শনিবার, ১৫ আগস্ট, ২০১৫ ০০:০০ টা

১৫ আগস্ট বাঙালি জাতির কলঙ্কিত অধ্যায়

মুসা সাদিক

১৫ আগস্ট বাঙালি জাতির কলঙ্কিত অধ্যায়

সপরিবারে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার মাধ্যমে বাংলাদেশকে পুনরায় পাকিস্তানের মডেলে রূপান্তরের নীলনকশার বাস্তবায়ন ঘটানো হয়। তাকে হত্যার ফলে '৭৫ সাল থেকে এ দেশ নামে বাংলাদেশ কামে পাকিস্তান হয়ে যায়। মুক্তিযুদ্ধের শেষ লগ্নে সিআইএ এবং আইএসআই নিশ্চিত হয়ে যায় লাখ লাখ শহীদের রক্তে স্নাত হয়ে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের উত্থান তারা রোধ করতে ব্যর্থ। পেন্টাগনে ও ইসলামাবাদের শীর্ষ গোয়েন্দারা সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের সামরিক বাহিনীতে প্রশিক্ষক হিসেবে ও ডেপুটেশনে কর্তব্যরত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সর্বোচ্চ অনুগত বাঙালি অফিসারদের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের নির্দেশ দেয়। পাকিস্তানের গোপন সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের দায়িত্ব নিয়ে খুনি ডালিম, ফারুক, রশীদ গংরা আইএসআই এবং KILLING SQUAD-এর সদস্য হয়ে নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে এসে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করে। এসেই তাদের মধ্যমণি হিসেবে পেয়ে যায় মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি জেনারেল ওসমানীর বিরোধী পাকিস্তান গোয়েন্দা বাহিনীর সাবেক অফিসার জেড-ফোর্সের কমান্ডার মেজর জিয়াকে। যুদ্ধকালীন জেনারেল ওসমানীকে অপসারণের লক্ষ্যে তার command & strategy out dated বলে তার বিরুদ্ধে অসন্তোষ ও ক্ষোভ গড়ে তোলেন। শেষ পর্যন্ত যুদ্ধবিষয়ক প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন স্যারের প্রতিভা ও ক্ষিপ্রতায় এবং সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশাররফের দৃঢ় ভূমিকায় 'জেড ফোর্স' অধিনায়ক সফল হতে পারেননি। '৭৫-এর ১৫ আগস্ট তিনি যখন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর উপ-প্রধান সেনাপতি, তখন আইএসআই এবং সিআইএ'র সামনে ষড়যন্ত্র-চক্রান্তের খোলা দরজা। ১৫ আগস্টের ভোর পৌনে ৬টার দিকে স্বাধীন বাংলা বেতারের শিল্পী প্রণোদিৎ বড়ুয়া আমার আজিমপুরের সরকারি কলোনির ৩৭/সি নম্বর বাসার দরজা ভেঙে ফেলার মতো করে ধাক্কা দিয়ে আমার নাম ধরে জোরে জোরে চিৎকার করে ডেকে তুললেন। রেডিওতে ততক্ষণে মেজর ডালিমের কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে : 'আমি মেজর ডালিম বলছি, আমি মেজর ডালিম বলছি, বাংলার মীরজাফর শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে। বাংলার মীরজাফর শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে। মীরজাফর মুজিব সরকারকে উৎখাত করা হয়েছে। ঢাকাসহ সারা দেশে কারফিউ জারি করা হয়েছে...।' আমি তখন বিভিন্ন মুক্তিযোদ্ধা অফিসারের বাসায় টেলিফোন করে কী করা যায় তা নিয়ে কথা বলছিলাম। রক্ষীবাহিনীর টেলিফোন এক্সচেঞ্জ সারাক্ষণ engaged পাচ্ছিলাম। ততক্ষণে প্রণোদিৎ দার দেওয়া বঙ্গবন্ধুর বাড়ির শেখ কামালের বেডরুমের সেই unclassified ফোনে আমি ফোন করলাম। (খুব দুঃখিত যে, সেই ফোন নম্বরটি এত বছর পরে আর স্মরণ করতে পারছি না এবং প্রণোদিৎ দাও আজ বেঁচে নেই। সেই ফোনটি ছিল সুলতানা কামাল খুকুর, যার হদিস টিঅ্যান্ডটির চেয়ারম্যান ছাড়া অন্য কোনো অফিসার জানতেন না)। প্রণোদিৎ দা রিসিভারে কান পেতে রাখলেন ৩২ নম্বর থেকে কী উত্তর আসে শোনার জন্য। তিনবার রিং হতেই শেখ কামালের বেডরুমের টেলিফোনের রিসিভার ধরে অন্য প্রান্তে 'হ্যালো' বলতেই আমি বললাম, 'আমি শেখ কামালের বন্ধু বলছি। কামাল কেমন আছে?' টেলিফোনের অন্য প্রান্ত থেকে চোস্ত উর্দুতে উত্তর দিল : 'বহুত আচ্ছা, আপ কৌন?' আমি বললাম : 'আমি ওর বন্ধু। ওদের বাড়ির দিক থেকে গোলাগুলির আওয়াজ আসছে কেন?' সেই লোকটি পুনরায় চোস্ত উর্দুতে উত্তর দিল : 'ও কুছ নেহি। বাজি ফুট রাহা হ্যায়। উও লোগ খুছিছে খুছি মানা রাহে হ্যায়? আপ কৌন? আপ কাঁহাছে রোল রাহে হ্যায়? আপ কা ফোন নম্বর কেতনা?' ৩২ নম্বরের বাড়িতে ১৫ আগস্ট সকাল পৌনে ৭টার দিকে পাক সেনাদের মতো চোস্ত উর্দু কণ্ঠস্বর শুনে আমার নিশ্চিত বিশ্বাস হলো যে, বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে যারাই হামলা করুক তাদের মধ্যে পাক সেনারাও রয়েছে। রিসিভারে আমার সঙ্গে কান লাগিয়ে ওদের কথা শুনে প্রণোদিৎ দাও বলে উঠলেন, 'মুসা, এ তো দেখছি পাকিস্তানি সেনার কণ্ঠস্বর।' ততক্ষণে আমি ক্রুদ্ধ হয়ে উঠেছি এবং ইংরেজিতে তাকে বললাম, 'হোয়াই ইউ আর স্পিকিং ইন উর্দু? আর ইউ পাকিস্তানি আর্মি?' বজ্রপাতের মতো চিৎকার করে উত্তর দিল, 'আই অ্যাম ইউর ফাদার, হোয়াট ইজ ইউর অ্যাড্রেস, বাস্টার্ড?' বিবিসি সেদিন মার্ক টালির বরাতে সংবাদ প্রচার করল, 'ঢাকার ঘরে ঘরে মুজিববাহিনী ও মুক্তিবাহিনী প্রস্তুত হচ্ছে এবং তারা যে কোনো সময় সাঁড়াশি আক্রমণ চালিয়ে ঢাকা দখল করে ফেলবে এবং শেখ মুজিব হত্যার প্রতিশোধ নেবে মর্মে প্রতিজ্ঞা নিয়েছে বলে জানা যায়।' বিবিসিতে এ সংবাদ প্রচারের সঙ্গে সঙ্গে বঙ্গভবনে খুনি মোশতাক ও তার সহযোগী খুনি ডালিম-ফারুকদের হৃদকম্পন শুরু হয়ে যায়। তারা বিডিআর থেকে অতিরিক্ত ফোর্স আনে বঙ্গভবন গার্ড দেওয়ার জন্য। বিবিসির এ সংবাদে ঢাকার মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল বেড়ে যায় এবং খুনি ডালিম-ফারুকদের বিরুদ্ধে ঢাকাসহ আশপাশের জেলাগুলোয় প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য সবাই যে যার সাধ্যমতো চেষ্টা করতে থাকে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর খুনিচক্র ডালিম-ফারুক-রশীদ এবং তাদের দোসর এইচ টি ইমাম-আবদুর রহিম, মাহবুব আলম চাষীরা তড়িঘড়ি করে খন্দকার মোশতাককে প্রেসিডেন্ট হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে দেশবাসী ও বিশ্ববাসীর সামনে প্রতিষ্ঠিত করার উদ্যোগ নেয়। সেনাবাহিনী, রক্ষীবাহিনী ও দেশবাসীর সামনে তারা দেখাতে চায়, বঙ্গবন্ধু জীবিত নেই বলে কোনো ক্ষমতার বা প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডের শূন্যতা সৃষ্টি হয়নি। ১৫ আগস্ট বিকালে বঙ্গভবনে খুনি খন্দকার মোশতাকের শপথ অনুষ্ঠানের তোড়জোড় শুরু করেন তিনজন- মন্ত্রিপরিষদ সচিব এইচ টি ইমাম, রাষ্ট্রপতির সচিব আবদুর রহিম এবং স্বঘোষিত মুখ্য সচিব মাহবুব আলম চাষী (সিআইএ'র চর বলে প্রমাণিত হওয়ায় পাকিস্তান আমলে চাকরিচ্যুত)। খুনি মোশতাকের শপথ অনুষ্ঠানের ভাবগাম্ভীর্য বৃদ্ধির জন্য মন্ত্রিপরিষদ সচিব এইচ টি ইমাম এবং রাষ্ট্রপতির সচিব আবদুর রহিম খুনি ডালিম-ফারুকদের সঙ্গে ঘন ঘন বৈঠকে বসেন। চোখের ওপর ভেসে উঠল একাত্তরের রণাঙ্গনে, রণাঙ্গনে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা শত-সহস্র বীর মুক্তিযোদ্ধার লাশ, আর বাঙালি ভাই-বোনের রক্তে ভেসে যাওয়া কালো পিচ্ছিল দূর্বাঘাস, মাঠ-ঘাট। ঠোঁট থেকে বেরিয়ে এলো 'জয় বাংলা', 'জয় বঙ্গবন্ধু'।

 

সর্বশেষ খবর