১০ জুলাই, ২০২৪ ০৮:১৫

ইসলামে সৌন্দর্যচর্চার পদ্ধতি ও পরিধি

ড. আবু সালেহ মুহাম্মদ তোহা

ইসলামে সৌন্দর্যচর্চার পদ্ধতি ও পরিধি

মহান আল্লাহ মানুষকে সুন্দরতম অবয়বে সৃষ্টি করেছেন এবং নারীদের আরো কোমল ও আকর্ষণীয় করেছেন। বিয়ের ক্ষেত্রে পুরুষরা নারীদের সৌন্দর্য, সম্পদ, বংশ মর্যাদা ও ধার্মিকতা দেখে অগ্রসর হয়। মানুষমাত্রই সৌন্দর্যের প্রতি দুর্বল। সবাই নিজেকে সুন্দর করে উপস্থাপন করতে চায়।

ইসলামে সৌন্দর্যও এবং রূপচর্চার আনুমোদন রয়েছে। এর নির্দিষ্ট কিছু নীতিমালাও আছে, যেন তা পাপে পরিণত না হয়। 
(১) সূর্যকিরণ এড়িয়ে চলা : ত্বকের সুরক্ষায় অপ্রয়োজনীয় সূর্যকিরণ পরিহার করার বিষয়েও হাদিসে বর্ণিত হয়েছে। কারণ সূর্যকিরণ এড়িয়ে চলা হচ্ছে ত্বক রক্ষার অন্যতম একটি উপায়।

যেমন—রাসুলুল্লাহ (সা.) ত্বকের সুরক্ষা, সুস্থতা ও রোগ প্রতিরোধে গুরুত্ব দিয়েই আবু কায়েস (রা.)কে রোদে দাঁড়াতে নিষেধ করেন। আবু কায়েস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে এমন অবস্থায় উপস্থিত হলেন, যখন তিনি ভাষণ দিচ্ছিলেন। আবু কায়েস (রা.) রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে গেলেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) নির্দেশ দিলে তিনি স্থান ছেড়ে ছায়ায় চলে এলেন।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ৪৮২২)

(২) নারী-পুরুষের স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখা : নারীরা রূপচর্চা করতে গিয়ে পুরুষের বেশ ধারণ করতে পারবে না। যেমন—ছোট পোশাক বা ছোট চুল, যা দেখে পুরুষ মনে হয়। অন্যদিকে পুরুষরাও রূপচর্চা করতে গিয়ে নারীর বেশ ধারণ করতে পারবে না। যেমন—নারীদের মতো বড় চুল, যা দেখে নারী মনে হয়। নারীর বেশধারী পুরুষ ও পুরুষের বেশধারী নারীদের প্রতি অভিসম্পাত করা হয়েছে।

ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) নারীর বেশধারী পুরুষদের এবং পুরুষের বেশধারী নারীদের অভিসম্পাত করেছেন।’ (বুখারি, হাদিস : ৫৮৮৫)

(৩) সৃষ্টির বিকৃতি না করা : আল্লাহর সৃষ্টির পরিবর্তন শয়তানের সুস্পষ্ট নির্দেশনা। শয়তান অভিশপ্ত হয়ে মানুষকে এসব করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়েছে। আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ তাকে (শয়তানকে) অভিসম্পাত করেন এবং সে (শয়তান) বলে, ‘আমি অবশ্যই তোমার বান্দাদের এক নির্দিষ্ট অংশকে আমার অনুসারী করব। আমি তাদের পথভ্রষ্ট করবই; তাদের হৃদয়ে মিথ্যা বাসনার সৃষ্টি করবই, আমি তাদের নিশ্চয় নির্দেশ দেব আর তারা পশুর কর্ণচ্ছেদ করবেই এবং তাদের নিশ্চয় নির্দেশ দেব, ফলে তারা আল্লাহর সৃষ্টি বিকৃত করবেই। আল্লাহর পরিবর্তে শয়তানকে অভিভাবকরূপে গ্রহণ করলে সে স্পষ্টতই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’ (সুরা নিসা, আয়াত : ১১৮-১১৯)

কাজেই দেহ ও অঙ্গ বিকৃতি ঘটিয়ে কোনো প্রকার রূপচর্চা ইসলামে বৈধ নয়। সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য চোখে রঙিন পর্দা বা কন্ট্যাক্ট লেন্স স্থাপন করে চোখকে নীলাভ বা বিভিন্ন রঙের করা, কৃত্রিম আইল্যাস বা পাপড়ি লাগানো, সৌন্দর্য বাড়াতে দাঁতের মাঝে ফাঁকা সৃষ্টি করা সবই আল্লাহ তায়ালার সৃষ্টির মধ্যে পরিবর্তন আনে। ফলে এসব বৈধ নয়; বরং হারাম।

(৪) ভ্রু-প্লাগ করা ও উল্কি আঁকার নিষেধাজ্ঞা :  আল্লাহর সৃষ্টিকে পরিবর্তন করার মধ্যে আবার বিভিন্ন উপায়ে ভ্রু-প্লাগ করা বা ভ্রু চিকন করা এবং চেহারা বা শরীরে উল্কি আঁকা সম্পর্কে হাদিসে সরাসরি অভিসম্পাত করা হয়েছে। আবদুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) এমন সব নারীর ওপর অভিসম্পাত করেছেন, যারা অঙ্গে উল্কি আঁকে ও অন্যকে দিয়ে উল্কি আঁকায় এবং সৌন্দর্যের জন্য ভ্রুর চুল উপড়ে আল্লাহ তায়ালার সৃষ্টিকে পরিবর্তন করে। (তিরমিজি, হাদিস : ২৭৮২)

(৫) চুলের পরিচর্যা : নবী (সা.) চুলে তেল দিয়েছেন, সিঁথি করেছেন, চুল আঁচড়ে পরিপাটি করেছেন এবং চুলের পরিচর্যা করতে উৎসাহ দিয়েছেন। তবে পরিচর্যা নিয়ে পড়ে থাকা বা এসবকে নিজের মূল লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য বানানো কোনোভাবেই কাম্য নয়। নবী (সা.) বলেন, যার চুল আছে সে যেন চুলের যত্ন নেয়। (আবু দাউদ, হাদিস : ৩৬৩২)

রাসুলুল্লাহ (সা.) পরিপাটি থাকা পছন্দ করতেন, কাউকে এলোমেলো দেখলে তাকে সতর্ক করতেন। আতা ইবনে ইয়াসার (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) মসজিদে ছিলেন। তখন এক ব্যক্তি এলোমেলো চুল ও দাড়ি নিয়ে প্রবেশ করল। রাসুলুল্লাহ (সা.) তাকে বের করে দিতে ইশারা করলেন, যেন তিনি তাকে দাড়ি ও চুল ঠিক করার নির্দেশ দিলেন। লোকটি তা-ই করল এবং ফিরে এলো। তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, শয়তানের মতো এলোমেলো চুল নিয়ে আসার চেয়ে এটাই কি উত্তম নয়? (মুয়াত্তায়ে মালিক, হাদিস : ১৪৯৪)

(৬) ক্ষতিকর প্রসাধনী ব্যবহার না করা : ক্ষতিকর প্রসাধনী ব্যবহার করা যাবে না। নিজের জন্য ক্ষতিকর সব বিষয় থেকে বিরত থাকতে হবে। আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা আল্লাহর পথে ব্যয় করো এবং নিজেদের হাতে নিজদের ধ্বংসের মধ্যে নিক্ষেপ করো না। তোমরা সৎকাজ করো, আল্লাহ সত্কর্মপরায়ণ লোককে ভালোবাসেন।’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ১৯৫)

এ প্রসঙ্গে হাদিসে বলা হয়েছে, ‘ক্ষতি ও ক্ষতিসাধনের কোনো অনুমতি (ইসলামে) নেই।’ (দারাকুতনি, হাদিস : ৩০৭৯)

(৭) পরপুরুষের কাছে সৌন্দর্য প্রকাশ না করা : নারীর সৌন্দর্যের প্রতি পুরুষ আকর্ষিত হয়। সেই সূত্রে কোনো পর্যায়ে পাপী পুরুষের পাশবিকতার স্বীকার হওয়ার আশঙ্কা থাকে। ফলে নারীর সুরক্ষা বিঘ্ন হতে পারে। নিজ সৌন্দর্য পরপুরুষের কাছে প্রকাশ না করলে অঙ্কুরেই এসব আশঙ্কা দূর হয়ে যাবে। আল্লাহ বলেন, ‘তারা যেন তাদের স্বামী, পিতা, শ্বশুর, পুত্র, স্বামীর পুত্র, ভাই, ভাইয়ের ছেলে, বোনের ছেলে, আপন নারীরা, তাদের মালিকানাধীন দাসী, পুরুষদের মধ্যে যৌন কামনা-রহিত পুরুষ এবং নারীদের গোপন অঙ্গ সম্বন্ধে অজ্ঞ বালক ছাড়া কারো কাছে তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে, তারা যেন তাদের গোপন সৌন্দর্য প্রকাশের উদ্দেশ্যে সজোরে পদক্ষেপ না করে।’ (সুরা নুর, আয়াত : ৩১) 

পরিশেষে বলা যায়, আজকাল সমাজে কৃত্রিম রূপচর্চা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। পার্লার ব্যবসার নামে রূপচর্চার আড়ালে বিভিন্নভাবে ইসলামের নির্দেশনা লঙ্ঘিত হচ্ছে। কাজেই এসব ক্ষেত্রে নিজেকে যত সংযত রাখা যাবে, আখিরাতের দিকে অগ্রসর হওয়া তত সহজ হবে।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক

আরবি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

 


বিডি প্রতিদিন/ ওয়াসিফ

সর্বশেষ খবর