২৯ মে, ২০২৪ ০৮:১৫

সন্তানদের সঙ্গে বিশ্বনবী (সা.)

জাওয়াদ তাহের

সন্তানদের সঙ্গে বিশ্বনবী (সা.)

আমাদের প্রিয় নবীজি (সা.)-কে আল্লাহ তাআলা গুরুদায়িত্ব দিয়ে দুনিয়ায় পাঠিয়েছেন। তিনি ছিলেন আমাদের সবার চেতনার বাতিঘর। তাঁর জীবনের প্রতিটি পদচিহ্ন আমাদের জন্য আলোকবর্তিকা। সব কিছুর মধ্যেই তিনি আমাদের জন্য রেখে গেছেন অনন্য আদর্শ।

প্রিয় নবী (সা.) তাঁর স্ত্রী, সন্তান ও পুত্রদের সঙ্গে কেমন আচরণ করেছেন, তা সোনার হরফে লিপিবদ্ধ রয়েছে সিরাত গ্রন্থে। বিশ্বনবী (সা.) সন্তানদের সঙ্গে যে মধুর আচরণ করেছেন এবং তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে গড়ে তুলেছেন তাতে আছে আমাদের জন্য শিক্ষা।
 

সন্তানদের জন্য উত্তম নাম নির্বাচন

সন্তান জন্মগ্রহণের পর তার জন্য সুন্দর নাম রাখা পিতার কর্তব্য। আনাস ইবনে মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, আজ রাতে আমার ঘরে একটা পুত্রসন্তান জন্মগ্রহণ করেছে।

আমি আমার দাদার নামানুসারে তার নাম রেখেছি ইবরাহিম। (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস : ৩১১২)
 

সন্তানদের সঙ্গে সদাচার

আল্লাহ তাআলা বিশ্বনবী (সা.)-কে তিনজন পুত্রসন্তান ও চারজন কন্যাসন্তান দান করেছেন। পুত্ররা সবাই শৈশবেই মৃত্যুবরণ করেন। তিনি তাঁর কন্যাসন্তানকে অত্যন্ত আদর ও যত্নে লালন-পালন করেছেন।

নবী (সা.)-এর স্ত্রী আয়শা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা আমার কাছে একটি স্ত্রীলোক এলো। তখন তার সঙ্গে তার দুটি মেয়ে ছিল। সে আমার কাছে কিছু চাইল। সে একটি খেজুর ছাড়া আমার কাছে কিছু পেল না। আমি সেই খেজুরটিই তাকে দিলাম।

সে সেটি নিয়ে তা তার দুই মেয়েকে ভাগ করে দিল। নিজে তা থেকে কিছুই খেল না। এরপর সে উঠে চলে গেল। পরে নবী (সা.) আমার কাছে এলে তাঁর কাছে আমি ঘটনাটি বর্ণনা করলাম। তখন নবী (সা.) বললেন, যে ব্যক্তি কন্যাসন্তান লালন-পালনের পরীক্ষায় নিপতিত হয় আর তাদের সঙ্গে সে সদাচরণ করে, তার জন্য এরা জাহান্নামের পর্দা হবে। (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৬৪৫৪)


কন্যাকে ভালো জায়গায় পাত্রস্থ করা

কন্যাসন্তানকে উত্তমরূপে দিন শেখানো, তাকে উত্তম চরিত্রে গড়ে তোলা এবং উপযুক্ত জায়গায় পাত্রস্থ করা পিতার অপরিহার্য দায়িত্ব। প্রিয় নবী (সা.) তাঁর কন্যাদের উত্তমরূপে গড়ে তুলেছেন এবং উত্তম জায়গায় বিবাহের ব্যবস্থা করেছেন। তিনি তাঁর চার সন্তানকে ভালো জায়গায় পাত্রস্থ করেছেন।


দুনিয়াবিমুখতার শিক্ষা দান

একবার ফাতেমা (রা.) নবী (সা.)-এর কাছে কিছু প্রয়োজনের কথা বলে একজন খাদেম চাইলেন। কিন্তু নবী (সা.) তাঁদের খাদেম না দিয়ে এর চেয়ে উত্তম জিনিস শিক্ষা দিয়েছেন।

আলী (রা.) থেকে বর্ণিত, একবার গম পেষার চাক্কি ঘোরানোর কারণে ফাতেমা (রা.)-এর হাতে ফোসকা পড়ে গেল। তখন তিনি একটি খাদেম চেয়ে নেওয়ার উদ্দেশ্যে নবী (সা.)-এর কাছে এলেন। তিনি তাঁকে পেলেন না। তখন তিনি আসার উদ্দেশ্যটি আয়শা (রা.)-এর কাছে ব্যক্ত করে গেলেন। এরপর তিনি যখন ঘরে এলেন, তখন আয়শা (রা.) এ বিষয়টি নবীজিকে জানালেন। তারপর নবী (সা.) আমাদের কাছে এমন সময় এলেন, যখন আমরা বিছানায় বিশ্রাম নিচ্ছি। তখন আমি উঠতে চাইলে তিনি বললেন, নিজ জায়গাতেই থাকো। তারপর আমাদের মাঝখানেই তিনি এমনভাবে বসে গেলেন যে আমি তাঁর দুই পায়ের শীতল স্পর্শ আমার বুকে অনুভব করলাম। তিনি বললেন, আমি কি তোমাদের এমন একটি আমল বলে দেব না, যা তোমাদের জন্য একটি খাদেমের চেয়েও অনেক অনেক বেশি উত্তম? যখন তোমরা শয্যা গ্রহণ করতে যাবে, তখন তোমরা আল্লাহু আকবার ৩৩ বার, সুবহানাল্লাহ ৩৩ বার এবং আলহামদুলিল্লাহ ৩৩ বার পড়বে। এটা তোমাদের জন্য একটি খাদেমের চেয়েও অনেক বেশি মঙ্গলজনক।

(সহিহ বুখারি, হাদিস : ৫৮৭৯)

বস্তুত প্রিয় নবী (সা.) দুনিয়ার এই অল্প কষ্ট আর দুঃখকে কিছুই মনে করতেন না। এ জন্য তিনি সন্তানকে দুনিয়ার সুখ ও বিলাস থেকে মুখ ফিরিয়ে এই শিক্ষা দিলেন যে দুনিয়ার এই সামান্য কষ্ট সহ্য করার জন্য বরং এর চেয়ে উত্তম জিনিস পরকালের জন্য যা সঞ্চয় করা হয়।


সন্তানের বিচ্ছেদে ক্রন্দন

সন্তানের বিরহে রাসুলুল্লাহ (সা.) কেঁদেছেন। বিরহ-বেদনায় অশ্রু ঝরত তাঁর চোখের মণি থেকে। আনাস ইবনে মালিক (রা.) বলেন, আমরা রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গে আবু সায়ফ কর্মকারের কাছে গেলাম। তিনি ছিলেন (নবী তনয়) ইবরাহিম (রা.)-এর দুধ সম্পর্কীয় পিতা। রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁকে তুলে নিয়ে চুমু খেলেন এবং তাঁকে নাকে-মুখে লাগালেন। এরপর (আরেক দিন) আমরা তাঁর (আবু সায়ফের) বাড়িতে গেলাম। তখন ইবরাহিম (রা.) মুমূর্ষু অবস্থায়। এতে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর উভয় চোখ থেকে অশ্রু ঝরতে লাগল। তখন আব্দুর রহমান ইবনে আউফ (রা.) বললেন, হে আল্লাহর রাসুল! আর আপনিও (কাঁদছেন)? তখন তিনি বললেন, ইবনে আউফ, এ হচ্ছে মায়া-মমতা। তারপর পুনর্বার অশ্রু ঝরতে থাকল। এরপর তিনি বলেন, অশ্রু প্রবাহিত হয় আর হৃদয় হয় ব্যথিত। তবে আমরা মুখে তা-ই বলি, যা আমাদের রব পছন্দ করেন। আর হে ইবরাহিম! তোমার বিচ্ছেদে আমরা অবশ্যই শোকাভিভূত। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১২২৫)


কন্যার আগমনে অভ্যর্থনা

নবী (সা.)-এর কন্যারা যখন তাঁর সাক্ষাতে আসতেন তিনি তাঁদের সাদরে গ্রহণ করতেন এবং উষ্ণ অভ্যর্থনা জানাতেন। আয়শা (রা.) বলেন, একবার ফাতেমা (রা.) হাঁটতে হাঁটতে উপস্থিত হলেন, আর তাঁর হাঁটা ছিল নবী করিম (সা.)-এর হাঁটারই অনুরূপ। নবী করিম (সা.) তখন বলেন, মারহাবা! স্বাগত কন্যা আমার! অতঃপর তাঁকে স্বীয় ডান পাশে অথবা বাঁ পাশে বসিয়ে দিলেন।

(আল-আদাবুল মুফরাদ, হাদিস : ১০৩৮)


বিশেষ আমল শিক্ষাদান

সন্তানকে নবী (সা.) বিশেষভাবে আমল শিক্ষা দিয়েছেন। আনাস ইবনে মালিক (রা.) বলেন, একবার রাসুলুল্লাহ (সা.) ফাতেমা (রা)-কে বলেন, আমি তোমাকে সকালবেলা ও সন্ধ্যায় এই দোয়াটি পাঠের যে উপদেশ দিই, তা শুনতে তোমার বাধা কিসে? আর দোয়াটি হলো : ‘ইয়া হাইয়্যু ইয়া কাইয়্যুমু বিরহমাতিকা আস্তাগিস, আসলিহ লি শানি কুল্লাহ, ওলা তাকিলনি ইলা নাফসি তরাফাতা আঈন।

অর্থ : ‘হে চিরঞ্জীব, হে চিরস্থায়ী। আমি তোমার কাছে রহমত প্রাপ্তির ফরিয়াদ করি। আমার যাবতীয় অবস্থা সংশোধন করো। আমাকে একমুহূর্তের জন্যও কুপ্রবৃত্তির কাছে সোপর্দ কোরো না।’

(আত-তারগিব ওয়াত-তারহিব, হাদিস : ৯৮৯)

 

বিডি প্রতিদিন/ ওয়াসিফ

সর্বশেষ খবর