শিরোনাম
মঙ্গলবার, ১৫ আগস্ট, ২০২৩ ০০:০০ টা

স্মৃতি চিরঞ্জীব ও শোকাবহ ১৫ আগস্ট

বিচারপতি ওবায়দুল হাসান

স্মৃতি চিরঞ্জীব ও শোকাবহ ১৫ আগস্ট

ফেলে আসা দিনের স্মৃতি আসলে পথ দেখায়। স্মৃতি কখনো মলিন হয় না। জীবনে চলতে গিয়ে ফেলে আসা প্রাত্যহিক ঘটনাগুলো যখন পুরনো হয়ে যায় তখনই সেগুলো আমাদের কাছে স্মৃতি হয়ে সামনে আসে। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে যারা আত্মোৎসর্গ করেছেন তাঁদের মধ্যে বেশ কয়েকজন ছিলেন আইনজীবী। দেশের বিভিন্ন আইনজীবী সমিতিতে তাঁদের সদস্যপদ ছিল। সারা বাংলাদেশের অধিকাংশ আইনজীবী সমিতিগুলোতে খোঁজ নিলে দেখা যাবে তাঁদের স্মৃতি সংরক্ষণের জন্য কোনো স্মৃতির স্মারক মিনার গড়ে উঠেনি বা আইনজীবী সমিতির সদস্যরা তাঁদের পূর্বসূরিদের স্মৃতি ধরে রাখার কোনো চিন্তাও করেননি। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর দেশ হয় সম্পূর্ণভাবে শত্রুমুক্ত। গর্বের প্রত্যাশিত বিজয় লাভ করে বাঙালি জাতি। দেশের মানুষ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে থাকে কোন দিন স্বাধীন বাংলায় ফিরে আসবেন বঙ্গবন্ধু। অপেক্ষার পালা শেষ হয় ১০ জানুয়ারি ১৯৭২। সেদিন বাংলার মাটিতে ফিরে আসেন বাংলা ও বাঙালির আরাধ্য সন্তান জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্র পুনর্গঠনে নিজেকে ব্যাপৃত করেন। চরম ঘৃণিত কাপুরুষ হন্তারকের বুলেটের আঘাতে শাহাদাতবরণ পর্যন্ত তিনি সেই কাজে নিরলসভাবে নিবৃত থেকেছেন। দেশ স্বাধীনের মাত্র ১০ মাসেরও কম সময়ে তিনি স্বাধীন রাষ্ট্রের সংবিধান প্রণয়ন করেছেন। বিশ্বের সাংবিধানিক ইতিহাসে এ এক বিরল ঘটনা। বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন ছিল বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের শ্রেষ্ঠতম অর্জনগুলোর মধ্যে অন্যতম। এটি ছিল তাঁর জীবনব্যাপী লালিত রাজনৈতিক দর্শনের শ্রেষ্ঠ এক দলিল। কলঙ্কিত ’৭৫-পরবর্তী বহু সামরিক, স্বৈরাচারী ও অগণতান্ত্রিক শাসনের রক্তাক্ত ছোবল এ পবিত্র দলিলকে ক্ষতবিক্ষত করেছে বহুবার। তবু আজও আমাদের সংবিধান স্বমহিমায় টিকে আছে, যা জাতির পিতার অমল দর্শনের বহিঃপ্রকাশ। বাহাত্তরের সেই সংবিধানের ষষ্ঠ ভাগ দ্বারা সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলাদেশের বিচার বিভাগ ও বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের প্রতিষ্ঠা।

আমাদের সংবিধান ও সুপ্রিম কোর্ট প্রতিষ্ঠার ৫০ বছর পূর্তি হয়েছে ২০২২ সালের ডিসেম্বর মাসে। সুপ্রিম কোর্টের উদ্যোগে বাংলাদেশের সংবিধান ও সুপ্রিম কোর্ট প্রতিষ্ঠার ৫০ বছর পূর্তিতে সুপ্রিম কোর্ট উদযাপন করছে বর্ষব্যাপী সুবর্ণজয়ন্তী। সুবর্ণজয়ন্তীর বছর প্রায় শেষের পথে। এ সুবর্ণজয়ন্তীকে স্মরণীয় করে রাখতে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট স্থাপন করেছে একটি সৌধ স্মারক। এটি সেই স্থানে স্থাপন করা হয়েছে যেখানে ১৯৭২ সালের ১৮ ডিসেম্বর সোমবার পৌষ মাসের এক স্নিগ্ধ বিকালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বক্তব্য প্রদানের মধ্য দিয়ে সুপ্রিম কোর্টের উদ্বোধন করেছিলেন। এ স্মারকস্তম্ভ বা সৌধ স্মারকে সংবিধানে বঙ্গবন্ধুর স্বাক্ষরকালীন মুহূর্তের একটি ছবি ম্যুরাল আকারে স্থাপন করা হয়েছে। তা ছাড়া বাহাত্তরের হাতে লেখা সংবিধানের প্রস্তাবনার পৃষ্ঠা ও ষষ্ঠ ভাগে বর্ণিত বিচার বিভাগ সম্পর্কিত একটি পৃষ্ঠা- এ দুটি পৃষ্ঠার প্রতিলিপিও এখানে অঙ্কিত আছে। সৌধ স্মারকটির মাঝখানে স্থাপিত হয়েছে বঙ্গবন্ধুর একটি বড় ম্যুরাল। ১৯৭২ সালের ১৮ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট উদ্বোধনের সময় বঙ্গবন্ধু সুপ্রিম কোর্টের ইনার গার্ডেনে দাঁড়িয়ে যখন ভাষণ দিচ্ছিলেন সেই সময়কার তোলা তাঁর একটি ছবির অনুকরণেই তৈরি হয়েছে এ ম্যুরাল।

১৯৭২ সালে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু যে ভাষণ দিয়েছিলেন সে ভাষণ ছিল অনন্য প্রজ্ঞার স্ফূরণে শাণিত ও দ্যুতিময় চিন্তায় উদ্ভাসিত। আইন ও জুরিসপ্রুডেন্স বিষয়ে পৃথিবীর সব মহৎ চিন্তাবিদ ও জুরিস্টের ভাবনার সারৎসার যেন উঠে এসেছে তাঁর সেদিনের সেই ভাষণে। তিনি সেদিন বলেছিলেন :

‘আজ সত্যিই আনন্দ প্রকাশ করতে হয় এই জন্য যে, স্বাধীন বাংলার মাটিতে আজ আমাদের স্বাধীন সুপ্রিম কোর্ট প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। স্বাধীন জাতি হিসেবে যদি স্বাধীন সুপ্রিম কোর্ট না থাকে তাহলে সে জাতি পরিপূর্ণতা লাভ করতে পারে না।’

আইনের শাসন বিষয়ে তিনি বলেছিলেন :

‘আইনের শাসনে আমরা বিশ্বাস করি এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত করার জন্যই আমরা সংগ্রাম করেছি এবং এই আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত করার জন্যই অনেক মানুষের রক্ত দিতে হয়েছে। বাংলাদেশে আইনের শাসনই প্রতিষ্ঠিত হবে। সে জন্যই শাসনতন্ত্র এত তাড়াতাড়ি দিয়েছিলাম। আমরা চাই যে, দেশে আইনের শাসন কায়েম হউক।’

বিচারকদের উদ্দেশে সেদিন বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন :

‘আপনাদের পূর্ণ স্বাধীনতা রয়েছে। কেউ কোনোদিন হস্তক্ষেপ করবে না আপনাদের অধিকারের ওপরে। সে সম্বন্ধে আপনারা নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন এবং যতটা তাড়াতাড়ি হয় আমরা চেষ্টা করব যাতে জুডিশিয়ারি সেপারেটভাবে কাজ করতে পারে।’

বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ ও স্বাধীনতা বিষয়ে জাতির পিতার প্রদত্ত সেদিনের সেই দিকনির্দেশনামূলক বক্তৃতার আলোকে আমরা দায়িত্ব পালনে যথাসম্ভব সদা সচেষ্ট রয়েছি।

জাতির পিতা সেদিনের ভাষণে আরেকটি বিষয় উল্লেখ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধে আইনাঙ্গনের যাঁরা শহীদ হয়েছেন তাঁদের নামের একটি তালিকা যদি এ সুপ্রিম কোর্টের আঙিনায় থাকত তাহলে ভালো হতো। অনেক দেরিতে হলেও এ স্মারকস্তম্ভ নির্মাণের মধ্য দিয়ে সুপ্রিম কোর্ট জাতির পিতার সেই নির্দেশ পালন করতে সক্ষম হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে শহীদ আইন ব্যক্তিত্বদের নামের একটি তালিকা এ স্মারকস্তম্ভে প্রতিলিপিত করা হয়েছে। গত ২৮ জুলাই শুক্রবার ১৩ শ্রাবণের সকালে এই স্মারক সৌধটি উদ্বোধন করেন জাতির পিতার কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি তাঁর ভাষণে আবেগাপ্লুত অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নয় জাতির পিতার কন্যা হিসেবে তাঁর স্মৃতিময় স্থানে নির্মিত স্মৃতি চিরঞ্জীব উদ্বোধন করতে পেরে আমি আনন্দিত।’ বাংলাদেশে সুপ্রিম কোর্টও জাতির পিতার কন্যার সুপ্রিম কোর্টে আগমনকে অকৃত্রিমভাবে স্বাগত জানিয়েছে। জাতির পিতার পদস্পর্শে ধন্য সুপ্রিম কোর্টের ইনার গার্ডেনে তাঁর প্রদত্ত ভাষণ ও মহান মুক্তিযুদ্ধে আত্মদানকারী আইনজীবীগণের স্মৃৃতি একত্রে ধরে রাখার জন্য বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট এ স্মারক সৌধটির নামকরণ করেছে ‘স্মৃৃতি চিরঞ্জীব।’

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের জন্য একটি স্বাধীন রাষ্ট্র ও এর সংবিধান এবং সুপ্রিম কোর্ট প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় যে, এ দেশের কিছু বিপথগামী পাশব প্রকৃতির মানুষ দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের মধ্য দিয়ে তাঁকে ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট সপরিবারে হত্যা করে। সময়টি ছিল শুক্রবার সুবেহ সাদেকের পর। তখন মসজিদের মিনার চূড়া থেকে ভেসে আসছিল উদাত্ত আহ্বান ‘আসসালাতু খায়রুম মিনান নাউম’। মুসল্লিরা ফজরের নামাজের জন্য মসজিদের দিকে এগুতে থাকেন। ঠিক তখনই ধানমন্ডি মোহাম¥দপুর ও রমনা এলাকার সাধারণ মানুষ গুলির শব্দে ঘুম থেকে জেগে ওঠে। মুসল্লিরা হতচকিত ও ভীত হয়ে এদিক-সেদিক তাকাতে থাকেন। তারা কোনো কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলেন না। কী হলো? কিছুক্ষণ পর রেডিওতে সম্প্রচারিত মেজর ডালিমের ঘোষণায় দেশবাসী চমকে ওঠে, হতবাক হয়, স্তব্ধ হয়। জানতে পারে, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা হয়েছে। দেশে সামরিক আইন জারি করা হয়েছে। নির্বাক বিস্মিত বেদনার্ত হয় জাতি। অনেকেই এ ঘোষণা বিশ্বাস করতে পারছিল না। বেতারে কিছুক্ষণ পরপর ঘাতক মেজর ডালিমের একই ঘোষণা সম্প্রচারিত হচ্ছিল। সেদিনের এ বর্বর হত্যাকান্ডের ঘটনায় বিশ্বও হয়েছিল বেদনার্ত, হতবাক।

বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে কলঙ্কময় নির্মম এ হত্যাকান্ডের ঘটনায় সারা দেশে বিক্ষিপ্ত কিছু প্রতিবাদ হলেও কেন্দ্রীয়ভাবে সেদিন বড় কোনো প্রতিবাদ বা প্রতিরোধ গড়ে ওঠেনি। দেশের মানুষ ছিল স্তম্ভিত বাকহীন। বিশ্বাসঘাতক খন্দকার মোশতাক নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করে এবং বিকালবেলা একুশ সদস্যবিশিষ্ট মন্ত্রিসভা গঠন করে। ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর কুখ্যাত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বেগম শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিবসহ বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্যগণ ও ওই কালরাতে যাঁরা নিহত হয়েছিলেন তাঁদের হত্যাকান্ডের সঙ্গে জড়িত ঘাতকদের বিচারের পথ রুদ্ধ করে তাদের পুরস্কৃত করা হয়েছিল, যা সভ্য বিশ্বে নজিরবিহীন। সেই সঙ্গে বিচারহীনতার এ গ্লানি ছিল জাতির জন্য চরম এক আঘাত।

বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর স্নেহময়ী বোন শেখ রেহানা তাঁদের পিতা ও প্রিয় স্বজনদের হত্যাকান্ডের বিচার চাওয়ার অধিকার থেকে বহুদিন ছিলেন বঞ্চিত। এ বঞ্চনা ও অধিকারহীনতা ছিল তাঁদের প্রতি এক অমানবিক নিপীড়ন। কুখ্যাত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারির মধ্য দিয়ে জাতির পিতার হত্যার বিচার চাওয়ার অধিকার রুদ্ধ করে রাখা হয়েছিল। অধ্যাদেশটি যখন সংসদে রিপিল করা হলো সেটি চ্যালেঞ্জ করা হয় সুপ্রিম কোর্টে। সুপ্রিম কোর্ট সেদিন সংসদ কর্তৃক প্রণীত ইনডেমনিটি রিপিল অ্যাক্টকে একটি বৈধ আইন বলে স্বীকৃতি দেয়। ফলে সুগম হয় বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের বিচারের পথ। সব অবৈধ বাধা পেরিয়ে বিচার হয় খুনিদের।

সম্প্রতি প্রকাশিত আমার লেখা ‘বঙ্গবন্ধু, রবীন্দ্রনাথ ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ’ শীর্ষক বইয়ের একটি প্রবন্ধে উল্লেখ করা হয়েছে-

‘১৫ আগস্ট ১৯৭৫ যে নারকীয় হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়েছিল সেটির সূত্রপাত ১৫ আগস্টেই হয়েছিল এ কথা মনে করলে ভুল করা হবে। এর মূল বা শিকড় প্রোথিত হয়েছে অনেক আগেই। সামরিক-বেসামরিক কিছু কুশীলবের ষড়যন্ত্রের মধ্য দিয়ে এ নির্মম নজিরবিহীন হত্যাকান্ডটি সংঘটিত হয়। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সরকারের প্রথমদিকে খন্দকার মোশতাককে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। তার কার্যকলাপ তৎকালীন মুজিবনগর সরকারের কাছে সন্দেহজনক মনে হওয়ায় তাকে মন্ত্রিসভায় রাখা হলেও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কার্যকলাপ থেকে অনেকটা বিরত রাখা হয়। তখন থেকেই খন্দকার মোশতাক তৎকালীন মার্কিন সরকারের মাধ্যমে পাকিস্তানের সঙ্গে একটি সমঝোতায় আসা যায় কি না তার চেষ্টা করছিল। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে ধূর্ত মোশতাক বঙ্গবন্ধুর উদারতার সুযোগে তাঁর সরকারে ঠাঁই করে নিতে পেরেছিল। ১৯৭২ সাল, দেশ স্বাধীন হয়েছে ঠিকই কিন্তু প্রশাসনের সর্বস্তরে পরিবর্তন আনা সম্ভব হয়নি। একটি ভগ্নস্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে সরকার পরিচালনা করতে গিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে পাকিস্তানপন্থি যেসব চাকরিজীবী যুদ্ধকালীন নয় মাস পাকিস্তান সরকারের স্বার্থরক্ষা করে কাজ করেছেন তাদের সবাইকে সরিয়ে দেওয়া সম্ভব হয়নি। এরকম একটি অবস্থায় সামরিক-বেসামরিক চাকরিজীবীদের অনেকেই তাদের মধ্যে সুপ্ত অবস্থায় থাকা পাকিস্তানপন্থি রাজনৈতিক চেতনাপ্রসূত কার্যকলাপ চালিয়ে যেতে থাকে। তারা গোপনে যোগাযোগ রাখতে থাকে খন্দকার মোশতাকসহ আরও কিছু রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে, যারা সেদিন বঙ্গবন্ধুর মহানুভবতার সুযোগে তাঁর খুব কাছে যেতে পেরেছিল। ওই লোকগুলো কারা? যারা একদিন বঙ্গবন্ধুর সামান্য সহানুভূতি পাওয়ার জন্য উদ্বিগ্ন হয়ে থাকত, তারাই অতঃপর সংকীর্ণ স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য হয়ে উঠেছিল অস্থির। এ ষড়যন্ত্রের অন্যতম হোতা ছিল খন্দকার মোশতাক আহমেদ, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, কে এম ওবায়দুর রহমান, তাহের উদ্দিন ঠাকুরের মতো বঙ্গবন্ধুর এক সময়ের আস্থাভাজন রাজনৈতিক নেতারা (সূত্র : বেইমানির ইতিবৃত্ত, মানিক মো. রাজ্জাক, পৃষ্ঠা-৪১)। উল্লিখিত এ চারজন ছাড়াও খন্দকার মোশতাকের অসাংবিধানিক শাসনামলে মন্ত্রিত্বের আসনে আসীন হয়ে মোশতাকের অবৈধ কার্যকলাপকে সহায়তা দিয়ে গেছেন বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভায় যারা ১৫ আগস্ট সকাল পর্যন্ত সদস্য ছিলেন তাদের মধ্যে অন্ততপক্ষে ২০ জন সদস্য। এ ২০ জন সদস্যের মধ্যে পরবর্তীতে কেউ কেউ আওয়ামী লীগের মূল ধারায় ফিরে এলেও প্রকাশ্যে তারা তাদের কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত হয়েছেন বা ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন এমনটি কখনো শোনা যায়নি। আবার অনেকেই জিয়া এরশাদের নেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক সংগঠনে যোগদান করে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনা ও ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির বিপরীতে অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন।’

বঙ্গবন্ধুর হত্যাকান্ডে র অন্যতম নায়ক সৈয়দ ফারুক রহমান প্রয়াত সাংবাদিক মিজানুর রহমান খানের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিল- ‘Sheikh Mujib is the victim of those who are beneficiaries of his lifelong political activities’. অর্থাৎ ‘শেখ মুজিব তাদের কার্যক্রমের বলি হয়েছেন যারা তাঁর আজীবনের রাজনীতির সুবিধাভোগী ছিলেন’। কথাটি একজন ঘাতকের মুখের হলেও তাকে অসত্য বলা যাবে না। তাকে অসত্য বললে ভুল হবে। যারা ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোররাত পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন, তাদের দেখা গেল ১৫ আগস্ট বিকালবেলা খন্দকার মোশতাকের মন্ত্রিসভায় সহাস্যে শপথ নিচ্ছেন। কী অমানবিকতা! অন্যদিকে আরেকটি চিত্র দেশবাসী বিস্ময়ের সঙ্গে প্রত্যক্ষ করেছেন। সেটি হলো- ১৫ আগস্টের পর জাতীয় চার নেতাসহ বহু রাজনৈতিক নেতাকে কারান্তরালে নিক্ষেপ করা হয়েছিল। কারণ তারা খন্দকার মোশতাকের সরকারকে সমর্থন করতে পারেননি। মিজানুর রহমান খানের লিখিত বই- ‘মার্কিন দলিলে মুজিব হত্যাকান্ড’-এ উল্লেখ করা হয়েছে- শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার উৎখাত করতে মেজর সৈয়দ ফারুক রহমান ১৯৭৪ সালের ১৩ মে সন্ধ্যায় ‘উচ্চতর পর্যায়ের বাংলাদেশ সেনা কর্মকর্তার নির্দেশে’ মার্কিন প্রশাসনের কাছে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব করেছিল। ১৯৭৪ সালে ফারুকের অভ্যুত্থান ঘটানোর এ অশুভ আগ্রহ প্রকাশের বিষয়টি ঢাকায় নিযুক্ত তৎকালীন রাষ্ট্রদূত ডেভিস ইউজিন বোস্টার ওয়াশিংটনে পররাষ্ট্র দফতরকে ২১৫৮ নম্বর গোপন তারবার্তার মাধ্যমে ১৯৭৪ সালের ১৫ মে অবহিত করেছিলেন। (পৃষ্ঠা-৪৮)। সাংবাদিক মিজানুর রহমান খানের সঙ্গে সাক্ষাৎকার প্রদানকালে সৈয়দ ফারুক রহমান বলেছিল ‘জিয়াউর রহমানকে ক্যান্টনমেন্টস্থ বাসভবনের চত্বরে বসে প্রস্তাব দেওয়ার পর তিনি আমাকে উৎসাহিত করলেন কিন্তু সহযোগিতার আশ্বাস দিলেন না-।’ (প্রাগুক্ত পৃষ্ঠা-৩৩০)।

প্রখ্যাত মার্কিন সাংবাদিক লরেন্স লিফসুলজ কর্নেল আবু তাহের হত্যা মামলায় বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাই কোর্ট বিভাগের একটি ডিভিশন বেঞ্চে ১৪ মার্চ ২০১১ তারিখে একটি বিবৃতি প্রদান করেন। তিনি আদালত কক্ষে বলেছিলেন, ‘শেখ মুজিব হত্যাকান্ডে জিয়াউর রহমান পরোক্ষভাবে জড়িত ছিলেন। লিফসুলজ আরও বলেছিলেন, জিয়া আগস্ট অভ্যুত্থানের খেলোয়াড়দের মধ্যে অন্যতম একজন। তিনি চাইলে অভ্যুত্থান হয়তো বন্ধ করতে পারতেন। কারণ, এই ষড়যন্ত্র সম্পর্কে তিনি আগেই ওয়াকিবহাল ছিলেন’ (সূত্র : মার্কিন দলিলে মুজিব হত্যাকান্ড, মিজানুর রহমান খান, পৃষ্ঠা ৪৯-৫০)।

২০০৫ সালে দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে লিফসুলজ লিখেছিলেন, ‘মেজর রশিদ এক বৈঠকে প্রশ্ন তুললেন, অভ্যুত্থানের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের মনোভাব কী হবে? জিয়া ও মোশতাক উভয়ই আলাদাভাবে বললেন, তাঁরা এ বিষয়ে মার্কিনিদের মনোভাব জেনেছেন। দুজনের উত্তর একই রকম ছিল। তাঁরা বললেন, এটা (মুজিবকে সরানো) মার্কিনিদের জন্য কোনো সমস্যা নয়। আমি তখন অনুভব করলাম মার্কিনিদের সঙ্গে জিয়া ও মোশতাকের আলাদা যোগাযোগের চ্যানেল রয়েছে।’ (প্রাগুক্ত পৃষ্ঠা-৫০)।

১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদী ভাবধারায় প্রতিষ্ঠিত ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র বাংলাদেশের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য পরিবর্তনের অশুভ চেষ্টা ছিল প্রবল। ১৫ আগস্ট বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারত ও সোভিয়েত রাষ্ট্রদূত ঢাকায় ছিলেন না। ভারতীয় হাইকমিশনার সমর সেন গাড়িতে চেপে কলকাতা হয়ে ১৬ আগস্ট ঢাকায় পৌঁছান। তিনি হাইকমিশনে তার সহকর্মী এবং ঢাকার বন্ধুদের সঙ্গে অনেক বৈঠক সেরে ১৮ আগস্ট বঙ্গভবনে মোশতাকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এরপর সমর সেন তাঁর হাতে থাকা একখন্ড কাগজে যা লেখা ছিল তা পড়ে শোনানোর পর খন্দকার মোশতাক বিমর্ষ চেহারায় ধপ করে চেয়ারে বসে পড়েন। এতে লেখা ছিল, ‘যদি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের নাম পরিবর্তন করা হয় এবং কোনো দেশের সঙ্গে কনফেডারেশন করা হয়, তাহলে ভারতের কাছে থাকা বৈধ চুক্তির আওতায় ভারতের সেনাবাহিনী যথাযথ পদক্ষেপ নেবে। কিন্তু আপনি যদি নাম পরিবর্তন এবং তথাকথিত কনফেডারেশনের ধারণা থেকে বিরত থাকেন, তাহলে ভারত ১৫ আগস্ট থেকে যা-ই ঘটুক না কেন, তাকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় হিসেবে বিবেচনা করবে।’ (প্রাগুক্ত পৃষ্ঠা-১১০)। উল্লিখিত কথাগুলো থেকে তখনকার ভারত সরকারের মনোভাব যেমন প্রকাশ পায় ঠিক তেমনি আরেকটি বিষয় অনুধাবন করার মতো, সেটি হলো সেদিন যদি ভারত সরকারের পক্ষ থেকে এ ধরনের বক্তব্য উপস্থাপন করা না হতো তাহলে হয়তো বাংলাদেশ নামক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রটির রাজনৈতিক চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য পরিবর্তন হয়ে যেত।’

১৫ আগস্টের কুশীলবরা সেদিন বাঙালি সংস্কৃতির ওপর আঘাত হেনেছিল চরমভাবে। বাংলাদেশ বেতার রাতারাতি হয়ে উঠল রেডিও বাংলাদেশ। কৌশলে রেডিও বাংলাদেশ রবীন্দ্রনাথের গান বর্জন করেছিল। সাময়িকভাবে গীতা পাঠও বন্ধ হয়েছিল। যে কোনো অনুষ্ঠান শেষে জয় বাংলা উচ্চারণের পরিবর্তে তারা বাংলাদেশ জিন্দাবাদ স্লোগানটির প্রচলন করে। তবে গীতা পাঠ ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান তারা বেশিদিন বন্ধ রাখতে পারেনি। কিন্তু রেডিও বাংলাদেশ ও বাংলাদেশ জিন্দাবাদ এ শব্দগুলোর ব্যবহার সরকারিভাবে ১৯৯৬ সালের প্রথমার্ধ পর্যন্ত বহাল ছিল।

ওপরের তথ্যভিত্তিক আলোচনা থেকে এ ধারণা পাওয়া যায়, ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের হত্যাকান্ড নিছক কোনো সামরিক অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতার পটপরিবর্তনের প্রয়াস ছিল না। এটি ছিল বাঙালি রাষ্ট্রসত্তার মূলে কুঠারাঘাত ও এ জাতিসত্তার প্রতিষ্ঠাতা হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধুকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেওয়ার এক ঘৃণ্য প্রয়াস, যে পরিকল্পনা বা ষড়যন্ত্র হয়তোবা লোকচক্ষুর অন্তরালে ঘটনা-পূর্ববর্তী দীর্ঘদিন যাবৎ চলে আসছিল। সময় এসেছে এটি সবার জানার যে, কী ষড়যন্ত্র ছিল ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের মির্মতার পেছনে। দায় শোধের জন্য নিরপেক্ষ তদন্ত কমিশনের মাধ্যমে সব সত্য সামনে আসা প্রয়োজন। এটি জাতির প্রত্যাশা।

সবশেষে বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই জাতির পিতা ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের প্রতি যাঁদের ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের কালরাতে বুলেটের আঘাতে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল। সশরীরে নেই তবুও বঙ্গবন্ধু স্মৃতি হয়ে আছেন সবার অন্তরে, রইবেন- চিরঞ্জীব হয়ে।

লেখক : বিচারপতি, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট আপিল বিভাগ

সর্বশেষ খবর