১৩ জুলাই, ২০২৩ ০১:৩২
পশ্চিমবঙ্গের অধিকাংশ গ্রাম পঞ্চায়েত তৃণমূলের দখলে

মমতার শান্তির বাণীর পরও সহিংসতা অব্যাহত

দীপক দেবনাথ, কলকাতা

মমতার শান্তির বাণীর পরও সহিংসতা অব্যাহত

মমতা ব্যানার্জি। ফাইল ছবি

মঙ্গলবার পঞ্চায়েত ভোটের ফল প্রকাশের দিনই শান্তির কবিতা লিখলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। 

বুধবার তৃণমূলের মুখপত্র 'জাগো বাংলা'য় সেই কবিতা প্রকাশ হয়েছে বলে নিজেই জানান মুখ্যমন্ত্রী। 

এদিন বিকালে রাজ্যের সচিবালয় নবান্ন থেকে সংবাদ সম্মেলন করে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, "জাগো বাংলায় আমার একটা কবিতা বেরিয়েছে 'শান্তি'। 

কবিতাবিতানে আমার যত কবিতা দেখবেন তার অধিকাংশই আমি শান্তি, সম্প্রীতি, সংহতি, সংস্কৃতি, সভ্যতা নিয়ে কলম ধরেছি। কারণ এটাই আমার প্রিয়। উদ্ধার্য জীবনের উপহার নয়। নমনীয়তাই জীবনের অলংকার।' 

কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর এই শান্তির বাণীর পরেও সহিংসতা থামছে না। গত ৮ জুন রাজ্যে পঞ্চায়েত নির্বাচনের দিন ঘোষণা হয়। কার্যত সেই দিন থেকেই শুরু হয়ে যায় সহিংসতা। বুধবার পর্যন্ত ওই সহিংসতায় অন্তত অর্ধশতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে বলে বিভিন্ন গণমাধ্যম সূত্রে খবর। 

যদিও সরকারের পক্ষ থেকে এই মৃত্যুর কথা স্বীকার করা হয়নি। মঙ্গলবার পঞ্চায়েত ভোটের গণনায় ক্ষমতাসীন দল তৃণমূল কংগ্রেসের বিপুল জয়ের পরেও বিরোধীদের উপর হামলা অভিযোগ উঠেছে, সেই তৃণমূলের বিরুদ্ধে। 

তার উদাহরণ বুধবারই দক্ষিণ ২৪ পরগনার ভাঙড়ে তিন জনের মৃত্যু। এদের মধ্যে দুইজন 'ইন্ডিয়ান সেকুলার ফ্রন্ট' (আইএসএফ) কর্মী বলে জানা গেছে- এরা হলেন রেজাউল গাজী, হাসান মোল্লা। বাকিজন রাজু মোল্লা। 

মঙ্গলবার গভীর রাতে আইএসএফ কর্মীদের সাথে সংঘর্ষ বাধে পুলিশের। তাতেই পুলিশের কর্মীরা ছাড়াও জখম হন এই টিউন জন। 

বুধবার তাদের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করে পুলিশ। এই জেলার কুলপিতে মুড়ি মুড়কির মত বোমা নিক্ষেপ করা হয়। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে সেই সব ছবি সামনেও এসেছে। 

মুর্শিদাবাদের সাগরদিঘীতে রাজেশ শেখ নামে এক কংগ্রেস কর্মীর মৃত্যু হয়। শনিবার নির্বাচনের দিন ছাপ্পা ভোটকে কেন্দ্র করে কংগ্রেস ও তৃণমূলের সংঘর্ষ হয়। তাতে গুরুতরক আহত হন রাজেশ এরপর বুধবার কলকাতার হাসপাতালে চিকিৎসারত অবস্থায় মারা যায় তিনি। 

মালদহে চাচোলের খেমপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের পরানপুর এলাকায় মঙ্গলবার রাতে তৃণমূলের বিজয় মিছিলে হামলার ঘটনায় মারা জয় এক তৃণমূল কর্মী। তার নাম মফিজ উদ্দিন শেখ। এদিন সকালে চাচোল হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়। 

এই জেলারই রতুয়া থানার ভাদো গ্রাম পঞ্চায়েতের রামপুর এলাকায় এক কংগ্রেস কর্মীকে পিটিয়ে খুনের অভিযোগ উঠল তৃণমূল প্রার্থী ও তার সঙ্গীদের বিরুদ্ধে। মৃত কংগ্রেস কর্মীর নাম ফটিকুল হক (২৪)। মঙ্গলবার রাতে বিজয় মিছিলে হামলা চালানো হলে ফটিকুলসহ অনেকেই গুরুতর আহত হন। 

পরে এদিন সকালে মালদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মৃত্যু হয় ফটিকুলের। অভিযোগের তীর ভাদো গ্রাম পঞ্চায়েতের তৃণমূল প্রার্থী রোজিনা বিবি, তার স্বামী তোফাজুল হক সহ তার দল বলের বিরুদ্ধে। 
এছাড়াও কোথাও তাজা বোমার উদ্ধার করা হয়েছে, কোথাও বোমাবজি, বিজয় মিছিলের উপর হামলা, কোথাও জেতার পরও বিজেপি প্রার্থীদের জয়ের সনদ দেওয়া হচ্ছে না বলে অভিযোগ উঠেছে। 

শুধু তাইই নয়, কোচবিহার জেলার তুফানগঞ্জ বিধানসভার অন্তর্গত বলরামপুর-২, চিলাখানা-২ গ্রাম পঞ্চায়েতের বিজেপির জয়ী প্রার্থীরা প্রাণভয়ে প্রতিবেশী আসামে আশ্রয় নিয়েছেন বলে খবর। মঙ্গলবার রাতে গ্রাম পঞ্চায়েতে জয়ী বিজেপির ৯ প্রার্থীকে তৃণমূলের তরফে হুমকি দেওয়া হয় বলে অভিযোগ। এরপরে তারা নিজেদের প্রাণ সংশয়ের বিয়ে বুধবার ভোরে সীমান্ত পেরিয়ে তারা অসমের ধুবরিতে বিজেপির কার্যালয়ে আশ্রয় নেয়। 
 
স্বাভাবিকভাবে রাজ্যজুড়ে এই সহিংসতা ও মৃত্যুর ঘটনায় সরব হয়েছে বিরোধীদল গুলি। 

সিপিএম নেতা সুজন চক্রবর্তী কটাক্ষ করে বলেন 'এত শান্তিপূর্ণ ভোট কেউ কখনো দেখেনি, এত কারচুপি, লুঠের ভোটও গোটা ভারতে কেউ দেখেনি।

মমতা যে নিজেই অপরাধী সেটা ধরা পড়ে গেছে, গোটা রাজ্যের মানুষ বুঝে গেছে। পঞ্চায়েত নির্বাচনের যা ফলাফল এসছে তার কোন বৈধতা নেই (legitimacy). 

তার অভিমত 'রাজ্যজুড়ে যে সহিংসতার বলি হচ্ছে এটা এড়াতে এক্ষুনি মমতা ব্যানার্জির সরকারকে উৎখাত করতে হবে। কারণ এখানে গুন্ডা, দুর্বৃত্তদের রাজত্ব চলছে। 

তিনি বলেন 'দুর্বৃত্তদের দল হল তৃণমূল কংগ্রেস। আর তার নেত্রী বানানো হয়েছে মমতা ব্যানার্জিকে। তার নেতৃত্বে রাজ্যে যে হিংসার রাজনীতি চলছে এটা বাংলার ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সর্বনাশের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। যারা মারা গেছেন তারা যে দল, জাতি বর্ণেররই হোক না কেন এই মানুষের মৃত্যুর দায় মমতার। মমতার কান ধরে উঠবস করা উচিত।' 

এক ধাপ এগিয়ে বিরোধীদল বিজেপি আবার তাদের তথ্যানুসন্ধান দল (ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং টিম) পাঠিয়েছে রাজ্যে। সাবেক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী রবি শংকর প্রসাদের নেতৃত্বে ৪ সদস্যের এই দলে রয়েছেন রেখা বর্মা, রাজদীপ রায়, সত্যপাল সিং। রাজ্যের বিভিন্ন স্পর্শকাতর ও হিংসা কবলিত এলাকাগুলিতে তারাবপরিদর্শন করবেন, নিগৃহীত মানুষদের সাথে কথা বলবেন। হিংসা পরিস্থিতি খতিয়ে দেখে রিপোর্ট তৈরি করে তা কেন্দ্রকে পাঠাবে এই দল। এ ব্যাপারে রবিশঙ্কর প্রসাদের প্রশ্ন 'বিহার, উত্তরপ্রদেশেও এত সহিংসতা হয় না। কিন্তু বাংলায় এত হিংসা কেন? কেন এত খুনোখুনির ঘটনা ঘটে? 

গত কয়েক দিনের সহিংসতার ঘটনায় ঘরে বাইরে চাপে পড়ে বিষয়টি নিয়ে মুখ খুলেছেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। 

এদিন সংবাদ সম্মেলন করে তিনি বলেন 'আমি দুঃখিত যে কিছু বিক্ষিপ্ত ঘটনায় কয়েকজন নিহত হয়েছে। যে জায়গাগুলোতে এই ঘটনা ঘটেছে সেগুলি আজ থেকে নয় গত ২৫-৩০ বছর ধরে ওই জায়গা গুলিতে গন্ডগোল হয়। 

মুর্শিদাবাদের ডোমকলে গন্ডগোল হয়েছে আমাদের কর্মীরা মারা গিয়েছেন। ভাঙ্গড়ে গন্ডগোল হয়েছে সেখানে বিরোধীরা করেছে। আমরা তো ওখানে জিতিনি আমাদের আসনটা ওরা (আইএসএফ) ছিনিয়ে নিয়েছে। রাজ্যের প্রায় ৭১ হাজার বুথে ভোট হয়েছে। কিন্তু বড়জোর সাতটি বুথে এই ঘটনা ঘটেছে। এগুলিকে ঘটানো হয়েছে।'
 
গোটা সহিংসতার ঘটনায় বিরোধীদের দিকে অভিযোগের আঙুল তুলে মমতা বলেন 'আমি দুঃখিত যে রাম-বাম-শ্যাম (বিজেপি-কংগ্রেস-সিপিআইএম) এরা তিনজন প্লাস আরও একজন (আইএসএফ) জোট বেঁধে মহাঘোট বেঁধে ছিল। এদের পরিকল্পনাই ছিল গন্ডগোল তৈরি করার। 

যদিও সহিংসতার মৃত্যুর ঘটনায় শোক প্রকাশ করে তিনি বলেন 'যারা মারা গিয়েছেন তাদের পরিবারকে আমি সমবেদনা জানাই। তারা পরিস্থিতির শিকার হয়েছেন। কিন্তু আমি পুলিশক ফ্রি হ্যান্ড দিচ্ছি। যারা এসবের সাথে যুক্ত তাদের বিরুদ্ধে যেন কঠোর ব্যবস্থা নেয়।' 

তিনি এও জানান 'পঞ্চায়েত ভোটে তৃণমূল জয় পেলেও আগামী একুশে জুলাই কোন সেলিব্রেশন হবে না। ওই দিনটিকে আমরা শ্রদ্ধা দিবস হিসেবে পালন করব।' এমনকি নিহতদের পরিবারের একজনকে হোম গার্ডের চাকরি ও আর্থিক ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে বলে আশ্বাস দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। 

মমতা আরো জানান 'পঞ্চায়েত ভোট শেষ হয়ে গিয়েছে। আমার যদি সত্যিই কোন অপরাধ থাকে যে শাস্তি মানুষ আমাকে দেবে মাথা পেতে নেব। দাম্ভিকতা কোন রাজনৈতিক দলের উদ্ধত হতে পারে না। মানুষের আশীর্বাদ শুভেচ্ছা দোয়া পেলে আরো নম্র হতে হয়।' 

এদিকে মঙ্গলবারের পর বুধবারও রাজ্যের একাধিক জেলায় পঞ্চায়েত এবং পঞ্চায়েত সমিতির আসনে ভোট গণনা চলছে। তবে গণনার যা পরিস্থিতি তাতে তৃণমূলের জয় নিশ্চিত। সেক্ষেত্রে আরো একবার গ্রাম বাংলার দখল তৃণমূলের হাতেই থাকছে। 

শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত গোটা রাজ্যে ৩৩১৭ টি গ্রাম পঞ্চায়েতের মধ্যে ২৬৪৪ টিতে জয় পেয়েছে তৃণমূল, বিজেপি ২২০, বামফ্রন্ট ৩৮, কংগ্রেস ৪ এবং অন্যরা ৪১১ গ্রাম পঞ্চায়েত দখল করেছে। 

৩৪১টি পঞ্চায়েত সমিতির মধ্যে তৃণমূল ৩১৭, বিজেপি ৬, বামফ্রন্ট ২ এবং অন্যরা ১৬ টিতে জয়লাভ করেছে। আর ২০ জেলা পরিষদের সবকয়টিতে জয় পেয়েছে শাসক দল তৃণমূল।

বিডি প্রতিদিন/জুনাইদ আহমেদ

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর