শনিবার, ১৫ আগস্ট, ২০১৫ ০০:০০ টা

কাছ থেকে দেখা ইতিহাসের মহানায়ক

মো. সাহাবুদ্দিন চুপ্‌পু

কাছ থেকে দেখা ইতিহাসের মহানায়ক

লেখককে আদর করে দিচ্ছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান

শোকাবহ আগস্ট মাস। বাঙালি জাতির জীবনে কালো অধ্যায়ের সূচনা ১৫ আগস্ট ১৯৭৫। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, স্বাধীন বাংলার স্বপ্নদ্রষ্টা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে ঘাতক খুনি মোশতাক চক্রের বুলেটের আঘাতে শহীদ হন। একাত্তরের পরাজিত স্বাধীনতার শত্রুরা নেয় পরাজয়ের নির্মম প্রতিশোধ। কালের চাকা উল্টো দিকে ঘুরিয়ে নব্য পাকিস্তান সৃষ্টির চক্রান্তের যাত্রা শুরু হয়।

বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বর্বরতার শিকার হয় আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠনের অগণিত নেতা-কর্মীসহ প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরাও। সে এক বিশাল ঘটনাপ্রবাহ। বাঙালি জাতির কাছে তো বটেই আমার কাছে এই মাসটি নতুন জীবনলাভের মাস বিধায় আমার স্মৃতিপটে বঙ্গবন্ধুর সাহচর্যের কিছু ঘটনা অবতারণার জন্য লেখার এই ধৃষ্টতা।

১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি লাহোরে বিরোধী দলের নিখিল পাকিস্তান জাতীয় সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু ৬ দফা প্রস্তাব উত্থাপন করেন এবং ১১ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু ঢাকায় ৬ দফা বিষয়ে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বিশদ ব্যাখ্যা প্রদান করেন। ১৮ মার্চ ১৯৬৬ সালে আওয়ামী লীগের জাতীয় কাউন্সিলে ৬ দফা প্রস্তাব গৃহীত হয়। বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ ৬ দফা প্রণয়ন করে তখন দলের শীর্ষ নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সমগ্র জাতিকে ৬ দফার আন্দোলনে শরিক হওয়ার জন্য দেশব্যাপী প্রচার অভিযান শুরু করেন। পূর্ব পাকিস্তানের প্রায় প্রতিটি জেলায় তিনি জনসভা, পথসভা ও কর্মিসভার মাধ্যমে আন্দোলনকে বেগবান করে তোলেন। এই প্রচারাভিযানে তিনি একাধিকবার পাকিস্তানি জান্তার হাতে গ্রেফতার হন, কারাবরণ করেন ও পরবর্তীতে জামিনে মুক্তি পেয়ে তার কর্মসূচি অব্যাহত রাখেন। এক পর্যায়ে ১৯৬৬ সালের ৮ এপ্রিল তিনি পাবনায় আসেন। আমি তখন এসএসসি পাস করে কলেজে ভর্তি হওয়ার জন্য অপেক্ষমাণ। জনসভা হবে বিকাল ৩টায় পাবনা টাউন হল ময়দানে। দুপুরে খাবারের আয়োজন ছিল তৎকালীন পাবনা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক আবদুর রব বগা মিয়ার বাসায়। তিনি আমার প্রতিবেশী এবং বলা বাহুল্য আমি তার পরিবারের একজন সদস্যের মতোই ছিলাম। বঙ্গবন্ধুকে দেখার বিশেষ সুযোগ হলো। বগা চাচা আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন বঙ্গবন্ধু ও তার সহকর্মী নেতাদের সঙ্গে। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা বঙ্গবন্ধুর অন্যতম ঘনিষ্ঠ সহচর শ্রদ্ধেয় এম মনসুর আলী পাশের মহল্লা মোক্তার পাড়ায় বাস করতেন। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তিনি ও কেন্দ্রীয় নেতা এম এইচ কামরুজ্জামানও ছিলেন। পরিচয়পর্ব শেষে একটু বিশ্রামের সময় পাবনা জেলা ছাত্রলীগ নেতা- আকবর মজিদ, শফিকুল আজিজ মুকুল, রবিউল ইসলাম রবি, আবদুস ছাত্তার লালু, সোহরাব উদ্দিন সোবা, আবুল আহসান গোরা প্রমুখকে উদ্দেশ করে বঙ্গবন্ধু বললেন ওকে অর্থাৎ আমাকেও যেন সভাস্থলে নিয়ে যাওয়া হয়। আমি তো এক দেখাতেই মুগ্ধ এবং তার নির্দেশ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অত্যন্ত আনন্দ ও উত্তেজনায় সভাস্থলে উপস্থিত হই। বঙ্গবন্ধু ও কেন্দ্রীয় নেতাদের বক্তৃতায় আমি মুগ্ধ শ্রোতা থেকে মনের অজান্তে জানি না কখন যে ছাত্রলীগের একজন সক্রিয় কর্মী হয়ে গেলাম। গগনবিদারী স্লোগানে মুখরিত টাউন হল ময়দানে ঘুরে ঘুরে ছাত্রলীগের একজন সক্রিয় কর্মী হিসেবে স্লোগান দিতে থাকলাম। তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা, মেঘনা, যমুনা...। পরবর্তীতে আমার পাবনা এডওয়ার্ড কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক, অবিভক্ত পাবনা জেলা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি ও পরে জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি হিসেবে ১৯৬৮ থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করার সুযোগ হয়েছিল। ১৯৬৬-এর ৬ দফা, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান ও পরবর্তীতে মহান মুক্তিযুদ্ধে সংগঠনে সক্রিয় ভূমিকা রেখে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করি। প্রকৃতপক্ষে ৬ দফা দাবির প্রতি আমার অকুণ্ঠ সমর্থনই আমাকে রাজনীতিতে সক্রিয় করতে নিয়ামক ভূমিকা রেখেছিল। স্বাধীন বাংলার স্বপ্নদ্রষ্টা যে বঙ্গবন্ধু, তার অন্যতম প্রধান উৎস মুক্তিসনদ-খ্যাত ৬ দফা দাবি। পাকিস্তান সাম্রাজ্যবাদী শক্তির শোষণ ও বঞ্চনা থেকে মুক্তিলাভ এবং স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার সোপান ছিল ৬ দফা আন্দোলন।

সমগ্র বাঙালি জাতির ৬ দফার প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন লক্ষ করে পাকিস্তানি জান্তা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। সামরিক শাসকদের নির্যাতন ও নিপীড়নে নিষ্পেষিত হয় আওযামী লীগের নেতা-কর্মীরা। ১৯৬৮ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধুসহ ৩৪ জনকে অভিযুক্ত করে বিচারের সম্মুখীন করা হয়। ৩৪ জনের মধ্যে অধিকাংশই সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী ও সিভিল প্রশাসনের কর্মকর্তা ছিলেন। বঙ্গবন্ধু ছিলেন মুখ্য অভিযুক্ত। প্রশ্ন থাকে জিয়াউর রহমান অভিযুক্ত ছিলেন না। তিনি তখন সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা ছিলেন। যারা স্বাধীন বাংলার চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে একত্র হয়েছিলেন তাদের মধ্যে তিনি তো ছিলেন না। তবে তিনি হঠাৎ কেমন করে স্বাধীনতার অন্যতম সংগঠক, নেতা বা কথিত ঘোষক হয়ে গেলেন?

স্বাধীনতার পর কয়েকবার বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ হয়েছিল। ওই সাক্ষাৎসমূহের মধ্যে একটি ঘটনা আমাকে সব সময় আলোড়িত করে। ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারিতে বঙ্গবন্ধু কাশিনাথপুর/নগরবাড়ীতে মুজিববাঁধ উদ্বোধন করেন। আমি তখন ছাত্রলীগের সভাপতি। প্রথমদিকে শ্রেণি-বিন্যাসে আমার বক্তৃতার সুযোগ ছিল। আমার বক্তৃতা শেষে বঙ্গবন্ধু দাঁড়িয়ে আমাকে জড়িয়ে কপালে চুমু দিয়ে বলেছিলেন- 'তুই তো ভালো বলিস।' অনুষ্ঠান শেষে হেলিকপ্টারে উঠার আগে তিনি তার সহযাত্রীদের সঙ্গে আমাকে ও তখনকার পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের অন্যতম নেতা বর্তমানে কেন্দ্রীয় নেতা ও মন্ত্রী মো. নাসিমকে তার হেলিকপ্টার উঠিয়ে ঢাকায় নিয়ে আসেন। উল্লেখ্য, বঙ্গবন্ধুর উদার মানসিকতার কারণে সে দিন আমার প্রথম হেলিকপ্টারে ভ্রমণের সুযোগ হয়েছিল।

১৯৭৩ সালের মাঝামাঝি সময়ে সংগঠনিক কার্যক্রমের অংশ হিসেবে বঙ্গবন্ধু পাবনায় আসেন। পাবনা স্টেডিয়ামের জনসভায় আমারও বক্তৃতা দেওয়ার সুযোগ হয়। বক্তৃতা শেষে তিনি আগের মতো আমাকে জড়িয়ে ধরেন। বঙ্গবন্ধুর স্নেহের পরশে আমি নিজেকে ধন্য মনে করি। বঙ্গবন্ধু আমার মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করেছিলেন, আমি যেন ভবিষ্যতে আরও উন্নতি লাভ করতে পারি।

৪ এপ্রিল ১৯৭৪ সালে অন্তর্দলীয় কোন্দলের জেরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুহসীন হলে কোহিনূরসহ সাতজন ছাত্রলীগ নেতাকে নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করা হয়। তখন ঢাকার পুলিশ সুপার ছিলেন মাহবুব উদ্দিন বীর বিক্রম। তিনি হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদ্ঘাটন করতে গিয়ে দেখেন, কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শফিউল আলম প্রধান নিজে নেতৃত্ব দিয়ে এ হত্যাকাণ্ডটি সংঘটিত করেছেন। এই হত্যাকাণ্ডে শফিউল আলম প্রধানসহ আর যাদের নাম তিনি উদ্ঘাটন করতে পেরেছিলেন তারা হলেন যথাক্রমে- ইমতিয়াজ আহমেদ কোরেশী, আব্বাস উদ্দিন আফসারী, হেমায়েত, সোহেল, মাসুদ, মহসিন উদ্দিন নীরু, শেখ রফিক, আনিস এবং মণ্ডল। তিনি বিষয়টি তৎকালীন অতিরিক্ত আইজিপি (এসবি) ই. এ চৌধুরীকে অবহিত করলে ই. এ চৌধুরী তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলীকে জানান। উল্লেখ্য, ওই সময়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মস্কোতে অসুস্থতার জন্য চিকিৎসারত ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর বিশ্বস্ত ও ঘনিষ্ঠ এই সহচর সাহসিকতার সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য তার সঙ্গী ২/১ জন সিনিয়র কেবিনেট কলিগের সঙ্গে পরামর্শ করে ক্ষমতাসীন দলের সহযোগী সংগঠন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকসহ অন্য নেতা-কর্মীদের গ্রেফতারের উদ্যোগ নেন।

৫ এপ্রিল ১৯৭৪ সালে মিরপুর রোডের ঢাকা কলেজের বিপরীতে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের নিচে সীতারাম মিষ্টান্ন ভাণ্ডার থেকে শফিউল আলম প্রধানকে ঢাকা জেলা পুলিশের বিশেষ শাখা গ্রেফতার করে। পর্যায়ক্রমে অন্য আসামিরাও গ্রেফতার হয়। পাবনা জেলা ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে আমি বিবৃতি দিয়ে এই সাহসী পদক্ষেপের জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে অভিনন্দন জানাই। রাজশাহী জেলা ছাত্রলীগ সভাপতি নুরুল ইসলাম ঠাণ্ডু এবং সাধারণ সম্পাদক মফিজ উদ্দিনও অভিনন্দন জানান। শফিউল আলম প্রধানকে গ্রেফতারে অভিনন্দন জানানোর জন্য কেন্দ্রীয় সভাপতি মনিরুল হক চৌধুরীর নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ পাবনা জেলা ছাত্রলীগের কমিটিকে বিলুপ্ত ঘোষণা করে। যা 'দৈনিক বাংলার বাণী' পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। চিকিৎসা শেষে বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে এসে সমগ্র ঘটনা জানতে পেরে গ্রেফতারের ঘটনার জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ সিনিয়র মন্ত্রীদের সাধুবাদ জানান। ওই সময় শফিউল আলম প্রধানের মুক্তির দাবিতে অনশনরত ছাত্রলীগ কর্মীদের আধা ঘণ্টার মধ্যে অনশন ভাঙার নির্দেশ দেন। অনশন না ভাঙলে তাদের গ্রেফতার করা হবে। এই নির্দেশে তারা অনশন ভঙ্গ করতে বাধ্য হন। উল্লেখ্য, দণ্ডপ্রাপ্ত এই শফিউল আলম প্রধানকে জিয়াউর রহমান ক্ষমতাসীন হওয়ার পর মুক্তি দিয়েছিলেন। আমার ছাত্রলীগ কমিটি বিলুপ্ত হওয়ায় স্বাভাবিকভাবে আমি ক্ষুব্ধ ছিলাম। বিষয়টি বঙ্গবন্ধুকে জানানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে আমি ঢাকায় আসি এবং শ্রদ্ধেয় এম মনসুর আলীর সহায়তায় '৭৪ সালের মে মাসের প্রথম সপ্তাহে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাতে সক্ষম হই। রমনা পার্কের গেট ও বেইলি রোডের মুখে সুগন্ধা নামীয় একটি রাষ্ট্রীয় ভবনে সকাল ৯টায় আমি, আমার সাধারণ সম্পাদক ফজলুল হক মন্টু ও আওয়ামী লীগ নেতা মো. নাসিমসহ আরও ২/১ জন সুগন্ধায় উপস্থিত হলে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সচিব তোফায়েল আহমেদ আমাদের বঙ্গবন্ধুর কাছে নিয়ে যান। বঙ্গবন্ধু তখন বারান্দায় বেতের চেয়ারে বসে দৈনিক পত্রিকাসমূহ পড়ছিলেন এবং চা পানরত ছিলেন। তোফায়েল আহমেদ আমাদের জানান, বঙ্গবন্ধু নির্ঘুম রাত কাটিয়েছেন। কাজেই তোমরা চিন্তা-ভাবনা করে কথা বলিও। বঙ্গবন্ধু আমাদের দেখে প্রথমেই বলেন- 'আমার মনটা খুবই খারাপ, পিএল ৪৮০-এর অধীনে চট্টগ্রাম অভিমুখে আগমনরত দুটি গমভর্তি জাহাজ একই সময়ে ভারতের বোম্বাই উপকূলে সমুদ্রগর্ভে ডুবে গেছে। আমি কি এই ষড়যন্ত্র বুঝি না? দেশের উত্তরাঞ্চলে খাদ্য সংকট চলছে, এই সময় একত্রে দুটি জাহাজ ডুবি আমার সরকারকে বিপদের সম্মুখীন করা', তিনি তখন অত্যন্ত আবেগতাড়িত ছিলেন। একজন বীর দেশপ্রেমিকের কণ্ঠে এ কথা শুনে আমরা আমাদের অভিযোগ থেকে দূরে থাকব বলে সিদ্ধান্ত নেই। কিন্তু তিনি কর্মীদের ভালোবাসেন বিধায় আমাদের কাছে বক্তব্য জানতে চাইলে আমরা ইতস্তত বোধ করি। পরে কমিটি বিলুপ্ত হওয়ার ঘটনা তাকে সবিস্তারে জানাই। বঙ্গবন্ধু রাগান্বিত কণ্ঠে আমাদের উদ্দেশে প্রশ্ন রাখেন- 'ছাত্রলীগ কার?' আমি হতবিহ্বল অবস্থায় হঠাৎ বলে উঠি বঙ্গবন্ধু, ছাত্রলীগ আপনার। তারপর বঙ্গবন্ধু আমাদের বলেন, তোরা পাবনায় ফিরে যা এবং তোদের স্বাভাবিক কাজকর্ম করে যা। আমি দেখব কে তোদের বিরত করে। বলা বাহুল্য, এরপর আমাদের জেলা ছাত্রলীগের কার্যক্রমে আর কোনো বাধা আসেনি। পরবর্তীকালে আমি পাবনা যুবলীগের সভাপতি হয়েছিলাম।

২৫ জানুয়ারি ১৯৭৫ সালে জাতীয় সংসদে চতুর্থ সংশোধনী বিল গৃহীত হয়। এই সংশোধনে আর্থ-সামাজিক মুক্তির লক্ষ্যে একটি জাতীয় দল গঠনের বিধান রাখা হয়। অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, বাসস্থান ও চিকিৎসা নিশ্চিত করার লক্ষ্যই ছিল বাকশাল গঠনের মূল উদ্দেশ্য। ১৯৭৫ সালের জুন মাসে বাকশালের কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষিত হয়। পরবর্তীতে জেলা গভর্নরসহ বাকশালে জেলা কমিটিসমূহ পর্যায়ক্রমে গঠিত হয়। বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্য ছিলাম বিধায় তিনি আমাকে পাবনা জেলা বাকশালের যুগ্ম সম্পাদক মনোনীত করেছিলেন। বর্তমান স্বাস্থ্যমন্ত্রী মো. নাসিম সাধারণ সম্পাদক মনোনীত হয়েছিলেন। কমিটি ঘোষিত হওয়ার পরে বাকশাল কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলীর মুখে বঙ্গবন্ধুর স্বহস্তে আমার নাম লেখার বিষয়টি শুনেছিলাম। আমার কাছে এর চেয়ে বড় পাওয়া আর কি হতে পারে।

পরবর্তী সময়ে আমরা পাবনা জেলা বাকশালের সম্পাদক ও পাঁচজন যুগ্ম সম্পাদক ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রোডের বঙ্গবন্ধু ভবনে এসে সাক্ষাৎ করি এবং সালাম জানাই। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে এই আমার শেষ দেখা। এই সাক্ষাতের সময় বঙ্গবন্ধু নিজেই অনানুষ্ঠানিকভাবে ছবি তোলার জন্য বললে তার নিজস্ব ক্যামেরাম্যান ছবি তোলেন যা এখনো আমার কাছে সংরক্ষিত আছে।

১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সালে খুনি মোশতাক চক্রের বুলেটের আঘাতে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে শহীদ করা হলে আমি এবং পাবনা আওয়ামী লীগ নেতা রফিকুল ইসলাম বকুলের নেতৃত্বে প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে এক বিশাল মিছিল শহর প্রদক্ষিণ করে। আমি, বেবি ইসলাম, রফিকুল ইসলাম বকুল, ফজলুল হক মন্টু, আবুল কালাম আজাদ, রেজাউল রহিম লাল-এর নেতৃত্বে অস্ত্র সংগ্রহ করে জোরালো প্রতিরোধ গড়ে তোলাকালীন সময়ে সকাল ৮টা/৮-৩০টায় পাবনার তৎকালীন পুলিশ সুপার পি. বি মিত্র আমাদের কোনো অ্যাকশনে যেতে নিষেধ করেন এবং তিনি জানান, তিন বাহিনীসহ বিডিআর প্রধান ও রক্ষীবাহিনী ইতিমধ্যে মোশতাক সরকারের আনুগত্য প্রকাশ করেছে। কাজেই তোমরা এখন আত্দগোপনে চলে যাও। তার পরামর্শে বিষয়টি অনুধাবন করে আমরা আত্দগোপনে চলে গেলেও আমি ২০ আগস্ট ১৯৭৫ খুনি মোশতাকের অনুগত বিপথগামী কতিপয় সেনাবাহিনী সদস্য ও পুলিশ বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হই। সামরিক আইনের ৭ ধারায় (সন্দেহভাজন) আমাকে গ্রেফতার করা হয়। আমার সঙ্গে আওয়ামী লীগ নেতা বর্তমান ভূমিমন্ত্রী শামসুর রহমান ডিলু গ্রেফতার হন। পর্যায়ক্রমে শামসুল হক টুকু, অ্যাড. আমজাদ হোসেন, অধ্যক্ষ আবদুল গণিসহ অনেক আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ নেতাকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারকৃতদের মধ্য থেকে আমাকে এবং ডিলু ভাইকে অমানুষিক নির্যাতন করা হয়। ১৯৭৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসের প্রথমদিকে গভীর রাতে জেলখানা থেকে আমাকে এবং ডিলু ভাইকে কালো কাপড় দিয়ে চোখ বেঁধে সেনা ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয় এবং বিভিন্ন উপায়ে নির্যাতন করা হয়। একদিন গভীর রাতে সেনা ক্যাম্প থেকে আমাদের দুজনকে চোখ বেঁধে কোনো এক নির্জন স্থানে নিয়ে যাওয়া এবং গর্জনের সুরে বলা হয় তোমরা মিছিল করেছিলে, শেখ মুজিব হত্যার প্রতিবাদ করেছিলে, সেই জন্য তোমাদের গুলি করে হত্যা করা হবে। কোনো কথা না বলে আমি শুধু ভেবেছি যেখানে এদের হাতে জাতির পিতা সপরিবারে শাহাদাতবরণ করেছেন সেখানে আমার জীবন-মরণে কি আসে যায়। আল্লাহর নাম নেওয়া অবস্থায় অনুভব করি, আমাদের আবার গাড়িতে উঠানো হচ্ছে। আমাদের মধ্যে ভীতি সঞ্চারের উদ্দেশ্যে এটা করা হয়েছিল এবং সেনা ক্যাম্প থেকে ফিরিয়ে এনে প্রায় অর্ধমৃত অবস্থায় আবারও কারাগারে পাঠায়। পরবর্তীতে কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে ভারতে অবস্থানরত মো. নাসিমের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য কলকাতায় যাই। কারাগারে থাকাকালীন আমার পরিবারের ওপর চলেছিল নির্মম নির্যাতন। আমার স্ত্রী সরকারের সাবেক যুগ্ম সচিব ড. রেবেকা সুলতানা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর হাতে নিগৃহীত হয়েছিলেন। পরিবারের সব সদস্য আর্থিক ও মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় আমিও ধীরে ধীরে একটি বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবন থেকে হারিয়ে যাই।

শোকাবহ এই আগস্ট মাসে স্মৃতিপটে আজও ভাসে সেই দুঃস্বপ্নের ইতিহাস। ১৫ আগস্টে বঙ্গবন্ধুসহ তার পরিবারের শাহাদাতবরণকারী সবার প্রতি জানাই আমার বিনম্র শ্রদ্ধা। কামনা করি তাদের আত্দা পরম শান্তিতে থাকুক।

 

 

সর্বশেষ খবর