২২ জুলাই, ২০২৩ ১৭:০৭

এবার পশ্চিমবঙ্গে দুই নারীকে বিবস্ত্র করে মারধর, তোলপাড় রাজ্য রাজনীতি

দীপক দেবনাথ, কলকাতা প্রতিনিধি

এবার পশ্চিমবঙ্গে দুই নারীকে বিবস্ত্র করে মারধর, তোলপাড় রাজ্য রাজনীতি

ছবি : ভিডিও থেকে নেওয়া

উত্তর-পূর্ব ভারতের মণিপুরে দুই নারীকে বিবস্ত্র করে প্যারেড করানোর ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে নজরে এসেছে গোটা ভারতবাসীর। এ ঘটনা সামনে আসতেই সরকার পক্ষকে নিশানা করেছেন বিরোধী দলগুলো। তবে সবচেয়ে বেশি সরব হতে দেখা গেছে তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী তথা পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জিকে। মণিপুরের ঘটনা নিয়ে তাকে বলতে শোনা গিয়েছিল, ‘এ কোন দেশ? আমার হৃদয় কাঁদছে, আমার হৃদয় জ্বলছে। প্রধানমন্ত্রী নারীদের সম্মান দিতে জানেন না। তারা খুনের সওদাগর।’

এই ঘটনার আঁচ পড়ে ভারতের সংসদেও। দোষীদের শাস্তির দাবিতে রাজনৈতিক দল থেকে শুরু করে নাগরিক সংগঠন, বিদ্বজনেরা পথে নেমেছেন। নারীদের ওপর এমন নেক্কারজনক ঘটনায় কার্যত ফুঁসছে গোটা ভারত।

তীব্র নিন্দা জানিয়ে দোষীদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপের নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ইতোমধ্যে ওই ঘটনায় আটক হয়েছে চার অভিযুক্ত। 

মণিপুরের ঘটনা নিয়ে গোটা ভারত যখন উত্তাল ঠিক তখনই নারীদের ওপর অত্যাচারের আরও একটি ঘটনা সামনে এলো। তবে এবারের ঘটনাস্থল মমতা ব্যানার্জির পশ্চিমবঙ্গে।

রাজ্যটির মালদহের বামনগোলা থানার পাকুয়াহাটে চুরির অভিযোগে দুই আদিবাসী নারীকে বিবস্ত্র করে মারধর উত্তেজিত জনতার। ঘটনাটি ঘটে মঙ্গলবার দিনের আলোয়, সেই ভিডিও সামনে আসে শনিবার সকালে। সিভিক পুলিশের সামনেই ওই দুই নারীর ওপর বর্বরোচিত আক্রমণের ভিডিও সোস্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হতেই শোরগোল পড়ে গেছে রাজ্য রাজনীতিতে।

জানা গেছে, গত মঙ্গলবার পাকুয়ায় গ্রাম্য হাট বসে। সেই হাটেই লেবু বিক্রি করতে গিয়েছিলেন ওই দুই নারী। সেখানেই তাদের চুরির অপবাদ দিয়ে মারধর করা হয় বলে অভিযোগ। ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে দেখা যায়, পায়ের জুতো খুলে, চুলের মুঠি ধরে গ্রামের নারীরা ওই দুই নারীকে মারধর করছেন। কেউ আবার পেছন দিক থেকে হ্যাঁচকা টান মারছেন। অবিরাম চলছে কিল চড় ঘুষি। এরই মধ্যে কিছু উন্মত্ত জনতাকে ওই দুই নারীর পোশাক ধরে টেনে ছিঁড়ে ফেলতে দেখা যায়। মারধরের কারণে একসময় নিস্তেজ হয়ে যান তারা। প্রাণ বাঁচাতে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলেন তারা। কিন্তু তারপরেও জনতার রোষ থামেনি। পাশে থাকা মমতা ব্যানার্জির সিভিক পুলিশ থাকেলও তারাও ছিল কার্যত নিরূপায়। পরে মানিকচক থানার পুলিশ গিয়ে তাদের উদ্ধার করে। শনিবার এই ঘটনার ভিডিও ফুটেজ ভাইরাল হতেই নড়েচড়ে বসে রাজ্য পুলিশ প্রশাসন। 

নারীদের ওপর এই নির্যাতনের ঘটনায় প্রাথমিকভাবে দোষীদের বদলে উল্টো ওই দুই নারীকেই গ্রেফতার করা হয় বলে অভিযোগ। 

এ ব্যাপারে নির্যাতিতা এক নারীর মেয়ে বলেন,‘আমার মা ও এক চাচি হাটে লেবু বিক্রি করতে গিয়েছিলেন। সেখানেই এক মিষ্টি বিক্রেতা আমার মা ও চাচির বিরুদ্ধে চুরির অভিযোগ তোলে। এরপরই আমার মা এবং চাচিকে মারধর করা হয়। কাপড় জামা খুলে তাদের মারধর হয়।’ 

তার দাবি, ‘বিনা অন্যায়ে আমার মাকে মারধর করা হয়েছে।’ তার অভিযোগ, ‘যারা মারধর করেছে তাদের এখনো গ্রেফতার করা হয়নি। অথচ আমার মা ও এক চাচিকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।’ 

এ ঘটনায় ফুঁসছে গ্রামবাসী। শেখ পারভেজ নামে এক গ্রামবাসী বলেন, ‘পুলিশ গ্রামের বাসিন্দাদের কথা শুনেনি, বরং যারা নির্যাতিত হয়েছে মানিকচক থানার পুলিশ তাদেরই আটক করেছে। পুলিশ ওদের প্রতি অন্যায় করেছে। শুনেছি ওদের বিবস্ত্র করে মারধর করা হয়েছে। এটা অন্যায় করা হয়েছে। আমরা চাই ওদের দ্রুত মুক্তি দেওয়া হোক এবং যারা মারধর করেছে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করা হোক।’

থেমে নেই কেন্দ্রের ক্ষমতাসীন দল বিজেপিও। মণিপুরের ঘটনা নিয়ে মোদি সরকারের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি সরব ছিলেন যিনি, সেই মমতাকেই এবার নিশানা করেছে বিজেপি। 

কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অনুরাঠ ঠাকুর মালদার এই ঘটনা নিয়ে শনিবার দিল্লিতে রীতিমত সংবাদ সম্মেলন করে বলেন, ‘রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ দিয়ে নারী নির্যাতনের ঘটনা দেখা হচ্ছে। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরা নিজেদের দায়িত্ব থেকে পালাতে পারেন না।’ 

তার প্রশ্ন ‘নির্মমতার প্রতীক মমতা। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর হৃদয়ে কি মমতা আছে? হাওড়ার পাঁচলায় নারীকে নির্যাতন করা হয়েছে, মালদহে দুই নারীকে মারধর করে অর্ধনগ্ন করা হয়েছে। মমতা ব্যানার্জি এখন কোথায়? কোথায় তদন্ত?’ 

নিশানা করতে ছাড়েননি ‘ইন্ডিয়া’র জোট শরিকদেরও। তার প্রশ্ন বাংলায় সহিংসতা নিয়ে কেন বিরোধী জোটের নেতা-নেত্রীরা মুখ খুলছেন না? এই জোটের নেতা-নেত্রীরা বধির হয়ে গেলেন কেন? প্রিয়াংকা গান্ধীর মুখে কি এখন সেলাই পড়েছে? কোথায় গেলেন মোমবাতি নিয়ে মিছিল করা লোকগুলো?’

মালদার ঘটনায় অভিযুক্তদের শাস্তির দাবিতে জেলা পুলিশ সুপারের অফিসের সামনে ধর্ণায় বসেন মালদা উত্তরের বিজেপি সাংসদ খগেন মুর্মু।

বিজেপির পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার বলেছেন, ‘মণিপুর নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে মমতা ব্যানার্জির উচিত বাংলা নিয়ে মাথা ঘামানো। মালদায় দুইজন আদিবাসী নারীর সঙ্গে যে ধরনের আচরণ করা হচ্ছে, তা মানবতাকে ছিন্নভিন্ন করে দেওয়ার মতো ঘটনা। মুখ্যমন্ত্রীর উচিত তদন্ত করে অপরাধীদের গ্রেফতার করা।’ 

সুকান্তর কটাক্ষ, ‘মুখ্যমন্ত্রীর লজ্জা শরম বলে কিছু আছে? তিনি মণিপুরে যাচ্ছেন। মণিপুর এত দূরে দেখতে পাচ্ছে, কিন্তু মালদা এত কাছে সেটা দেখতে পাচ্ছে না?’

এই ঘটনায় নিন্দা জানানো হয়েছে কংগ্রেসের তরফেও। দলের সাংসদ তথা সাবেক কেন্দ্রীয় রেল প্রতিমন্ত্রী অধীর চৌধুরী বলেন, ‘এটাই বাংলা। এই বাংলায় নারী নির্যাতন সারা ভারতবর্ষে প্রথম পাঁচটা রাজ্যের মধ্যে স্থান দখল করতে পেরেছে। এই বাংলায় নারী নির্যাতন সংখ্যায় আজকে ভারতে এক থেকে পাঁচের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে।’

দোষীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, ‘অপরাধী যেই হোক- সিভিক পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা বা কোনো রাজনৈতিক দলের লোক হোক-  তাদের বিরুদ্ধে উদাহরণমূলক শাস্তি দেওয়ার ব্যবস্থা করা দরকার।’

এরপরই নড়েচড়ে বসে পুলিশ। দুই নারীকে পেটানোর ঘটনায় আটক করা হয় পাঁচজনকে। গোটা ঘটনা নিয়ে রাজ্যের পৌরসভা ও নগর উন্নয়ন মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম বলেন, ‘এই ঘটনাটা আমি জানি না। কিন্তু কেউ যদি করে থাকে তবে তা অন্যায়।’

বিডি প্রতিদিন/জুনাইদ আহমেদ

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর