১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ ১০:৪৫

পেশাসংশ্লিষ্ট ধর্মীয় জ্ঞান অর্জনের বিধান

মুফতি আতাউর রহমান

পেশাসংশ্লিষ্ট ধর্মীয় জ্ঞান অর্জনের বিধান

পার্থিব জীবন মুমিনের জন্য পরকালের শস্যক্ষেতস্বরূপ। তাই পার্থিব জীবনের প্রতিটি কাজে সে শরিয়তের নির্দেশনা ও আল্লাহর সন্তুষ্টি সামনে রেখে করবে। সে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করবে কোন কাজে আল্লাহ সন্তুষ্ট হবেন এবং কোন কাজে তিনি অসন্তুষ্ট হবেন। আর ইসলাম যেহেতু পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান এবং মানবজীবনের প্রতিটি বিষয়ে আল্লাহর নির্দেশনা রয়েছে তাই মুমিন তার পেশাগত জীবনেও ইসলামের বিধানগুলো জানবে এবং তা মেনে চলবে।


ধর্মীয় জ্ঞান অর্জন করা ফরজ

প্রত্যেক মুসলমানের ওপর ধর্মীয় জ্ঞান অর্জন করা ফরজ। নবীজি (সা.) বলেন, ‘প্রত্যেক মুসলিমের ওপর ইলম (ধর্মীয় জ্ঞান) অন্বেষণ করা ফরজ।’

(সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস : ২২৪)

আল্লামা ইবনু আবদিল বার (রহ.) উল্লিখিত হাদিসের ব্যাখ্যায় বলেন, ‘আলেমরা এই বিষয়ে একমত পোষণ করেছেন যে কিছু জ্ঞান অর্জন করা প্রত্যেক ব্যক্তির ওপর ফরজে আইন। আর কিছু ইলম এমন, যা অর্জন করা ফরজে কিফায়া, যা কিছু ব্যক্তি অর্জন করলে ওই অঞ্চলের সব অধিবাসী ফরজ আদায়ের দায় থেকে মুক্ত হয়ে যাবে।’

(জামিউ বায়ানিল ইলমি ওয়া ফাদলিহি : ১/৫৬)


ফরজ জ্ঞানের পরিধি

আল্লামা ইবনু আবিদিন শামি (রহ.) বলেন, ‘প্রত্যেক মুকাল্লাফ (শরিয়তের বিধান যার জন্য প্রযোজ্য) মুমিন নর-নারী দ্বিন ও হিদায়াতের ইলম (ঈমানসংশ্লিষ্ট জ্ঞান) অর্জন করার পর তার ওপর অজু, গোসল, নামাজ ও রোজার বিধি-বিধান, নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হলে জাকাতের বিধান, হজ ফরজ হলে হজের বিধান শেখা ফরজ।...ব্যবসায়ীদের জন্য ক্রয়-বিক্রয়ের বিধি-বিধান শেখা আবশ্যক; যাতে তারা লেনদেনের ক্ষেত্রে সংশয়পূর্ণ ও মাকরুহ বিষয়াবলি থেকে বেঁচে থাকতে পারে।

অনুরূপভাবে পেশাজীবীদের এবং প্রত্যেক ব্যক্তি যে কাজ করে সেটার জ্ঞান ও বিধান জানা তার ওপর আবশ্যক; যাতে সে ওই কাজে হারাম থেকে বেঁচে থাকতে পারে।’

(আল-মাউসুয়াতুল ফিকহিয়্যাতে : ৩০/২৩৯)


পেশাসংশ্লিষ্ট ধর্মীয় জ্ঞানার্জনের বিধান

প্রত্যেক মুসলমানের জন্য নিজ নিজ পেশাসংশ্লিষ্ট ধর্মীয় জ্ঞান অর্জন করা ফরজ।

কেননা এর সঙ্গে তাঁর নিজের ও অন্যের হক এবং তার জীবিকার হালাল বা হারাম হওয়ার প্রশ্ন জড়িত। যেমন—যে ব্যক্তি ব্যবসা করে তার জন্য ক্রয়-বিক্রয়ের বিধি-বিধান জানা ফরজ; যাতে সে নিজের অজান্তে কোনো হারাম লেনদেন অথবা সুদের সঙ্গে জড়িয়ে না পড়ে। ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.)-এর একটি উদ্ধৃতি থেকে বিষয়টির সমর্থন পাওয়া যায়। তিনি বলেন, ‘আমাদের বাজারে শুধু সে ব্যক্তি ব্যবসা করতে পারবে যে দ্বিনি জ্ঞানে প্রজ্ঞা অর্জন করেছে।’
(সুনানু তিরমিজি, হাদিস : ৪৮৭)

ইমাম গাজালি (রহ.) বলেন, ‘কোনো মুসলিম ব্যক্তি যদি ব্যবসায়ী হয় এবং তার দেশে সুদি লেনদেনের বিস্তার থাকে, তবে তার ওপর সুদ থেকে সতর্ক থাকার বিষয়গুলো জানা ও শেখা আবশ্যক।

ফরজে আইন ইলমের এটাও একটি সঠিক ক্ষেত্র। এর অর্থ হলো, ওয়াজিব আমল আদায় করার পদ্ধতি জানা।’
(ইহয়াউ উলুমিদ্দিন : ১/৩৩)


পেশাসংশ্লিষ্ট জ্ঞান কখন অর্জন করবে

ইসলামের নির্দেশনা হলো ব্যক্তি কোনো পেশায় আত্মনিয়োগ করার আগেই সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ইসলামের বিধি-বিধানগুলো জেনে নেবে, যেন প্রথম দিন থেকেই সে হারাম লেনদেন ও বিষয়গুলো থেকে বেঁচে থাকতে পারে। তবে কেউ যদি আকস্মিকভাবে কোনো পেশায় নিযুক্ত হয়ে যায়, তবে যত দ্রুত সম্ভব বিধানগুলো জেনে নেবে। যেমন—আলী ইবনু আবি তালিব (রা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি ফিকহ (ইসলামী আইনশাস্ত্র) শেখার আগে ব্যবসা করতে গেল সে সুদের মধ্যে পড়ে গেল, তারপর সুদের মধ্যে পড়ে গেল, তারপর আবার সুদের মধ্যে পড়ে গেল।’

(মুগনিউল মুহতাজ : ২/২২)

ইমাম নববী (রহ.) বলেন, ‘ক্রয়-বিক্রয়, বিয়ে বা অনুরূপ যেসব বিষয় মৌলিকভাবে আবশ্যক নয়, সেগুলোর শর্তগুলো জানার আগেই তার দিকে অগ্রসর হওয়া হারাম।’

(আল-মাউসুয়াতুল ফিকহিয়্যাতে : ৩০/২৩৯)

 

কোন নিয়তে জ্ঞান অর্জন করবে

পেশাসংশ্লিষ্ট ধর্মীয় জ্ঞান অর্জনের মধ্যে পার্থিব কল্যাণেরও নানা দিক রয়েছে। যেমন—বিবাদ থেকে বেঁচে থাকা, আইনি জটিলতা থেকে বেঁচে থাকা, অনাকাঙ্ক্ষিত ক্ষতি থেকে রক্ষা পাওয়া ইত্যাদি। তবে একজন মুমিন যেকোনো ধর্মীয় জ্ঞান অর্জন করবে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ইলম দ্বারা আল্লাহর সন্তুষ্টি অন্বেষণ করা যায়, কোনো লোক যদি দুনিয়াবি স্বার্থ লাভের জন্য তা শিক্ষা করে, তবে সে কিয়ামতের দিন জান্নাতের সুগন্ধি পাবে না।’

(সুনানু আবি দাউদ, হাদিস : ৩৬৬৪)

 

যেভাবে জ্ঞান অর্জন করবে

ইসলামী জ্ঞানার্জনের নিরাপদ পদ্ধতি হলো কোনো প্রাজ্ঞ আলেমের সান্নিধ্যে থেকে তা অর্জন করা, যেন দুর্বোধ্য ও কঠিনগুলো তিনি বুঝিয়ে দিতে পারেন এবং সংশয়পূর্ণ বিষয়গুলো থেকে তিনি সংশয় দূর করে দিতে পারেন। আলেমদের সান্নিধ্যে থাকার সুযোগ না থাকলে আলেমদের কাছে জিজ্ঞাসা করে করে জ্ঞানার্জন করতে পারে। আর যদি সেটাও সহজসাধ্য না হয়, তবে আলেমদের পরামর্শ অনুসারে নির্ভরযোগ্য বই-পুস্তক পড়েও শরিয়তের বিধি-বিধান জেনে নেওয়া যায়। আবদুল্লাহ ইবনে মোবারক (রহ.)-কে প্রশ্ন করা হয়েছিল—কোন সে ইলম, যা অন্বেষণ করা ছাড়া মুমিনের কোনো উপায় নেই? কোন সে ইলম, যা শেখা মুমিনের ওপর আবশ্যক? তিনি বলেন, ইলম ছাড়া কোনো কিছুর দিকে অগ্রসর হওয়ার সুযোগ নেই। জিজ্ঞাসা করা ছাড়া তার কোনো উপায় নেই।

(জামিউ বায়ানিল ইলম : ১/৫৬)

ইমাম গাজালি (রহ.) বলেন, ‘প্রত্যেক বান্দা দিবানিশি ইবাদত ও লেনদেনে তার ওপর অনিবার্য নতুন কিছু বিষয়ের সম্মুখীন হয়। তাই তার কর্তব্য হলো বিরল যা কিছু তার ক্ষেত্রে ঘটে সেগুলো সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা এবং নিকট ভবিষ্যতে সে যা কিছু ঘটার সম্ভাবনা দেখে অবিলম্বে সেই ইলম অর্জন করাও তার ওপর আবশ্যক।’

(ইহয়াউ উলুমিদ্দিন : ১/৩৪)


পেশাগত জীবনে শরিয়ত মানার উপকার

পেশাগত জীবনে শরিয়তের বিধি-বিধান মেনে চলার অর্থ হলো, অন্তরে আল্লাহর ভয় ধারণ করা এবং আল্লাহর ওপর নির্ভর করা। আল্লাহ তাঁর ওপর নির্ভর করার পুরস্কার ঘোষণা করে বলেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করে আল্লাহ তাঁর পথ করে দেবেন। এবং তাকে তার ধারণাতীত উৎস থেকে দান করবেন রিজিক। যে ব্যক্তি আল্লাহর ওপর নির্ভর করে তার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট। আল্লাহ তাঁর ইচ্ছা পূরণ করবেনই। আল্লাহ সব কিছুর জন্য স্থির করেছেন নির্দিষ্ট মাত্রা।’

(সুরা : তালাক, আয়াত : ২-৩)

আল্লাহ সর্বক্ষেত্রে তাঁর বিধান মেনে চলার তাওফিক দিন। আমিন।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর