২২ মার্চ, ২০২৩ ১০:১৭

যেভাবে বাংলাদেশ থেকে ঘরে ফিরলো ছেলে, আনন্দে আত্মহারা ভারতীয় বাবা-মা

কলকাতা প্রতিনিধি

যেভাবে বাংলাদেশ থেকে ঘরে ফিরলো ছেলে, আনন্দে আত্মহারা ভারতীয় বাবা-মা

ছেলে সুভাষ রায়

অবেশেষে নানা আইনি জটিলতা কাটিয়ে বাবা-মায়ের কোলে ফিরেছে ছেলে সুভাষ রায়। প্রায় দুই বছর আগে ভারতের উত্তরপ্রদেশের এক অখ্যাত গ্রামের বাড়ি থেকে নিখোঁজ হয়ে যায় ২২ বছর বয়সী সুভাষ। সে তখন বন্ধুদের সাথে খেলা করছিল। বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা, সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত। কিন্তু ছেলে আর বাড়িতে ফেরেনি। এর পর অনেক খোঁজাখুঁজি করেছিলেন সুভাষের বাবা লক্ষ্মণ প্রসাদ ও মা সুনীতা। পরিচিত কাউকে দেখলেই ছেলের খোঁজ নিতেন, কিন্তু কেউই সুভাষের সন্ধান দিতে পারেনি। একসময় ছেলে ফিরে পাওয়ার সমস্ত আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন ভারতের উত্তরপ্রদেশের রামনগর কণ্ডা গ্রামের বাসিন্দা। কিন্তু কথায় আছে 'রাখে আল্লাহ মারে কে!' 

২০২২ সালের আগষ্ট মাসে হঠাৎ করে বাংলাদেশ থেকে ফোন যায় সুভাষের গ্রামের বাড়িতে, ফোনে বলা হয় তাদের একমাত্র ছেলে বেঁচে আছে। এরপর থেকে বেশ কয়েক মাস ধরে 'গ্লোরী সমাজ উন্নয়ন সংস্থা' নামে বাংলাদেশেরই একটি বেসরকারি আশ্রয় কেন্দ্রে থাকে সুভাষ। সেখান থেকেই ভিডিও কলে ছেলের সাথে কথাও বলেন তার বাবা-মা। আর এরপর থেকেই ছেলেকে ফিরে পেতে উদগ্রীব হয়ে ওঠেন লক্ষ্মণ ও সুনীতা। 

অবশেষে মঙ্গলবার (২১ মার্চ) বাংলাদেশ-ভারতের বেনাপোল-পেট্রাপোল আন্তর্জাতিক স্থলবন্দর দিয়ে ভারতে প্রবেশ করে সুভাষ। তাকে নিতে ভারতীয় পাড়ে উপস্থিত ছিল তার বাবা-মা, গ্রামের এক প্রতিবেশী, গুজরাট রোটারী ক্লাব বারুচ'এর সদস্য রিজওয়ানা শানকিন জামিনদার প্রমুখ। সুভাষকে তাদের বাবা মায়ের হাতে তুলে দিতে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশের বেসরকারি একটি টেলিভিশন চ্যানেলের সিনিয়র ভিডিও জার্নালিস্ট মোহাম্মাদ শামসুল হুদা। 

ছেলেকে কাছে পেয়ে উল্লাসিত সুভাষের বাবা-মা। আড়াই বছর পর তাদের দেখে চিনতে ভুল করেনি সুভাষও। বাবা-মা বলে ডেকে উঠে ছেলে। আনন্দে একসময় চোখের কোণে পানি চলে আসে। ছেলের মুখে গালে হাত বোলাতে থাকে, জড়িয়ে ধরেন ছেলেকে। এসময় সীমান্তে বাবা-মা ও ছেলের মধ্যে এক আবেগঘন পরিবেশ তৈরি হয়। পরে সেই রেশ কাটিয়ে সুভাষকে নিয়ে পেট্রাপোল থেকে সড়ক পথে যশোর রোড, কলকাতা হয়ে গাড়ি পৌঁছায় হাওড়া স্টেশনে। এদিনই স্থানীয় সময় রাত বারোটার ট্রেনে চেপে উত্তরপ্রদেশে গ্রামের বাড়ির দিকে রওনা দেন তারা। 
তবে তার আগে এদিন রাতের দিকে উত্তর ২৪ পরগনা জেলার বারাসাত প্রেস ক্লাবের গণমাধ্যমের কর্মীদের মুখোমুখি হন সুভাষের মা সুনীতা দেবী, রিজওয়ানা শানকিন জামিনদার, মোহাম্মাদ শামসুল হুদা। প্রত্যেকেই সুভাষের নিখোঁজ হয়ে যাওয়া এবং ফিরে আসার ঘটনার কথা তুলে ধরেন। 

জানা যায় ২০২১ সালের জুন মাসের গোড়ার দিকে বাংলাদেশের নীলফামারী জেলার ডিমলা থেকে সুভাষকে উদ্ধার করা হয়। এরপর আহত অবস্থায় একজন রিক্সা চালক তাকে ডিমলা থানায় পৌঁছে দেন। পরবর্তীতে নীলফামারী থানার পুলিশ কর্মকর্তাদের সহায়তায় ২০২১ সালের ১৩ জুন সুভাষকে ভর্তি করানো হয় রংপুর মেডিকেল কলেজে এন্ড হাসপাতালের নিউরোসায়েন্স বিভাগে। এও জানা যায় ভর্তির সময় সুভাষের কোমরের হাড় ভাঙ্গা ছিল। চিকিৎসা শেষে ওই বছরের ১৬ সেপ্টেম্বর সুভাষকে ছেড়ে দেওয়া হয়। কিন্তু ঠিকানা না জানার কারণেই চিকিৎসার পরেও দীর্ঘ সময় ধরে হাসপাতালের বারান্দায় পড়েছিলেন তিনি। পরে বাংলাদেশ সমাজসেবা অধিদফতরের পক্ষ থেকে "গ্লোরী সমাজ উন্নয়ন সংস্থা" নামে একটি বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কাছে সুভাষকে হস্তান্তর করা হয়। আর সেসময় বড় ভূমিকা রাখেন ওই আশ্রয় কেন্দ্রের পরিচালক এম. এ. মারুফ কেইন। মূলত তার উদ্যোগেই রংপুর মেডিকেল কলেজে সুভাষের মেরুদন্ডের অস্ত্রপ্রচার হয় এবং ধীরে ধীরে অনেকটাই সুস্থ হয়ে উঠে। তবে অস্ত্রপ্রচার করলেও পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠতে পারেনি সুভাষ। সেক্ষেত্রে হুইলচেয়ারে করে বসেই তাকে চলাফেরা করতে হচ্ছে। 

দিনমজুর খেটে সংসার চালানো লক্ষ্মণের পরিবারে একমাত্র উপার্জনকারী ব্যক্তি তিনিই। সুভাষ ছাড়াও তার ছোট দুই বোনও রয়েছে। ছোটবেলা থেকেই মানসিক প্রতিবন্ধী সুভাষ। ছেলেকে সুস্থ করতে সাধ্যমতো চেষ্টাও করেন তার বাবা-মা। কিন্তু তাতে কোন লাভ হয়নি। যদিও দিনমজুর পরিবারে সুভাষ বেশ আদরের। কিন্তু হঠাৎ করেই সুভাষের নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার পর থেকেই তার বাবা-মাও উদ্বিগ্নে রাত কাটাতে থাকেন। যদিও ছেলে বেঁচে আছে এবং সে একদিন ঘরে ফিরে আসবে- এই শান্তনা নিয়েই দিন যাপন করতে থাকে তারা। 

তবে বাবা-মা এর কাছে তাদের হারিয়ে যাওয়া ছেলের এই সন্ধান পাওয়াটাও এত টা সহজ হত না, যদি না এক্ষেত্রে কার্যত উপস্থিত না হতেন বাংলাদেশেরই এক সিনিয়র ভিডিও জার্নালিস্ট। দেশটির বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের সিনিয়র ভিডিও জার্নালিস্ট মোহাম্মাদ শামসুল হুদা-ই প্রযুক্তির সহযোগিতা নিয়ে সুভাষের সাথে তার পরিবারের সংযোগ করিয়ে দেন। 

কিন্তু নেপাল সীমান্ত ঘেঁষা ভারতের উত্তরপ্রদেশের রামনগরের বাসিন্দা সুভাষ কিভাবে প্রায় দুই হাজার কিলোমিটার দূরে বাংলাদেশের রংপুরের বদরগঞ্জের ওই আশ্রয় কেন্দ্রে পৌঁছেছে তা এখনও অজানা। 


বিডি প্রতিদিন/হিমেল

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর