পূর্ব ইউক্রেনের বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত দুটি অঞ্চলকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার পর, সেখানে সেনা পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন। রাশিয়ার দাবি, সৈন্যরা স্ব-ঘোষিত গণপ্রজাতন্ত্র দোনেৎস্ক এবং লুহানস্কের ‘শান্তিরক্ষায়’ সেখানে নিয়োজিত থাকবে। তবে যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনসহ পশ্চিমা জোট বলছে, ‘শান্তিরক্ষার’ তকমা দিয়ে সেখানে যুদ্ধের প্রস্তুতি আরও জোরদার করছে রাশিয়া; সংকটকে আরও বাড়িয়ে তুলছে।
রাশিয়ার এ আচরণকে তিন দশক আগে অর্থাৎ ১৯৯১ সালে ভেঙে যাওয়া সোভিয়েত ইউনিয়ন পুনর্গঠনের গোপন পরিকল্পনা বলে অভিযোগ করেছেন ইউক্রেনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ওলেক্সি রেজনিকভ। তিনি গতকাল বলেন, ‘সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রকে ফের একত্র করার কাজ শুরু করেছে রাশিয়া।’
আমেরিকাসহ পশ্চিমা দুনিয়ার হুঁশিয়ারি অগ্রাহ্য করে প্রেসিডেন্ট পুতিন সোমবার রাতে ইউক্রেনের দুটি অঞ্চল দোনেৎস্ক এবং লুহানস্ককে (যাদের একত্রে ডনবাস বলা হয়) ‘স্বাধীন’ ঘোষণা করেন। তাঁর এ পদক্ষেপের ফলে পশ্চিমা-সমর্থিত ইউক্রেন সরকারের সঙ্গে রাশিয়ার সংঘাত শুরু হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।তবে যুক্তরাজ্য বলছে, ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন শুরু হয়ে গেছে। দেশটির স্বাস্থ্যমন্ত্রী সাজিদ জাভিদ স্কাই নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এ কথা বলেছেন। তার মন্তব্য, ‘আপনি উপসংহার টেনে বলতে পারেন, ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণ শুরু হয়ে গেছে। রাশিয়ানরা, প্রেসিডেন্ট পুতিন ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব এবং এর আঞ্চলিক অখন্ডতার ওপর আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছেন।’ আর যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন বলেছেন, পূর্ব ইউক্রেনের দুই অঞ্চলে সৈন্য পাঠানোর জেরে যুক্তরাজ্য শিগগিরই রাশিয়ার ওপর ‘কঠোর’ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হচ্ছে।
রাশিয়ার কর্মকান্ড নিয়ে ইতোমধ্যেই জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের দ্বারস্থ হয়েছে ইউক্রেন। প্রেসিডেন্ট ভোলোদিমির জেলেনস্কি রাশিয়ার এ সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে বলেন, ‘আমরা কাউকে ভয় পাই না। কোনো কিছুতেই ভয় পাই না। কারও কাছে বশ্যতা স্বীকার করব না, কারও হাতে কোনো কিছু তুলেও দেব না।’ রেজনিকভ মঙ্গলবার ইউক্রেন সেনার আধিকারিকদের সঙ্গে বৈঠকে ‘আগামী দিনে ত্যাগ এবং ক্ষয়ক্ষতির’ জন্য প্রস্তুত হওয়ার বার্তা দিয়েছেন।
পূর্ব ইউক্রেনের ডনবাস সামরিক অবস্থানগত দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। ওই এলাকা থেকে রুশ সেনার পক্ষে দ্রুত ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভে অভিযান চালানো সম্ভব বলে আমেরিকার নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট ন্যাটোর আশঙ্কা। রুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ ওই দুই অঞ্চল এখনো ইউক্রেন সেনার নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। তবে সেখানে রাশিয়ার সমর্থনপুষ্ট সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীগুলো সক্রিয়তা বাড়াচ্ছে বলে খবর।
সাবেক সোভিয়েতের আরেক প্রজাতন্ত্র বেলারুশে আগেই পৌঁছে গেছে রুশ সৈন্য। ইউক্রেন-বেলারুশ সীমান্তে যুদ্ধের মহড়াও শুরু করেছে। এ পরিস্থিতিতে সাঁড়াশি আক্রমণের মুখে ইউক্রেন সেনা কতটা প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারবে, তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। সম্ভাব্য রুশ আগ্রাসনের মোকাবিলায় পোল্যান্ড এবং জার্মানিতে বাড়তি সেনা মোতায়েন করেছে ন্যাটো। কিন্তু সামরিক দিক থেকে রাশিয়া সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে বলে মত প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞদের একাংশের। ইউক্রেনের দুই অঞ্চলকে ‘প্রজাতন্ত্র’ ঘোষণার পদক্ষেপকে তাঁর খেলার পুরনো চাল হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে সিএনএনের এক বিশ্লেষণে। গতকালের ওই বিশ্লেষণে বলা হয়, পূর্ব ইউক্রেন নিয়ে সর্বশেষ পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে পুতিন রাশিয়াকে সর্বাত্মক যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছেন।
পুতিন সোমবার যেসব ঘোষণা দিয়েছেন, তার ঠিক আগের ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণ করেছেন সিএনএনের নাথান হাজ। তাঁর মতে, পুতিন তাঁর দিনটিকে (সোমবার) একটি রাজনৈতিক নাটক হিসেবে সাজান। তিনি ক্রেমলিনে তাঁর জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের কর্মকর্তাদের নিয়ে একটি সভা করেন, যা টেলিভিশনে সম্প্রচারিত হয়। এ ধরনের সভা প্রকাশ্যে হয় না। ফলে, তা ছিল লোক দেখানো। সভা চলা অবস্থায় তিনি মূল ঘোষণায় যাওয়ার আগে দীর্ঘ বক্তৃতা দেন। এ বক্তৃতায় তিনি ইতিহাস তুলে ধরেন।
পুতিন তাঁর ভাষণে ইউক্রেনকে রাশিয়ার ইতিহাসের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, পূর্ব ইউক্রেন একসময় রাশিয়ার ভূমি ছিল। একটি সত্যিকারের জাতিরাষ্ট্র হওয়ার ইতিহাস ইউক্রেনের নেই। ইতিহাসের প্রতি পুতিনের আবেগ নতুন কিছু নয়। গত গ্রীষ্মে তিনি ৫ হাজারের বেশি শব্দের একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেছিলেন। এ প্রবন্ধ মূলত ইউক্রেনের রাষ্ট্র হওয়ার বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল।
এখন পুতিনের ইতিহাস-সম্পর্কিত আবেগ তাঁর দেশকে পশ্চিমাদের সঙ্গে প্রকাশ্য সংঘাতের একটি নতুন ও উচ্চতর পর্যায়ে নিয়ে গেছে। ইউক্রেনে যে সংকট চলছে, তা একটি বিপর্যয়কর নতুন যুদ্ধের হুমকি সৃষ্টি করেছে।