স্ত্রী আরজুমান্দ বানু বেগম (মুমতাজ মহল) এর মৃত্যুর পর তার স্মৃতির উদ্দেশ্যে তাজমহল নির্মাণ করেছিলেন মুঘল সম্রাট শাহজাহান। ঠিক তেমনি করোনায় স্ত্রীর মৃত্যুর পর তার স্মৃতিকে চিরস্মরণীয় করে রাখতে অভিনব পন্থা নিলেন স্বামী।
প্রায় আড়াই লাখ রুপি খরচ করে স্ত্রীর আদলে সিলিকনের মূর্তি তৈরি করলেন ৬৫ বছর বয়সী পশ্চিমবঙ্গের সাবেক সরকারি কর্মকর্তা তাপস শান্ডিল্য।
কলকাতার ভিআইপি রোডের ধারে কৈখালীর বাসিন্দা তাপস বাবু স্ত্রী ইন্দ্রানীকে প্রচন্ড ভালবাসতেন, সম্মান করতেন। অবশ্য ভালবাসারই কথা! কিন্তু করোনায় আক্রান্ত হয়ে ২০২১ সালের ৪ মে নিজের সহধর্মীনীর মৃত্যুর পর তার স্মৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতেই এই অভিনব চিন্তা তাপসের।যদিও তাপসের এই কর্মকাণ্ডকে দেখে কেউ বলছেন প্রচারের আলো পেতেই তিনি এই কাজটি করেছেন, কারও অভিমত তার এই অঙ্গভঙ্গি অস্বাস্থ্যকর। তবে কেউ কেউ আবার তার এই উদ্যোগের প্রশংসাও করেছেন। তবে তাপসের বক্তব্য তিনি তার নিজের মতো করে স্ত্রীকে সম্মান জানাতে চেয়েছেন।
জানা গেছে, স্ত্রী ইন্দ্রানী বেঁচে থাকাকালীন সময়ে এক দশক আগে তাকে নিয়ে রাজ্যটির নদীয়া জেলার মায়াপুরে ইসকনের মন্দিরে গিয়েছিলেন তাপস শান্ডিল্য। সে সময়ই এক হিন্দু দেবতার মূর্তিকে দেখিয়ে স্বামীর কাছে আবদার করেছিলেন স্বামীর আগে যদি স্ত্রীর মৃত্যু হয়, তবে তাকেও যেন ঠিক এভাবে সাজানো হয়। এরপর করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে মৃত্যু হয় স্ত্রীর। স্ত্রীর মৃত্যুর পরে সে কথাই বারে বারে মনে পড়ছিল তাপসের। আর সেই চিন্তা ভাবনা থেকেই তার প্রতি এই সম্মান জানানোর পন্থা। কৈখালী নিজের বাড়িতেই স্ত্রীর এই সিলিকনের মূর্তি তৈরি করেছেন তিনি।
নিজের সঙ্গী হারানোর ব্যথা খুবই কষ্টের। কাছের মানুষটির চির বিদায়ের পর অনেকেই বিভিন্নভাবে তাদের সেই প্রিয় মানুষটিকে মনে রাখার জন্য একাধিক উদ্যোগ নিয়ে থাকেন।
সেখানে তাপস শান্ডিল্যর এই সম্মান জানানোর অভিনব পন্থা নেওয়ার পরই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছেন তিনি।
সংবাদ মাধ্যমে তিনি জানান, "আমি একটা কথাই বলতে চাই যে, স্ত্রীর যে ইচ্ছা, সেটাই আমি পূর্ণ করেছি মাত্র।"
তিনি আরো জানান, "দেড় বছর আগে স্ত্রীর মৃত্যু হলেও তার ইচ্ছাকে মর্যাদা দিতে আমি সঠিক ভাস্কর্যের সন্ধানে ছিলাম, যিনি আমার চাহিদাকে পূরণ করতে পারবেন। ২০২২ সালে গিয়ে সুবিমল দাস নামে এক ভাস্কর্য শিল্পীর খোঁজ পাই। এরপরই ইন্দ্রানীর আদলে স্ট্যাচু তৈরির কাজ শুরু করা হয়। পুরো কাজ শেষ হতে সময় লাগে প্রায় ছয় মাস।"
আর ইন্দ্রানীর শরীরের গঠন, মুখের ভাবভঙ্গি আনতে সুবিমলকে সহায়তা করেন তাপস। এমনকি বারাসাতের যে দর্জির কাছে ইন্দ্রানী মাঝে মধ্যেই যেতেন, সেখানে গিয়েও দর্জির সাথে কথা বলা হয়, যাতে ইন্দ্রানীর পরিহিত কাপড়টি সঠিকভাবে লাগানো যায়।
সিলিকনের এই মূর্তির ওজন প্রায় ৩০ কেজি, এটি তৈরিতে খরচ পড়েছে আড়াই লাখ রুপি। স্ত্রী স্বর্ণের গহনা পরতে পছন্দ করতেন। তাই সিলিকনের মূর্টিতেও স্বর্ণের গহনা গড়িয়ে পরিয়ে দিয়েছেন স্বামী তাপস শান্ডিল্য। যে আসামি সিল্কের শাড়ি পরে ছেলের বিয়ের অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন স্ট্যাচুতে সেই শাড়িটিও পরিয়ে রাখা হয়েছে। এছাড়াও হাতে রয়েছে শাঁখা, পলা, হাত ঘড়ি, ভ্যানিটি ব্যাগও এবং কপালে সিন্দুর। ঘরের মধ্যে ইন্দ্রানী যে সোফায় বসে বেশি সময় কাটাতেন, সেই সোফার উপরেই বসানো হয়েছে ইন্দ্রানীর এই ভাস্কর্যটি। দেখে বোঝার উপায়ই নেই যে, ইন্দ্রানী দেবী আজ ইহলোকে নেই।
তবে একজন মৃত মানুষকে এভাবে ভাস্কর্য স্থাপন করে ঘরেই সাজিয়ে রাখা কিংবা এভাবে সম্মান জানানোর পন্থাকে প্রথমে সমর্থন জানায়নি তার পরিবারের সদস্যরাও। তাপস জানান, "আমার পরিবার এই ধরনের জীবন-সদৃশ ভাস্কর্য স্থাপনের কঠোরভাবে বিরোধিতা করেছিল। এরপর আমার কিছু আত্মীয় এবং প্রতিবেশীরা সাহায্য করেছিল। আমার যুক্তি ছিল কারো মৃত্যুর পর আমরা যদি ঘরে ফ্রেমবন্দি ছবি রাখতে পারি, তাহলে মূর্তি কেন রাখা যাবে না। পরে অবশ্য আমার মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া হয়।"
তাপস আরো জানান, "করোনার সময় স্ত্রী যখন দক্ষিণ কলকাতার একটি হাসপাতালে ভর্তি ছিল, আমি তখন বাড়িতেই আইসোলেশন হোমে ছিলাম। সেই পরিস্থিতির কথা কখনো বলার নয়। কিন্তু স্ত্রীর এই ভাস্কর্য তৈরি আমাকে সব সময় মনে করিয়ে দেয় যে স্ত্রী আমার সাথেই আছেন।"
অন্যদিকে কলকাতায় ভাস্কর্য শিল্পী হিসেবে পরিচিত ৪৬ বছর বয়সী সুবিমল জানান, "মৃতা ইন্দ্রানী শান্ডিল্যর চেহারা ও মুখের প্রকৃত অবয়ব আনতে তার বিভিন্ন অ্যাঙ্গেলের ছবি সংগ্রহ করা হয়েছিল। এরপর প্রথমে মাটি দিয়ে তার একটি মূর্তি তৈরি করা হয়েছিল। পরে সেই মূর্তির উপরে সিলিকনের প্রলেপ দেওয়া হয়।"
তার অভিমত, "চেহারায় সাদৃশ্য আনা, চুল আঁচড়ানোর ধরন, গায়ের রং আনাটা একটা চ্যালেঞ্জের বিষয়। শুধুমাত্র ধূষর রং এর চুল করতেই এক মাস সময় নিয়েছিলাম।"
বিডি-প্রতিদিন/বাজিত