পৃথিবীর প্রাচীনতম জনপদগুলোর অন্যতম লেবানন। খ্রিস্টপূর্ব পাঁচ হাজার বছর আগে এখানে মানববসতি গড়ে ওঠে। যা প্রাচীন ফিনিশিয় সভ্যতার বিকাশভূমি ছিল। দেশটির প্রাতিষ্ঠানিক নাম লেবানন প্রজাতন্ত্র। লেবানের উত্তর ও পূর্বে সিরিয়া, দক্ষিণে ফিলিস্তিন এবং পশ্চিমে ভূমধ্যসাগর ও সাইপ্রাস অবস্থিত। এশিয়া মহাদেশের দ্বিতীয় ক্ষুদ্রতম দেশ লেবাননের মোট আয়তন ১০ হাজার ৪৫২ বর্গ কিলোমিটার। যেখানে ৫২ লাখ ৯৬ হাজার ৮১৪ জন বসবাস করে। শিয়া ও সুন্নি মিলে লেবাননে মুসলিম জনসংখ্যার হার ৫২ শতাংশ।
ভূমধ্যসাগরের তীরবর্তী এই দেশটি আরব ভূখণ্ডের সংযোগস্থল হিসেবে যুগ যুগ ধরে বিশ্বশক্তির আগ্রহের কেন্দ্র ছিল। লেবানন ইসলামী খেলাফতের শাম এবং রোমান সাম্রাজ্যের লেভান্ট অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত ছিল। রাসুলুল্লাহ (সা.) এর ওফাতের অর্ধশতাব্দীকালের মধ্যে লেবাননসহ সমগ্র শাম অঞ্চল ইসলামী খেলাফতের অধীন হয়। কালক্রমে মুসলিম শাসকদের মধ্যে উমাইয়া, আব্বাসি, ফাতেমি ও উসমানীয়রা লেবানন শাসন করেন।
খলিফা ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) এর যুগে মুসলমানরা বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যকে পরাজিত করে লেবানন জয় করেন। মুসলিম বাহিনীর শাম বিভাগের দামেশক শাখা লেবাননে অভিযান চালায়। ইয়াজিদ ইবনে আবি সুফিয়ান (রা.) অগ্রগামী বাহিনীর নেতৃত্ব দেন। তার সঙ্গে ছিলেন ভাই মুয়াবিয়া (রা.)। তার একদিকে বৈরুত, সিডন ও বাইব্লোসের দিকে অগ্রসর হন। অন্যদিকে, খালিদ বিন ওয়ালিদ (রা.) বেকা থেকে বেলবেকের দিকে অগ্রসর হন। ফলে লেবানিজরা মুসলমানের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হতে বাধ্য হয়। চুক্তির অন্যতম শর্ত ছিল লেবানিজরা বাইজেন্টাইনদের বিরুদ্ধে মুসলিম বাহিনীকে সাহায্য করবে, মুসলিমরা তাদের কাছ থেকে জিজিয়া নেবে না, বরং তাদের সঙ্গে অন্য মুসলমানের মতো আচরণ করবে।মুসলিম বিজয়ের পর আরব মুসলিম গোত্রগুলো লেবাননের উপকূলীয় ও সীমান্তবর্তী এলাকায় বসবাস শুরু করলে উপকূলীয় অঞ্চলের দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় সমবেত হতে থাকে এবং নিজেদের শক্তি বৃদ্ধিতে মনোযোগ দেয়। মুয়াবিয়া (রা.) এর যুগে তারা বাইজেন্টাইনদের সঙ্গে যোগাযোগ করে মুসলিম বিরোধী নানা কর্মকাণ্ড চালায়। খলিফা আবদুল মালিক বিন মারওয়ান তাদের সঙ্গে শান্তি চুক্তি করতে বাধ্য হন। তিনি তাদেরকে সপ্তাহে এক হাজার দিনার দিতে সম্মত হন। খলিফা ওয়ালিদ ইবনে আবদুল মালিক তার ভাই মাসলামাকে পাঠিয়ে লেবানিজদের ছত্রভঙ্গ করে দেন।
উমাইয়া শাসনের পতনের সঙ্গে লেবানিজ খ্রিস্টানদের বিদ্রোহ চরম রূপ নেয়। ৭৫২ খ্রিস্টাব্দে তারা ইলিয়াস নামক একজনের নেতৃত্বে সংঘবদ্ধ হয় এবং বাইজেন্টাইনদের সাহায্যে আব্বাসীয় বাহিনীকে পরাজিত করে। এমনকি তারা শামের হেমস ও হামাসহ কিছু অংশ দখলও করে নেয়। হিজরি দ্বিতীয় শতকে খলিফা আবু জাফর মানসুরের চাচা সালিহ বিন আলী বিদ্রোহী খ্রিস্টানদের কঠোর হাতে দমন করেন। তিনি তাদের দুর্গগুলো নিশ্চিহ্ন করে ফেলেন। তবে লেবাননের খ্রিস্টান ও মুসলিম কেউ কখনোই আব্বাসীয় শাসনে সন্তুষ্ট ছিলেন না। তাদের এই অসন্তোষের সুযোগ নিয়ে লেবাননে শিয়া মতালম্বীরা নিজেদের মতবাদ প্রচার করতে থাকে। ফাতেমীয় শাসকরা ছিল শিয়া মতবাদ প্রচারে পৃষ্ঠপোষকতা করে। জাআমা ইবনে আলী ও হামজা বিন আলী লাব্বাদ লেবাননে শিয়া মতবাদ প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
আব্বাসীয় ও ফাতেমিদের সংঘাতের কারণে লেবাননে মুসলিম নিয়ন্ত্রণ দুর্বল হয়ে যায়। এই সুযোগে খ্রিস্টীয় একাদশ শতাব্দীয় ইউরোপীয় ক্রুসেডার বাহিনী লেবাননসহ পুরো ফিলিস্তিন অঞ্চল দখল করে নেয়। বায়তুল মোকাদ্দাসও তাদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। অবশ্যই লেবাননের উত্তরাঞ্চল ত্রিপোলি আমিরাতের অধীনে ছিল। মামলুক ও আইয়ুবীয় শাসকরা লেবানন ও ফিলিস্তিন ভূমিকে ক্রুসেডারদের দখল থেকে মুক্ত করেন। ১২৯১ খ্রিস্টাব্দে লেবানন অঞ্চল পুরোপুরি আবারো মুসলমানদের নিয়ন্ত্রণে আসে। এরপর থেকে মামলুকরা লেবানন শাসন করে।
১৫১৬ খ্রিস্টাব্দে এই অঞ্চল উসমানীয়দের শাসনাধীন হয়। উসমানীয়রা প্রায় নির্ঝঞ্ঝাটে শাম শাসন করে। নিজেদের শাসনের সুবিধার্থে তারা শামকে তিনটি প্রাশাসনিক অঞ্চলে বিভক্ত করে। তা হলো দামেশক, লেভান্ট ও ত্রিপোলি। যার মধ্যে আধুনিক লেবানন লেভান্টের অধীনে ছিল। উসমানীয়রা নিজেদের আনুগত্যের শর্তে লেবানিজদের নানা ধরনের স্বাধীনতা দিয়ে রেখেছিল। তারা স্থানীয় উপজাতীয় নেতা ও মামলুক প্রশাসকদের পর্যন্ত বরখাস্ত করেনি। স্থানীয় প্রভাবশালী পরিবারগুলো উসমানীয়দের অধীনে জনগণকে শাসন করত। ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে লেবানন শাসন উসমানীয়দের জন্য কঠিন হয়ে ওঠে। তবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ পর্যন্ত (১৯১৮) লেবানন উসমানীয়দের অধীনে ছিল। ১৯২০ সালে লেবাননে ফরাসি ম্যান্ডেড চালু হওয়ার মধ্য দিয়ে মুসলিম শাসনের অবসান হয়। ৩১ ডিসেম্বর ১৯৪৬ ফরাসি বাহিনী প্রত্যাহারের মাধ্যমে লেবানন পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা লাভ করে।
ইসলাম স্টোরি ডটকম অবলম্বনে।
বিডি-প্রতিদিন/শআ