৯ মে, ২০২৩ ১৪:২৯

পিতৃহারা হলেন রামুও

দীপক দেবনাথ, কলকাতা

পিতৃহারা হলেন রামুও

বাবাতুল্য সমরেশ মজুমদারের মরদেহের পাশে রামু। ছবি: দীপক দেবনাথ

“বাবু”- এই নামেই তার মনিব সমরেশ মজুমদারকে ডাকতেন রামু। রামুর ভালো নাম রাম চন্দ্র দাস। বাড়ি বিহারে। দীর্ঘ ২০ বছরের বেশি সময় ধরে সমরেশ মজুমদারের পরিবারের সাথে পরিচিত ছিলেন রামু।

জীবনের শেষ তিন বছর প্রখ্যাত সাহিত্যিক সমরেশ মজুমদারের সুখ-দুঃখের সাথী ছিলেন তিনি। তাকে বাবার স্নেহেই দেখতেন রামু। সমরেশও রামুকে কম ভালোবাসতেন না, ছেলের চেয়েও বেশি ভালবাসতেন তাকে। তার ওষুধ খাওয়া থেকে শুরু করে নিয়মিত যত্নআত্তি করা সবটাই সামলাতেন রামু। বিশ্বস্ত, বাধ্য, বিনয়ী বলতে যা বোঝায় রামু ঠিক তাই।

গত ২৫ এপ্রিল সকালে ঘুম থেকে উঠেই অসুস্থ বোধ করেন ‘কালপুরুষ’-এর লেখক সমরেশ মজুমদার। সঙ্গে সঙ্গে তিনি ডেকে পাঠান তার দীর্ঘদিনের বিশ্বস্ত সঙ্গী রামুকে। এরপর শৌচাগারেও যান তিনি। যদিও সে সময় তার চলাফেরায় বেশ অস্বাভাবিক লাগছিল। এরপর হঠাৎ করে অসুস্থ বোধ করেন তিনি। সঙ্গে সঙ্গেই তাকে বিছানায় নেওয়া হয়। খবর দেওয়া হয় তার দুই মেয়ে দোয়েল ও পরমাকে। এরপরই অ্যাম্বুলেন্স ডেকে কলকাতার অ্যাপোলো হাসপাতালে ভর্তি করা হয় সমরেশকে। এরপর হাসপাতালের আইসিইউ, তারপর ভেন্টিলেশনে রাখা হয়েছিল। চিকিৎসকরাও সাধ্য মত চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তাকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি। 

সমরেশের মৃত্যুতে বাংলা সাহিত্য জগতে যেমন শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে, তেমনি ‘বাবু’র মৃত্যুতে আজ বড় একা হয়ে গেলেন রামুও। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকাবস্থায় সমরেশের দুই মেয়ে-জামাইয়ের পাশাপাশি প্রতিদিন নিয়ম করে রামুও সেখানে যেতেন, তিন-চার ঘণ্টা বাইরে অপেক্ষা করতেন চিকিৎসকের রিপোর্টের জন্য। উপরওয়ালার কাছে প্রার্থনা করতেন তার ‘বাবু’ যেন সুস্থ হয়ে ওঠেন। 

কিন্তু সোমবার ‘বাবু’র মৃত্যুর পর বেশ মনমরা হয়ে পড়েছেন রামু। শরীরের বাহ্যিক রূপ দেখে বোঝাই যাচ্ছে নিজের মনের ভিতর কি ঝড় বয়ে যাচ্ছে। যদিও নিজেকে শক্ত করে হাসপাতাল-বাড়ি করে বেড়িয়েছেন রামু। এরপর মঙ্গলবার সকালের দিকে হাসপাতাল থেকে কলকাতার শ্যামপুকুর স্ট্রিটের বাড়িতে আসার পর বাবুর নিথর দেহের চারপাশে সুগন্ধি ছড়ানো থেকে অতিথি, প্রতিবেশীদের সঙ্গ দেওয়া, ফরমায়েশ খাটা- সবকিছুই সামলেছেন তিনি। 

স্থানীয় সময় সকাল ৯টা থেকে বেলা ১১টা ২০ মিনিট পর্যন্ত ওই বাড়িতেই ছিল সমরেশ মজুমদারের মরদেহ। সেখানে তাকে শেষ শ্রদ্ধা জানান পরিবারের সদস্য, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু, সাহিত্যিক ও গুণমুগ্ধ অসংখ্য মানুষ। এরপর বেলা সাড়ে ১১টার দিকে তার নিথর দেহ নিয়ে নিমতলা মহাশ্মশানের দিকে রওনা দেয় প্রয়াত সাহিত্যিকের শববাহী গাড়ি। সেখানেই শেষকৃত্য সম্পন্ন হয় তার। পরিবারের সদস্যদের সাথে সেই গাড়ির সাথী ছিলেন রামুও। 

অশ্রুজ্জ্বল চোখে রামু জানান, “একটি বেসরকারি সংস্থায় কাজ করতাম। সেই কারখানাটি হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায়। এরপরই দোয়েল দিদির সাথে পরিচয়। দিদি আমাকে ডেকে নিয়ে তার সংস্থায় চাকরি দেন। আর সেই থেকেই বাবুর পরিবারের সাথে আমি জড়িয়ে পড়ি।”

তিনি আরও জানান, “...কিন্তু গত তিন বছর ধরে আমি বাবুর সাথে রয়েছি। বাবুই আমাকে তার কাছে নিয়ে আসেন।”

যেদিন সকালে সমরেশ মজুমদার অসুস্থ হন, সেই দিনটির কথা বলতে গিয়ে রামু বলেন, “সেদিন সকালে ঘুম থেকে ওঠার পরই বাবুকে ওলটপালট লাগছিল। আমি যেখানে নিয়ে যেতে চাইছিলাম সেখানে না গিয়ে অন্য জায়গায় চলে যাচ্ছিলেন। এরপর আমি ওয়াশরুমে নিয়ে যাই। সেখানে প্রয়োজন শেষে চেয়ারের উপর বসাই, হাত-পা টিপে দিই, এরপরে সাময়িক স্বস্তি পান তিনি। এরপর দিদিদের সাথে ভিডিও কলে কথা বলেন। এরপরই অ্যাম্বুলেন্স ডেখে বাবুকে হাসপাতালে নেওয়া হয়।”

বাবুর সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে রামু বলেন, “আমার বাবা (সমরেশ মজুমদার) চলে গেলেন। আমাকে নিজের ছেলের চেয়েও বেশি ভালোবাসতেন। তার লেখার সময়ও তাকে এটা-ওটা, বিভিন্ন বই তার হাতের কাছে নিয়ে দিতাম।”

কিন্তু সেই মানুষটি চলে যাওয়ায় আজ বড়ই মন খারাপ রামুর। আসলে শেষ তিন বছর তাদের সম্পর্ক এতটাই গাঢ় হয় যে রামু ছাড়া যেমন বাবু চলতে পারতেন না, তেমনি বাবু ছাড়া রামু যেন অচল, নিজের মুখে সেকথাও জানালেন রামু।

বিডি প্রতিদিন/কালাম

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর