শিরোনাম
১৬ জুলাই, ২০২৪ ০৭:৫৫

কোরআনের আলোকে নবীজির হিজরত

মো. আবদুল মজিদ মোল্লা

কোরআনের আলোকে নবীজির হিজরত

মক্কা থেকে মদিনায় নবীজি (সা.)-এর হিজরত ইসলামের ইতিহাসে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। কেননা এর মাধ্যমে ইসলামের নবযাত্রা শুরু হয়েছিল। মক্কার সংকটপূর্ণ পরিস্থিতি থেকে মুসলমানরা মুক্ত পরিবেশে স্বস্তির নিঃশ্বাস নেওয়ার সুযোগ লাভ করেছিল। ইসলামী সমাজ ও সভ্যতার গোড়াপত্তন হয়েছিল পবিত্র নগরী মদিনায়।

কোরআনের বর্ণনায় হিজরত

পবিত্র কোরআনের দুটি আয়াতে মহানবী (সা.)-এর মদিনায় হিজরতের বর্ণনা এসেছে। তবে মক্কা থেকে মদিনা পর্যন্ত সফরের ধারাবাহিক বর্ণনা সেখানে নেই, আছে হিজরতের খণ্ড চিত্র। কোনো ঘটনা বা ইতিহাসের ক্ষেত্রে কোরআনের রীতি হলো ইতিহাস গ্রন্থের মতো ধারাবাহিক বর্ণনা পরিহার করে ঘটনার সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ও শিক্ষণীয় অংশ তুলে ধরা। হিজরতের ঐতিহাসিক ঘটনার ক্ষেত্রেও তেমনটি হয়েছে।

নিম্নে হিজরতের ব্যাপারে কোরআনের বর্ণনা তুলে ধরা হলো—
 
হিজরতের প্রেক্ষাপট

আল্লাহর পক্ষ থেকে হিজরতের নির্দেশনা আসার পর মহানবী (সা.) সাহাবিদের হিজরতের অনুমতি দেন। এর দুই মাস কয়েক দিনের মধ্যে মক্কায় নবীজি (সা.), আবু বকর (রা.), আলী (রা.) এবং কয়েকজন অসহায় মুসলিম ছাড়া অন্যরা হিজরত করে মদিনায় চলে যান। মুসলিমদের মদিনায় হিজরত করা নিয়ে মক্কার মুশরিকরা নানা কারণে শঙ্কিত হয়ে পড়ে। কেননা মদিনার উপকূল দিয়ে তাদের বাণিজ্যিক কাফেলা যাতায়াত করত।

মক্কার মুশরিকরা যখন কোনোভাবেই সাহাবিদের দেশত্যাগ ঠেকাতে পারল না, তখন তারা নবীজি (সা.)-কে প্রতিহত করতে মক্কার ‘পরামর্শ কেন্দ্রে’ একত্র হলো। বৈঠকে আবু জাহাল নবীজি (সা.)-কে হত্যার পরামর্শ দেয়। নাউজুবিল্লাহ! সে বলে প্রত্যেক গোত্র থেকে একজন যুবক হত্যাকাণ্ডে অংশগ্রহণ করবে, যাতে বনু হাশিম ও বনু আবদে মানাফ প্রতিশোধ গ্রহণের চিন্তা করতে না পারে। সিদ্ধান্ত হয় রাতের আঁধারে তারা একযোগে নবীজির ওপর হামলা করবে। কিন্তু আল্লাহ সব ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দিয়ে নবীজি (সা.)-কে নিরাপদে মক্কা থেকে বের করে আনেন।

(মুসলিম উম্মাহর ইতিহাস : ১/৩৮৫; আর-রাহিকুল মাখতুম, পৃষ্ঠা : ১৬৭-১৬৮)
পবিত্র কোরআনে এই ষড়যন্ত্র সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে, ‘স্মরণ করো, কাফিররা তোমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে তোমাকে বন্দি করার জন্য, হত্যা করার জন্য অথবা নির্বাসিত করার জন্য এবং তারা ষড়যন্ত্র করে এবং আল্লাহও কৌশল অবলম্বন করেন। আল্লাহই সর্বশ্রেষ্ঠ কৌশলী।’ (সুরা : আনফাল, আয়াত : ৩০)
 
পথের সঙ্গী আল্লাহ স্বয়ং

মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতের পথ ছিল অত্যন্ত দুর্গম এবং বিপত্সংকুল। একদিকে মক্কার মুশরিকরা মহানবী (সা.)-কে প্রতিহত করতে চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়েছিল, অন্যদিকে মুশরিকদের ভয়ে চেনা-জানা পথ ছেড়ে তাদের ভিন্ন পথ অবলম্বন করতে হয়েছিল। ভয় ও শঙ্কার এই পথে আল্লাহ প্রতিটি মুহূর্তে প্রিয় নবী (সা.)-কে সাহায্য করেছিলেন। নবীজি (সা.) ও আবু বকর (রা.) সুর পর্বতের গুহায় আশ্রয় নেওয়ার পর সেখানে উপস্থিত হয়েছিল কুরাইশের অনুসন্ধানী দল, যা ছিল এক ভয়ানক মুহূর্ত। কেননা গুহার ভেতর থেকে শত্রুদলের পা দেখ যাচ্ছিল, কথা বোঝা যাচ্ছি। পবিত্র কোরআনে সেই মুহূর্তটি এভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে—‘যখন অবিশ্বাসীরা তাকে বহিষ্কার করেছিল এবং সে ছিল দুইজনের দ্বিতীয়জন, যখন তারা উভয়ে গুহার মধ্যে ছিল; সে তখন তার সঙ্গীকে বলেছিল, বিষণ্ন হয়ো না, আল্লাহ তো আমাদের সঙ্গে আছেন।’ (সুরা : তাওবা, আয়াত : ৪০)

ফেরেশতা দিয়ে পাহারা

কুরাইশ নেতারা নবীজি (সা.)-এর দেশত্যাগের সংবাদ পেয়ে ঘোষণা করে কেউ মুহাম্মদ (সা.)-কে জীবিত বা মৃত উপস্থিত করতে পারলে তাকে ১০০ উট উপহার দেওয়া হবে। ফলে বহু মানুষ তাঁর সন্ধানে বের হয়। এমন পরিস্থিতি আল্লাহ রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে ফেরেশতাদের মাধ্যমে তাঁর নিরাপত্তা নিশ্চিত করেন। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘অতঃপর আল্লাহ তাঁর ওপর প্রশান্তি বর্ষণ করেন এবং তাঁকে শক্তিশালী করেন এমন এক সৈন্যবাহিনী দ্বারা, যা তোমরা দেখনি, এবং তিনি অবিশ্বাসীদের কথা হেয় করেন। আল্লাহর কথাই সর্বোপরি এবং আল্লাহ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।’(সুরা : তাওবা, আয়াত : ৪০)

ফেরেশতাদের মাধ্যমে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিষয়টি স্পষ্ট হয় সুরাকা বিন মালিক (রা.)-এর ঘটনা থেকে। কুরাইশের পুরস্কারের লোভে সুরাকা ইবনে মালিক, যিনি পরবর্তী সময়ে মুসলমান হন, রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর অনুসরণ করে এগিয়ে আসেন। মহানবী (সা.)-এর নিকটবর্তী হওয়ার আগে দুইবার তাঁর ঘোড়া হোঁচট খেয়ে পড়ে যায়। কিন্তু তিনি কোনো দমে যাওয়ার পাত্র ছিলেন না। শেষ পর্যন্ত যখন তিনি খুব নিকটে পৌঁছে যান তখন মহানবী (সা.)-এর দোয়ায় তাঁর ঘোড়ার দুই পা মাটিতে দেবে যায়। এতে সুরাকার হুঁশ ফেরে। গোপনীয়তা রক্ষা করে ফিরে যেতে সম্মত হন। বিনিময়ে রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁকে পারস্য সম্রাট কিসরার হাতের কঙ্কন প্রদানের অঙ্গীকার করেন। ওমর (রা.)-এর যুগে মুসলমানের হাতে কিসরার পতন হলে এই অঙ্গীকার পূর্ণ করা হয়।(নবীয়ে রহমত, পৃষ্ঠা : ১৭৫-১৭৭)

মহানবী (সা.)-এর হিজরতের বিশেষত্ব

পবিত্র কোরআনে একাধিক নবী-রাসুলের হিজরতের বর্ণনা এসেছে। তবে তাদের মধ্যে নবীজি (সা.)-এর হিজরত বিশেষ মর্যাদা রাখে। আল্লামা ইউসুফ কারজাভি (রহ.) লেখেন, মুহাম্মদ (সা.) শুধু ফিতনা, যুদ্ধ, কষ্ট বা সংকট থেকে বাঁচতে হিজরত করেননি, তাঁর হিজরত ছিল নতুন সমাজ গঠনের জন্য, কালেমার দাবি সামনে রেখে ইসলামী সমাজ গঠনের জন্য; তিনি নতুন জাতি গঠন ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য হিজরত করেছিলেন। যার বৈশিষ্ট্য আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক, মানবিকতা, নৈতিকতা ও বৈশ্বিকতা। এ জন্যই নবীজি (সা.)-এর হিজরত অন্য নবী-রাসুলের ওপর শ্রেষ্ঠত্বের দাবি রাখে। (আল কারজাভি ডটনেট)

বিডি-প্রতিদিন/সালাহ উদ্দীন 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর