বৃহস্পতিবার, ৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

হিন্দুস্তান’, ‘মেলুয়া’, ‘জম্বুদ্বীপ’, পুরাণ থেকে বেদ, এক দেশের অনেক নাম

ভারত নাম ব্যবহারের উদ্দেশ্য যতটা রাজনৈতিক তার চেয়ে বেশি সাংস্কৃতিক

দেশের নাম নিয়েও বিতর্ক হতে পারে, কিছুদিন আগে পর্যন্তও যা ভাবা যেত না। কিন্তু বর্তমানে দেশের নাম ঘিরেই রাজনৈতিক উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে। সংবিধানে ‘ভারত’ এবং ‘ইন্ডিয়া’ দুটি নামই আছে। কিন্তু ক্ষমতাসীন বিজেপির তরফে সব বাদ দিয়ে দেশের নাম শুধু ‘ভারত’ রাখার দাবি উঠছে। এজন্য সংসদে বিশেষ অধিবেশন আহ্বান করা হয়েছে। সংসদে এখনো পর্যন্ত বিল পাস না হলেও, ইতোমধ্যে রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু স্বাক্ষরিত জি২০ সম্মেলনের নিমন্ত্রণপত্রে দেশকে ‘ভারত’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বহু ভাষাভাষীর মানুষের বাস ভারত। সেখানে সবার নাগরিক পরিচয় পাল্টে দেওয়ার এ প্রচেষ্টার তীব্র সমালোচনা করছেন বিরোধী থেকে সংবিধান বিশেষজ্ঞরা। এ প্রসঙ্গে ইতিহাস মনে করিয়ে দিচ্ছেন ইতিহাসবিদরাও। তাদের সাফ যুক্তি, বিশ্বের অন্য দেশের মতো ভারতেরও একাধিক নাম রয়েছে। ঋগবেদ থেকে দেশের সংবিধান, সর্বত্রই তার উল্লেখ চোখে পড়ে। ভাষা এবং সংস্কৃতির নিরিখে দেশের নাম কেউ ‘ভারত’, কেউ ‘হিন্দুস্তান’, কেউ আবার ‘ইন্ডিয়া’ বলেন এবং লেখেন। বেদ, পুরাণ, মহাকাব্যেও এ বিভিন্নতা লক্ষ্য করা যায়। বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনি থেকে মহাভারত দেশের নাম কোথাও ভারত, কোথাও ‘ভারাতা’, কোথাও আবার ‘ভারতবর্ষ’ লেখা রয়েছে। পুরাণে আবার- দক্ষিণের মহাসাগর এবং উত্তরের বরফের চাদরের মধ্যবর্তী স্থানের উল্লেখ রয়েছে ‘ভারাতা’ হিসেবে। এ প্রসঙ্গে সমাজ বিজ্ঞানী ক্যাথরিন ক্লেমেন্তিন-ওঝা যে যুক্তি তুলে ধরেছেন তা হলো, ভারত বা ভারাতা নাম ব্যবহারের উদ্দেশ্য যতটা না রাজনৈতিক এবং ভৌগলিক, তার চেয়ে অনেক বেশি সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক। উপমহাদেশের এ অংশে ব্রাহ্মণ্যবাদের আধিপত্য ছিল বরাবর। ২০১৪ সালে সেই নিয়ে ‘ইন্ডিয়া দ্যাট ইস ভারত...ওয়ান কাউন্ট্রি, টু নেমস’ নামে একটি প্রতিবেদনও লেখেন ক্যাথরিন। একই ভাবে, প্রাচীন ইতিহাসে রাজা ভরতের উল্লেখ মেলে। ঋগবেদে যে ভারাতা জাতির উল্লেখ রয়েছে, ভরত ছিলেন তাদের পূর্বপুরুষ। তাই উপমহাদেশকে ভারতও বলা হয়। আবার হিন্দু বলে পরিচয় দেন যারা, তাদের কেউ কেউ আবার দেশের নাম ‘হিন্দুস্তান’ রাখার পক্ষপাতী। যদিও হিন্দুস্তান নামটির উৎপত্তি হয় ভৌগোলিক অবস্থানের নিরিখে। সিন্ধু নদের তীরে গড়ে ওঠা সভ্যতাকে সিন্ধু সভ্যতা বলা হতো। ইরান এবং গ্রিকদের উচ্চারণে সিন্ধু হয়ে ওঠে ‘ইন্দাস’, ‘হিন্দোস’ এবং ‘ইন্দোস’। সেই থেকেই পরবর্তীকালে ‘হিন্দুস্তান’ নামের আবির্ভাব। আকিমিনীয় সাম্রাজ্যে খ্রিস্ট যুগের প্রথম শতকেই হিন্দুস্তান শব্দটির ব্যবহার চোখে পড়ে।

 সিন্ধু উপত্যকার অধিবাসীদের বোঝানো হতো তাতে। খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকে আলেকজান্ডার যখন এ দেশে পৌঁছন, সেই সময় সিন্ধু উপত্যকা পেরিয়েও বিস্তৃত অঞ্চলজুড়ে সিন্ধু সভ্যতার বিস্তার বলে জানা যায়। মুঘল শাসকদের আমলেও ‘হিন্দুস্তান’ নামে পরিচিত ছিল দেশ। ইন্দো-গাঙ্গেয় সমতলভূমিকেই বোঝানো হতো তার মাধ্যমে।

ব্রিটিশ শাসকরাই দেশের নাম ‘ইন্ডিয়া’ রাখে বলে দাবি উঠছে ইতিউতি। তবে এই দাবিও সর্বৈব সত্য নয়। এর বাইরেও উপমহাদেশের এ অংশ প্রাচীনকালে ‘মেলুয়া’ নামেও পরিচিত ছিল। প্রাচীন মেসোপটেমিয়া সভ্যতার যে লিপি পাওয়া যায়, তাতে সিন্ধু নদের তীরে গড়ে ওঠা সভ্যতাকে ‘মেলুয়া’ বলে উল্লেখ করা হয়।  জৈন সাহিত্যে আবার ভারতের উল্লেখ রয়েছে ‘নবীবর্ষ’ হিসেবে। রাজা ভরতের পিতামহ, রাজা নবী। তিনি প্রথম তীর্থঙ্কর হিসেবে গণ্য হন। তার নামানুসারেই উপমহাদেশকে ‘নবীবর্ষ’ বলা হতো বলে জানা যায়।

সর্বশেষ খবর