ্যজুড়ে সোমবার মহাকুমা শাসক জেলাশাসক, পুলিশ সুপার ও পুলিশ কমিশনারেটের কার্যালয় ঘেরাও ডাক দিয়েছিল বিজেপি। এই কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে কোচবিহারে পুলিশের সাথে ধস্তাধস্তি বেধে যায় বিজেপি কর্মী সমর্থকদের। এক সময় বিজেপি কর্মীদের হটাতে পুলিশকে লাঠিপেটা ও টিয়ার গ্যাসের সেল ফাটাতে হয়।। 

এদিকে মঙ্গলবার রাজ্য বিধানসভায় আনা হচ্ছে নারী ও শিশু নির্যাতন বিরোধী বিশেষ বিল। এই বিলের নাম দেওয়া হয়েছে 'অপরাজিতা উইমেন এন্ড চাইল্ড ওয়েস্ট বেঙ্গল ক্রিমিনাল ল সংশোধনী বিল ২০২৪'। মঙ্গলবার এই বিলটি বিধানসভায় উত্থাপন করবেন আইন মন্ত্রী মলয় ঘটক। এরপর বিলটি নিয়ে বিধানসভায় আলোচনা হবে। পরিশেষে তা পাস করানো হবে। 


বিডি প্রতিদিন/নাজমুল

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর