জ্ঞানের অন্যতম উৎস ইতিহাস। ইতিহাস মানুষকে অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা জোগায়। মানুষ ভুলত্রুটি শুধরে নিয়ে জীবনকে সুন্দর করার সুযোগ লাভ করে। পবিত্র কোরআনের অসংখ্য আয়াতে মানবজাতিকে ইতিহাসচর্চার আহ্বান জানানো হয়েছে।
মহান আল্লাহ বলেন, ‘তারা কি পৃথিবীতে ভ্রমণ করেনি ও দেখেনি তাদের পূর্ববর্তীদের কি পরিণাম হয়েছিল? পৃথিবীতে তারা ছিল তাদের চেয়ে সংখ্যায় অধিক এবং শক্তিতে ও কীর্তিতে অধিক প্রবল। তারা যা করত তা তাদের কোনো কাজে আসেনি।’ (সুরা : মুমিন, আয়াত : ৮২)
ইতিহাস পাঠের গুরুত্ব
ইমাম নববী (রহ.) বলেন, ইতিহাস এমন শাস্ত্র, যা রাজা ও মন্ত্রী, সেনাপতি ও প্রশাসক, লেখক ও পথপ্রদর্শক, ধনী ও দরিদ্র, গ্রাম্য ও শহুরে, স্থানীয় ও পর্যটক সবার প্রয়োজন হয়। রাজা অতীতের জাতি ও রাজ্যগুলোর ওপর কী গত হয়েছে তা থেকে শিক্ষা নেবেন, মন্ত্রী অনুসরণ করবেন জ্ঞান ও বীরত্বে তার সমকক্ষ ব্যক্তিদের কাছ থেকে, সেনাপতি রণকৌশল সম্পর্কে জানতে পারবেন, লেখক সমালোচনার দিকগুলো সম্পর্কে সচেতন হবেন, পথপ্রদর্শকরা সমকক্ষ মনীষীদের জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও অভিজ্ঞতা দ্বারা সমৃদ্ধ হবেন, ধনী আল্লাহর কৃতজ্ঞতা আদায় করবেন এবং নিঃসংকোচের আল্লাহর জন্য ব্যয় করবেন, দরিদ্র আরো পরিশ্রমী হবেন এবং আশা করি, ভবিষ্যতের জন্য চেষ্টা করবেন।
এভাবে সবাই নিজ নিজ ক্ষেত্রের ইতিহাস দ্বারা উপকৃত হতে পারবেন।
(নিহায়াতুল আরাবি ফি ফুনুনিল আদাবি, পৃষ্ঠা-২৫৬)
ইতিহাস পাঠের উপকারিতা
নিম্নে ইসলামের দৃষ্টিতে ইতিহাস পাঠের উপকারিতা তুলে ধরা হলো—
১. মুমিন হৃদয়ের দৃঢ়তা : ইতিহাস পাঠের মাধ্যমে মুমিনের হৃদয়ে দৃঢ়তা তৈরি হয়। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘রাসুলদের ওই সব বৃত্তান্ত আমি তোমার কাছে বর্ণনা করছি, যার দ্বারা আমি তোমার হৃদয়কে দৃঢ় করি, এর মাধ্যমে তোমার কাছে এসেছে সত্য এবং মুমিনদের জন্য এসেছে উপদেশ ও সাবধান বাণী।’ (সুরা : হুদ, আয়াত : ১২০)
২. পূর্বসূরিদের অনুসৃত রীতি জানা : ইতিহাস পাঠের মাধ্যমে পূর্বসূরি মনীষীদের জীবন ও অনুসৃত পদ্ধতি সম্পর্কে জেনে তা অনুসরণ করা যায়।
এ ব্যাপারে কোরআনের নির্দেশ হলো, ‘তাদেরকেই আল্লাহ সৎপথে পরিচালিত করেছেন, সুতরাং তুমি তাদের পথের অনুসরণ করো।’
(সুরা : আনআম, আয়াত : ৯০)
৩. জ্ঞানীদের জন্য শিক্ষা : মহান আল্লাহ কোরআনে ইউসুফ (আ.)-এর ঘটনা বর্ণনা করার পর বলেন, ‘তাদের বৃত্তান্তে বোধশক্তিসম্পন্ন ব্যক্তিদের জন্য আছে শিক্ষা।’
(সুরা : ইউসুফ, আয়াত : ১১১)
৪. জগৎ পরিচালনায় আল্লাহর নীতি জানা : ইতিহাস পাঠ করলে অতীত জাতি-গোষ্ঠীর ভালো-মন্দ কাজের পরিণতি সম্পর্কে জানা যায়, যা থেকে সৃষ্টিজগৎ পরিচালনায় আল্লাহর নীতি সম্পর্কে অবগত হওয়া যায়। যেমন—আল্লাহ নবীদের বিরুদ্ধাচরণের শাস্তি বর্ণনা করে বলেন, ‘তখন আমি তার ডাকে সাড়া দিয়েছিলাম এবং তাকে উদ্ধার করেছিলাম দুশ্চিন্তা থেকে এবং এভাবেই আমি মুমিনদের উদ্ধার করে থাকি।’ (সুরা : আম্বিয়া, আয়াত : ৮৮)
৫. চিন্তা ও গবেষণার রসদ লাভ : ইতিহাসের পাঠ মানুষকে চিন্তা ও গবেষণার রসদ জোগায়।
পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তুমি ঘটনা বর্ণনা করো, যাতে তারা চিন্তা করে।’ (সুরা : আরাফ, আয়াত : ১৭৬)
ইতিহাস পাঠ যখন উপকারী
ইতিহাস পাঠ করে উপকৃত হওয়ার জন্য যে ইতিহাস পাঠ করা হচ্ছে তার ভেতর তিনটি বৈশিষ্ট্য থাকা আবশ্যক। তা হলো—
১. ইতিহাস সত্য হওয়া : সত্য ইতিহাসই মানুষকে উপকৃত করে। মিথ্যা ইতিহাস দ্বারা মানুষ কেবল বিভ্রান্তই হয়। এ জন্য আল্লাহ নিজের বর্ণিত ইতিহাস সম্পর্কে বলেছেন, ‘আমি তোমার কাছে তাদের বৃত্তান্ত সঠিকভাবে বর্ণনা করছি।’
(সুরা : কাহফ, আয়াত : ১৩)
অন্যত্র আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই এটি সত্য বিবরণ।’
(সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ৬২)
২. প্রাজ্ঞ ব্যক্তির রচিত ইতিহাস হওয়া : যখন কোনো প্রাজ্ঞ ব্যক্তি ইতিহাস রচনা করেন, তখন তা দ্বারা বেশি উপকৃত হওয়া যায়। কেননা প্রাজ্ঞ ব্যক্তি ঘটনার স্থূল বিবরণের পরিবর্তে প্রয়োজনীয় ও সূক্ষ্ম বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। মহান আল্লাহ বলেন, ‘অতঃপর তাদের কাছে পূর্ণ জ্ঞানের সঙ্গে তাদের কার্যাবলি বিবৃত করবই, আর আমি তো অনুপস্থিত ছিলাম।’ (সুরা : আরাফ, আয়াত : ৭)
৩. অনুসন্ধানী ইতিহাস হওয়া : যে ইতিহাস অনুমাননির্ভর নয়, যা সত্যনিষ্ঠ, তার দ্বারা মানুষ উপকৃত হতে পারে। এ জন্য কোরআনে আসহাবে কাহফের ব্যাপারে অনুমাননির্ভর বক্তব্য পরিহারের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘সাধারণ আলোচনা ছাড়া তুমি তাদের বিষয়ে বিতর্ক কোরো না এবং তাদের কাউকে তাদের বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ কোরো না।’ (সুরা : কাহফ, আয়াত : ২২)
ইতিহাস পাঠে যে সতর্কতা প্রয়োজন
যারা ইতিহাস পাঠ করবে তাদের নিম্নোক্ত বিষয়গুলোতে সতর্ক থাকা কাম্য—
১. সঠিক ও নির্ভরযোগ্য ইতিহাস পাঠ করা। বিকৃত ও নোংরা ইতিহাস পরিহার করা। কেননা মানুষের মনে ভালো ও মন্দ সব কিছুরই প্রভাব পড়ে।
২. প্রত্যেক ঘটনা ও প্রেক্ষাপটে নির্ভরযোগ্য ব্যক্তি ও মতামত অনুসন্ধান করা।
৩. ঐতিহাসিক কোনো ঘটনা অনুসন্ধানে কেবল সমকালীন ঐতিহাসিকের ওপর নির্ভর না করা। পরবর্তী সময়ে বক্তব্য যাচাই করা। কেননা সমকালীন ব্যক্তিরা কখনো কখনো সত্য প্রকাশে অক্ষম ছিলেন।
৪. পূর্বসূরিদের নগ্ন সমালোচনা না করা। কেননা শত সত্যের নিশ্চয়তা আল্লাহ ছাড়া কেউ দিতে পারে না।
৫. সনদ তথা ঘটনা বর্ণনার পরম্পরা যাচাই করা, বিশেষত যখন তার সঙ্গে দ্বিন ও শরিয়তের প্রশ্ন জড়িত থাকে।
৬. পূর্বসূরি মনীষীদের দোষারোপের পরিবর্তে উত্তম ব্যাখ্যাগুলো গ্রহণ করা, বিশেষত সাহাবায়ে কিরাম (রা.)-এর পারস্পরিক বিরোধ বিষয়ে কোনো পক্ষকে দোষারোপ না করা।
৭. পূর্ববর্তী আসমানি গ্রন্থগুলো সংরক্ষিত না থাকায় তাতে নবী-রাসুলদের ব্যাপারে অসম্মানজনক শব্দ, বাক্য ও বিশেষণ ব্যবহার করা হয়েছে। মুমিনদের তা অবশ্যই পরিহার করতে হবে। আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাতের বিশ্বাস হলো সব নবী নিষ্পাপ ছিলেন এবং তাঁদের পবিত্রতার চাদরে আবৃত করে রেখেছিলেন।
৮. কোনো ঐতিহাসিকের প্রতি অন্ধ বিশ্বাস বা বিরূপ মনোভাব পোষণ না করা।
আল্লাহ সবাইকে সঠিকভাবে ইতিহাস পাঠ করা এবং তা দ্বারা উপকৃত হওয়ার তাওফিক দিন। আমিন।
বিডি-প্রতিদিন/সালাহ উদ্দীন