মঙ্গলবার, ১৫ আগস্ট, ২০২৩ ০০:০০ টা

মীর জাফরদের দম্ভ বাংলা রক্তাক্ত

মো. সাহাবুদ্দিন চুপ্পু

মীর জাফরদের দম্ভ বাংলা রক্তাক্ত

নেতৃত্বের স্রষ্টা হলো ইতিহাস। আর এ ইতিহাসে যিনি সফল ও সার্থক অভিযাত্রী, তিনিই আবির্র্ভূত হন নন্দিত নেতারূপে। বাঙালির ইতিহাসের আদ্যোপান্তজুড়ে রয়েছে বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুঞ্জয়ী আদর্শের ছাপ। সে হিসেবে বাংলা ও বাংলাদেশের ইতিহাসের অভিষেক শুধু তাঁরই জন্য। ১৯৭৪ সালের ৪ নভেম্বর যখন বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন হচ্ছিল, তখন সংসদে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘‘ভাষাই বলুন, শিক্ষাই বলুন, সভ্যতাই বলুন, আর কৃষ্টিই বলুন, সকলের সাথে একটা জিনিস আছে, ওটা হলো অনুভূতি। এই অনুভূতি না থাকলে কোন জাতি বড় হতে পারে না। ... সেই অনুভূতি আছে বলেই আজ আমরা বাঙালি’’। বাঙালির বিগত ১ হাজার বছরের ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুই ছিলেন একমাত্র ‘ক্যারিশমেটিক লিডার’; যিনি বাঙালিদের সত্যিকারের স্বাধীনতা এনে দিতে এ জাতির অনুভূতিতে নাড়া দিতে পেরেছিলেন। এসব কারণেই বাংলাদেশ মানে বঙ্গবন্ধু, বঙ্গবন্ধু-সৃষ্ট স্বাধীন দেশ।

বাংলাকে কীভাবে সত্যিকারের স্বাধীনতা এনে দিলেন বঙ্গবন্ধু? একটা তথ্য উল্লেখ করলে বিষয়টি আরও পরিষ্কার হয়ে যাবে। বিদগ্ধ পাঠকমাত্রই জেনে থাকবেন, বিদেশি শাসকদের বিরুদ্ধে কালে কালে বহুবার বিদ্রোহ করেছে বাঙালি। কিন্তু তাদের কূটকৌশল ও সৈন্য-সামন্তের কাছে বরাবরই পরাজিত হয়েছে এ জাতি। সুস্পষ্ট করে বলতে গেলে এর আরও একটি কারণ ছিল- একজন যোগ্য ও দূরদর্শী নেতার অভাব। মুঘল আমলে বাংলার সুবেদাররা বিদ্রোহ করেছেন ঠিকই, কিন্তু তাঁদের কেউই স্বাধীনতার ধারেকাছে যেতে পারেননি। নবাবী যুগে বাংলা প্রদেশের ওপর মুঘল কর্তৃত্ব কিছুটা শিথিল ছিল; কিন্তু তারপরও এখানকার আঞ্চলিক শাসকদের মুঘল সম্রাটের আনুগত্য স্বীকার করতে হতো। এ ছাড়া বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন নৃপতি গোষ্ঠীভিত্তিক বাংলা স্বাধীন করলেও জনগণের পূর্ণ স্বাধীনতা তারা এনে দিতে পারেননি। ভাষা, সংস্কৃতি, সভ্যতা, রাজনীতি ও অর্থনীতিসহ সামগ্রিক বিবেচনায় মুক্তিযুদ্ধ সংগ্রাম করে স্বাধীন দেশ প্রতিষ্ঠার কৃতিত্ব একমাত্র বঙ্গবন্ধুই দাবি করতে পারেন। যেটি গত হাজার বছরে আর কেউ পারেননি।

সুবেদার, নবাব এমনকি ব্রিটিশ শাসনামল ও দেশ ভাগ পূর্ববর্তী-পরবর্তী সময়েও অনেক নেতা আমরা পেয়েছি এবং তাঁরাও জাতি গঠনে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে শুধু জনগণের জন্য মুক্তি-সংগ্রাম করে তাদের মুখপাত্র হয়ে ওঠা, তাদের ব্যথায় সমব্যথী হওয়া এবং তাদের ভাবনা, চেতনা, লক্ষ্য ও স্বপ্নকে নিজ জীবনের এক ও একমাত্র ব্রত হিসেবে ধারণ করার কাজটি পেরেছিলেন একজনই; তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আর এসব কারণেই তিনি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, অপ্রতিদ্বন্দ্বী মহানায়ক। তিনি সংগ্রামী, তিনি আপসহীন, তিনি শোষিতের বন্ধু, তিনি মৃত্যুঞ্জয়ী। বাংলাদেশ যতদিন থাকবে, এ পৃথিবী যতদিন থাকবে; বাঙালির হৃদয়ে ততদিন তিনি থাকবেন।

১৯৭৫ সালে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে মো. সাহাবুদ্দিন চুপ্পু (ডান থেকে দ্বিতীয়)

প্রসঙ্গক্রমে একটি বিষয় উল্লেখ না করলেই নয়। দুঃখজনক হলেও নির্মম সত্য যে, ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর প্রান্তরে বাংলার শেষ নবাব সিরাজউদ্দৌলার সঙ্গে বেইমানি করেছিল তাঁরই সেনাপতি মীর জাফর। কে জানত, ২০০ বছর পর সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটবে ১৯৭৫-এ এসে; তা-ও সেটা স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে তাঁরই মন্ত্রিপরিষদ সদস্য খন্দকার মোশতাক সেই কাজ করবেন। লক্ষ্য করলে দেখবেন- বিশ্বাসঘাতকতার পেছনে দুই খলনায়কেরই ইচ্ছা ছিল শীর্ষ নেতা হওয়ার। একজন চেয়েছিলেন নবাব হতে, অন্যজন রাষ্ট্রপতি। কিন্তু ইতিহাসের তথ্য হলো- সিরাজউদ্দৌলার ক্ষতবিক্ষত দেহ হাতির পিঠে চড়িয়ে ঘুরে বেড়ানো মীর জাফর যেমন তিন মাসের বেশি ক্ষমতায় থাকতে পারেনি, অন্যদিকে অঘোষিতভাবে রাষ্ট্রপতি হওয়া খুনি মোশতাক ছিলেন তিন মাসেরও কম সময় তথা ৮৩ দিন। ইতিহাসে দুজনেরই স্থান হয়েছে বেইমানির দলে, অপরপক্ষে নবাব সিরাজউদ্দৌলা এবং বঙ্গবন্ধু রয়ে গেছেন কোটি মানুষের হৃদয়ে।

আজ ১৫ আগস্ট। রক্তের কালিতে লেখা ভয়াল কলঙ্কময় ও ঘৃণার বিষবাষ্প ছড়িয়ে পড়ার দিন। ‘কোনো বাঙালি আমার গায়ে হাত তুলতে পারে না, হাত তুলতে গেলে সেই হাত কাঁপবে’- মর্মে বঙ্গবন্ধুর অন্ধ বিশ্বাস ভঙ্গের দিনও এই আজ। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে যখন সপরিবারে হত্যা করা হয়, সে সময় কবি মীর গুল খান ছিলেন কারাগারে বন্দি। বঙ্গবন্ধু হত্যার ১৪ দিন পর ২৯ আগস্ট কারাগারে বসেই তিনি একটি কবিতা লিখেন। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে এটাই সম্ভবত প্রথম কবিতা। ‘ছোব কুজা ইন্ত- ভোর কোথায়?’ শিরোনামের ওই কবিতায় মীর গুল লিখেছেন-

‘‘চিৎকার, ক্রন্দন আর শশব্যস্ত আহ্বানের মধ্যে

উল্লাস করছে অন্ধ জনতা। ওরা বলে, ‘এখন ভোর’,

কিন্তু জীবনপানে তাকিয়ে

আমি দেখি রাত্রি, ঘোর অমানিশা।

বিদ্যুৎ চমকানো আর বজ্রপাতে মনে হয় দূরে বৃষ্টি হচ্ছে,

কিন্তু বাতাসে বৃষ্টির নামগন্ধ নেই

রক্তের ধারা বইছে প্রবল।’’

 

ভরদুপুরে মধ্য গগনের সূর্যে যেমন গ্রহণ লাগে, অন্ধকারে নিমজ্জিত হয় বিশ্বচরাচর; ঠিক তেমনি সেদিনের জনকের মহাপ্রয়াণ ছিল জাতির ভাগ্যাকাশে সবচেয়ে বড় সূর্যগ্রহণ। কারণ এটাই যে, বঙ্গবন্ধু শুধু বঙ্গের বন্ধু নন; তিনি ছিলেন পৃথিবীর বন্ধু। নির্যাতিত, নিগৃহীত ও নিষ্পেষিত দুনিয়ার কণ্ঠস্বর। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ভারত বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক ও বিশিষ্ট সাহিত্যিক নীরদ সি. চৌধুরী বাঙালিদের ‘বিশ্বাসঘাতক’ হিসেবে বর্ণনা করে বলেছিলেন, “বাঙালি জাতির স্বপ্নদ্রষ্টা শেখ মুজিবকে হত্যার মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতি বিশ্বের মানুষের কাছে নিজেদের আত্মঘাতী চরিত্রই তুলে ধরেছে।” ‘দ্য টাইমস অব লন্ডন’-এর ১৬ আগস্ট সংখ্যায় উল্লেখ করা হয় : “সবকিছু সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধুকে সব সময় স্মরণ করা হবে। কারণ তাঁকে ছাড়া বাংলাদেশের অস্তিত্ব অকল্পনীয়।” একই দিন লন্ডন থেকে প্রকাশিত ‘ডেইলি টেলিগ্রাফ’ পত্রিকায় বলা হয় : ‘বাংলাদেশের লাখ লাখ লোক শেখ মুজিবের জঘন্য হত্যাকাণ্ডকে অপূরণীয় ক্ষতি হিসেবে বিবেচনা করবে।”

 

।। দুই।।

বছর ঘুরে ১৫ আগস্ট এলেই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কাটানো কয়েকটি মুহূর্ত ও কিছু কথা স্মৃতিপটে ভেসে ওঠে। ব্যক্তিজীবনে আমি নিজেকে ভাগ্যবান মানুষ দাবি করি। মোটাদাগে এর কারণ হতে পারে দুটো। এক. আমি বাসযোগ্য পৃথিবীর ভ্রাতৃত্ব-সম্প্রীতিতে ভরা বাংলাদেশে জন্মেছি। দুই. সেই দেশেরই প্রথম রাষ্ট্রপতি, বিশ্বের প্রভাবশালী রাজনীতিবিদের একজন জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে আমার রাজনীতির হাতেখড়ি। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয় তাঁর ৬ দফাকালীন এক উত্তাল সময়ে। ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের পর ১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে এ দাবি পেশ করেছিলেন জাতির পিতা। এটি ছিল মূলত যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা দাবির ১৯ নম্বর দফার বর্ধিত সংস্করণ; যেটাকে সংক্ষেপে উত্থাপন করে, আলাদা এজেন্ডা বানিয়ে একটি আন্দোলনে রূপ দিতে সক্ষম হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। পশ্চিম পাকিস্তানিরা ভেবেছিল, ৬ দফা প্রশ্নে এ দেশের জনগণ বিভক্ত হয়ে যেতে পারে অথবা তারাই এটি দিয়ে বিভক্ত করে ফেলতে পারবেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু তা হতে দেননি। এ জন্য তিনি শুধু ৬ দফা দিয়ে ক্ষান্ত থাকেননি, বরং এর পক্ষে অগণিত সভা-সমাবেশ করেছেন। সমকালীন সময়ে দেখেছি ও বুঝেছি- পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ৬ দফাকে স্বাধীনতার সিঁড়ি ভাবতেন জাতির জনক। এর যথেষ্ট কারণও ছিল। পূর্ব পাকিস্তানে ইতিপূর্বে ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন, বৈষম্যমূলক শিক্ষানীতি বাতিলের দাবিতে ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন তীব্র গতি পেলেও সেখানে সবার অংশগ্রহণ ছিল না। তা ছাড়া আগের আন্দোলনগুলোয় ছাত্ররাই মুখ্য ভূমিকা পালন করেছেন। কিন্তু ৬ দফাই প্রথম বড় আন্দোলন; যেখানে সর্বস্তরের মানুষের বাঁচা-মরা, সামাজিক, রাজনৈতিক এমনকি অর্থনৈতিক আন্দোলন হিসেবে আখ্যা পেয়েছিল। আবার এ আন্দোলনের মাধ্যমে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে পূর্ণাঙ্গরূপে জাতীয় নেতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান।

বঙ্গবন্ধু বলতেন, ‘৬ দফায় যে পূর্ব পাকিস্তানের ৭ কোটি শোষিত-বঞ্চিত আদম সন্তানের কথাই প্রতিধ্বনিত হইয়াছে, তাতে আমার কোনো সন্দেহ নাই।’ তাঁর নির্দেশেই এ কর্মসূচি সংবলিত ‘৬ দফা : আমাদের বাঁচার দাবি’ পুস্তিকা দারুণভাবে সাড়া ফেলে। অধিকার আদায়ের এসব চিন্তা থেকেই ৬ দফার আন্দোলন দেশব্যাপী প্রচার করতে শুরু করেন বঙ্গবন্ধু। প্রচারণার এ ধারাবাহিকতাতেই ১৯৬৬ সালের ৮ এপ্রিল (শুক্রবার) পাবনার টাউন হলে সমাবেশ করতে আসেন তিনি। সেদিন সমাবেশে যাওয়ার আগে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুর রব বগা মিয়ার বাসায় কিছুটা সময় বিশ্রাম করেন বঙ্গবন্ধু। সেখানেই দীর্ঘদেহী এ রাষ্ট্রনায়ককে প্রথমবারের মতো দেখলাম, কথা বলার সুযোগ পেলাম। বগা চাচা আমাকে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। পাশে থাকা এম মনসুর আলী, এ এইচ এম কামারুজ্জামানসহ অন্য নেতাদের সঙ্গেও কথা হলো। বঙ্গবন্ধু আমার নাম-পরিচয় জিজ্ঞেস করলেন। পড়াশোনার খোঁজখবর নিলেন, বেশকিছু দিকনির্দেশনা দিলেন। সর্বশেষ বললেন, টাউন হলের ৬ দফা আন্দোলনের সমাবেশে যেতে। আমি তখন পাবনার রাধানগর মজুমদার একাডেমি থেকে সদ্য এসএসসি পাস করে এডওয়ার্ড কলেজে ভর্তির প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। বয়সও কম। মাত্র ১৭ বছর। রাজনীতির সবটা না বুঝলেও ৬ দফার প্রতিটি দাবি যে আমাদের বাঁচার একেকটি মূলমন্ত্র; ততটুকু বোঝার ক্ষমতা তখন হয়েছে। হয়তো এ কারণেই বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ মানা না মানার বিষয়ে ‘সেকেন্ড থট’ দেইনি। তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিয়ে জনসভায় গেলাম। বঙ্গবন্ধু ও কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের বক্তৃতা শুনলাম। বুঝতে পারলাম, বঙ্গবন্ধুর ভাষণের মূলকথা হলো- পাকিস্তানের সংহতি ও অখণ্ডতা রক্ষা করতে হলে লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পূর্ব পাকিস্তানকে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন ও সম্পূর্ণ বিষয়ে স্বাধীনতা দিতে হবে। উভয় অংশের সংহতি বাড়াতে হলে ৬ দফা বাস্তবায়নের মাধ্যমে এ অঞ্চলের মানুষের চাওয়া-পাওয়ায় মনোযোগী হতে হবে। সেদিন বঙ্গবন্ধু এ-ও বলেছিলেন, একটি রাষ্ট্রের কেন্দ্র শক্তিশালী হলেই যে প্রদেশগুলো শক্তিশালী হয়ে যাবে- এমন কোনো কথা নেই। বরং ফেডারেটিং ইউনিটগুলোর প্রত্যেকটিকে স্বাধীনতা দিলেই রাষ্ট্রটি শক্তিশালী হয়ে উঠবে। অর্থাৎ ভাষণে বঙ্গবন্ধু অখণ্ড পাকিস্তানের ইঙ্গিত যতটা না দিয়েছেন, তার চেয়ে ঢের বেশি দিয়েছিলেন পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনে গুরুত্ব; যা ছিল আদতে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা।

বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণ শুনতে শুনতে মনের অজান্তে আমিও যেন এ ৬ দফা আন্দোলনের অন্যতম স্লোগানদাতা হয়ে গেলাম। মাধ্যমিকেই বঙ্গবন্ধুর প্রতি অনুপ্রাণিত ছিলাম। কিন্তু ঘণ্টাখানেকের ব্যবধানে আমি যেন তাঁর রাষ্ট্রীয় আন্দোলনের অন্যতম সক্রিয় কর্মী। সেই সক্রিয় প্রবেশ কিছুক্ষণ আগেই বঙ্গবন্ধুর সমাবেশে যাওয়ার নির্দেশের মধ্য দিয়ে ঘটল। মূলত রাজনীতিতে আমার হাতেখড়ি ওইদিন থেকেই শুরু হলো।

৮ এপ্রিল পাবনা আসার ঠিক এক মাস পর ১৯৬৬ সালের ৮ মে ওই ৬ দফার প্রচার-প্রচারণা চালাতে গিয়ে দেশরক্ষা আইনে গ্রেফতার হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। গ্রেফতারের কারণ এটাই ছিল- ৬ দফার পক্ষে মাত্র দেড় মাসে (২০ মার্চ-৮ মে) মোট ৩২টি জনসভা করেছিলেন তিনি। বঙ্গবন্ধু গ্রেফতারের প্রতিবাদে ৭ জুন গোটা প্রদেশজুড়ে সাধারণ ধর্মঘট ও হরতালের ডাক দেওয়া হয়। সারা দেশে অন্তত ৩ হাজার নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়। ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে হরতালের সমর্থনে মিছিল বের করলে পুলিশের গুলিতে অন্তত ১০ জন নিহত হন। আমার জেলা পাবনাতেও বিক্ষোভ-সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়; যেখানে আমিও ছিলাম একজন ক্ষুদ্র সমর্থক ও কর্মী। বাঙালির স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের সিঁড়ি ৬ দফা, এর স্বপক্ষে বঙ্গবন্ধুর প্রচার-প্রচারণা এবং তাঁর গ্রেফতার- পুরো এ বিষয়টি আমাকে ভীষণভাবে নাড়া দেয়। বিশেষ করে এক মাস আগে প্রথমবারের মতো দেখা বঙ্গবন্ধুর গ্রেফতার হওয়ার বিষয়টি যেন কোনোভাবেই মানতে পারছিলাম না। তখন থেকেই কায়মনোবাক্যে বঙ্গবন্ধুর আন্দোলনে শরিক হওয়ার পূর্ণ সিদ্ধান্ত নিলাম; যা আজও চলছে।

আজও মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি- নিজে যত যোগ্যই হই না কেন, আর বর্তমান অবস্থা যা-ই হোক; কৈশোর জীবনে যদি পিতা মুজিবের কয়েক মিনিটের সাক্ষাৎ ও পরবর্তীতে কয়েকটি সাক্ষাতে দিকনির্দেশনা না পেতাম; তবে আজকের আমি ‘এই আমি’ হতে পারতাম কি না তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। তাঁর (বঙ্গবন্ধু) অনুপ্রেরণাই যে আমাকে ১৭ বছর বয়সে সক্রিয় আন্দোলনে প্রবেশ করিয়েছে। তাঁর উৎসাহই যে আমাকে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধরনের দায়িত্ব গ্রহণ ও তা পালনে উৎসাহ জুগিয়েছে; তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই।

জীবদ্দশায় বঙ্গবন্ধুর সংস্পর্শে আরও কয়েকবার আসার সুযোগ আমার হয়েছে। যতবার দেখা হয়েছে, ততবারই তাঁর কাছ থেকে নতুন কিছু শিখেছি। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দ্বিতীয় স্মরণীয় সাক্ষাৎটি হয়েছিল দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারিতে। যদিও এর মধ্যে আরও কয়েকবার বঙ্গবন্ধুকে দেখা ও তাঁর বক্তব্য শোনার সুযোগ হয়েছে। ’৭২-এর ফেব্রুয়ারি মাসে বন্যাকবলিত মানুষকে বাঁচাতে কাশিনাথপুর/নগরবাড়ীতে বাঁধের নির্মাণকাজ উদ্বোধনে জাতির জনকের আগমন ছিল পাবনাবাসীর জন্য আশীর্বাদস্বরূপ। বলে রাখা ভালো, ১৯৭০ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী ইশতেহারে বঙ্গবন্ধু এ অঞ্চলের বন্যা মোকাবিলায় বাঁধ নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছিলেন। এটি ছিল তাঁর দূরদর্শী সিদ্ধান্তের হাজারো প্রমাণের একটি। দূরদর্শী এ কারণে যে, একসময় পাবনা জেলার অধিকাংশ এলাকা বন্যা মৌসুমে প্লাবিত হতো। বাঁধটি নির্মিত হওয়ায় গোটা জেলার মানুষ বন্যা থেকে যেমন রক্ষা পেয়েছে, তেমনিভাবে কৃষিক্ষেত্রে এসেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন।

আজও মনে পড়ে, নগরবাড়ী এলাকার পুরান ভারেঙ্গা ইউনিয়নের বসন্তপুর গ্রামে আয়োজিত সংক্ষিপ্ত ওই জনসভায় বঙ্গবন্ধুর আসার খবরে দূরদূরান্ত থেকে হাজার হাজার মানুষ এসে জড়ো হতে থাকে ওই এলাকায়। বঙ্গবন্ধুকে এক নজর দেখতে আসা মানুষে কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায় নগরবাড়ীসহ এর আশপাশের এলাকা। জনসভা পরিণত হয় জনসমুদ্রে। বঙ্গবন্ধুর ওই জনসভায় স্বাগত বক্তব্যের দায়িত্ব পড়েছিল আমার ওপর। কী বলেছিলাম মনে নেই, তবে বক্তৃতা শেষে মঞ্চ থেকে যখন নামতে যাব, ঠিক তখনই হাত ধরে বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরেছিলেন বঙ্গবন্ধু। কপালে চুমু দিয়ে বলেছিলেন- তুই ভালো বলিস। পরে এই ভেবে আনন্দিত হয়েছিলাম যে, মাত্র ১৮ মিনিট বক্ততৃায় যিনি ৭ কোটি মানুষকে এক সুতোয় গেঁথেছিলেন, লাখ লাখ মানুষকে রাস্তায় নামিয়েছেন; সেই মানুষটি যখন আমার ভাষণের প্রশংসা করলেন, তখন সেটা নিঃসন্দেহে ছোট ব্যাপার নয়। যাই হোক, সেদিন পাবনাকে রক্ষায় নিজ হাতে মাটি কেটে ১৫৭.৫৫ কিলোমিটার দীর্ঘ বাঁধ নির্মাণের কাজ উদ্বোধন করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। এরপর এলাকার হাজারো মানুষ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বাঁধটির নির্মাণকাজ শেষ করেন; যা আজও পদ্মা-যমুনাবেষ্টিত পাবনার কাছে রক্ষাকবচ। পরবর্তীতে আমরা পাবনাবাসীই বঙ্গবন্ধুকে ভালোবেসে এ বাঁধের নামকরণ করি ‘মুজিব বাঁধ’।

এখানে ছোট্ট একটি বিষয় উল্লেখ না করলেই নয়। সেদিন বাঁধ উদ্বোধন শেষ হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু হেলিকপ্টারে উঠতে যাচ্ছিলেন, এমন মুহূর্তে আমার কাছে জানতে চাইলেন- ঢাকা যাব কি না? মুহূর্তের মধ্যে রাজি হয়ে গেলাম। প্রথমবারের মতো হেলিকপ্টার ভ্রমণের সুযোগ হলো, তা-ও স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে।

বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে শেষ দেখা হয়েছিল তাঁর চলে যাওয়ার দুই মাস আগে; ১৯৭৫-এর জুনে। ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রোডের বাসায়। ‘হাফ শার্ট’ ও ‘লুঙ্গি’ পরা সেদিনের বঙ্গবন্ধু আজও আমার চোখের সামনে এক উজ্জ্বল প্রতিবিম্ব। তাঁর শেষ নির্দেশনাও আমার সারা জীবনের চলার পাথেয়। আর সেদিনের তোলা ছবি এখনো আমার কাছে সর্বশেষ স্মৃতিচিহ্ন!

 

।। তিন।।

বঙ্গবন্ধু, স্বাধীনতা এবং বাংলাদেশ- তিনটি একই সূত্রে গাঁথা। বঙ্গবন্ধু ও তাঁর আদর্শকে বাদ দিয়ে অতীতে বাংলাদেশের কোনো অস্তিত্ব ছিল না, ভবিষ্যতেও থাকার সুযোগ নেই। হাজার বছর ধরে ‘এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম’ আহ্বানের অপেক্ষায় থাকা বাঙালির মুক্তির জন্য কী কষ্ট-সংগ্রামই না তিনি করেছিলেন! স্বাধীনতা ও মুক্তি- শব্দ দুটি বঙ্গবন্ধুর শুধু পছন্দেরই ছিল না, ছিল জীবনের একমাত্র ব্রতও। এক গবেষণায় দেখা গেছে, শৈশব জীবন বাদ দিলে বঙ্গবন্ধু তাঁর ৫৫ বছর জীবনের ৪০ শতাংশ সময় রাজনীতির ময়দানে আর ৪৪ শতাংশ সময় জেলে কাটিয়েছেন। অর্থাৎ জীবনের ৮০ শতাংশের বেশি সময় দেশের মানুষের স্বাধীনতা ও অধিকার আদায়ের জন্য ত্যাগ স্বীকার করেছেন বঙ্গবন্ধু। অথচ সেই জাতিরই কিছু কুলাঙ্গার তাঁর বিশ্বাস ভঙ্গ করে ঘৃণ্য হত্যায় শামিল হন।

ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্ট একবার বঙ্গবন্ধুকে প্রশ্ন করেছিলেন, “Mr. Mujib, What is your strengh?” বঙ্গবন্ধু তাৎক্ষণিকভাবে উত্তর দিলেন, ‘‘I love my people.” বঙ্গবন্ধুকে তিনি পাল্টা প্রশ্ন রেখেছিলেন, “Mr. Mujib, what is your weakness?” কিছুটা সময় নিয়ে উত্তরটা বঙ্গবন্ধু দিয়েছিলেন এভাবে, You want to know my weakness. I love my people too match. উত্তর শুনে মুগ্ধ হয়ে ডেভিড ফ্রস্ট বলেছিলেন “Wonderful, Mr. Mujib, Wonderful. You are God gifted.” পরবর্তী আলাপচারিতায় তিনি মন্তব্য করতে বাধ্য হয়েছিলেন, I am interviewed many world leader, like Nixon, John F Kennedy, Sir Edward Smith, Mr. Fidel Castro. Mr. Basement, Mr. Mujib is unmatchable, unparalleled. He has been born to liberate this nation.

বঙ্গবন্ধুর জীবন শঙ্কায় রয়েছে- ডেভিড ফ্রস্টের এমন প্রশ্নের জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘‘যে মানুষ মরতে রাজি তাকে কেউ মারতে পারে না। আপনি একজন মানুষকে হত্যা করতে পারেন। সে তো তার দেহ। কিন্তু তার আত্মাকে কি আপনি হত্যা করতে পারেন? না, তা কেউ পারে না। এটাই আমার বিশ্বাস।’’ বঙ্গবন্ধুরা মরে না, তাদের মরতে নেই। তারা বেঁচে থাকেন কোটি মানুষের হৃদয়ের গভীরে, হৃদয়ের গহিনে। তারপরও আমরা কবি মহাদেব সাহার মতো প্রশ্ন করতে চাই,

 

‘‘...তোমার রক্ত নিয়েও বাংলায় চালের দাম কমেনি

তোমার বুকে গুলি চালিয়েও কাপড় সস্তা হয়নি এখানে,

দুধের শিশু এখনো না খেয়ে মরছে কেউ থামাতে পারি না

বলতে পারিনি তাহলে রাসেলের মাথার খুলি মেশিনগানের

গুলিতে উড়ে গেল কেন?’’

 

আমরা বিশ্বাস করি- আমাদের বঙ্গবন্ধু বেঁচে ছিলেন, বেঁচে থাকবেন। লাল-সবুজের পতাকায়, ৩০ লাখ শহীদের রক্তস্নাত মানচিত্রে। শিশির বিন্দুতে, উত্তাল সাগরের তরঙ্গমালায়; সোঁদা মাটির গন্ধে, কৃষ্ণচূড়ার লাল ফুলে। বঙ্গবন্ধু মানে বাংলাদেশ, বাংলাদেশ মানেই বঙ্গবন্ধুর দেশ। তিনি কেবল একটি নাম, ব্যক্তি বা জাতির পিতা নন; বরং একটি চেতনা, একটি দর্শন, একটি আদর্শ। তিনি আমাদের মৃত্যুঞ্জয়ী, তিনি আমাদের চিরঞ্জীব।

বঙ্গবন্ধু, বঙ্গমাতা বেগম শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব, তিন ছেলে শেখ কামাল, শেখ জামাল ও শিশু শেখ রাসেল, পুত্রবধূ সুলতানা কামাল ও রোজী জামালসহ ১৫ আগস্টের সব শহীদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।

লেখক : রাষ্ট্রপতি, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ

সর্বশেষ খবর