২৭ জানুয়ারি, ২০২৪ ২১:৫৪

পথচলা শুরুর আগেই হোঁচট ‘ইন্ডিয়া জোটের’!

দীপক দেবনাথ, কলকাতা

পথচলা শুরুর আগেই হোঁচট ‘ইন্ডিয়া জোটের’!

লালু প্রসাদ যাদব (বামে), নীতিশ কুমার (মাঝে) ও সুশীল মোদি (ডানে)

২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপিকে উৎখাত করতে ভারতের বিরোধী দলগুলোকে একত্রিত করার প্রথম উদ্যোগ নিয়েছিলেন ‘জনতা দল ইউনাইটেড’ (জেডিইউ) নীতিশ কুমার। 

আর সেই লক্ষ্যেই ৭ মাস আগে গত জুলাই মাসে তৈরি হয় ‘ইন্ডিয়া’ নামক বিজেপিবিরোধী জোট। নীতিশের উদ্যোগেই গত বছরের ২৩ জুন এই জোটের প্রথম বৈঠক বসে পাটনায়। 

কিন্তু নির্বাচনের দিন ঘনিয়ে আসতেই ফের একবার দলবদলের পথে হাঁটতে চলেছেন বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতিশ কুমার। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে রবিবার বিজেপি নেতৃত্বাধীন ‘জাতীয় গণতান্ত্রিক জোটে’ (এনডিএ) ফিরতে চলেছে বিরোধীদলের জোট ‘ইন্ডিয়া’র অন্যতম শরিক দল জেডিইউ। বিজেপির সমর্থনে রবিবারই বিহারের মুখ্যমন্ত্রী পদে শপথ নিতে পারেন নীতিশ কুমার। সেক্ষেত্রে নজিরবিহীনভাবে নয়বারের জন্য মুখ্যমন্ত্রীর পদে বসবেন তিনি। উপমুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিতে পারেন বিজেপির সুশীল মোদি।

শোনা গিয়েছিল এদিন সন্ধ্যা বেলাতেই মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দিতে পারেন নীতিশ। কিন্তু সন্ধ্যা গড়িয়ে গেলেও সেই পথে হাঁটলেন না তিনি। আর এ নিয়েই শনিবার দিনভর জল্পনা, উত্তেজনা, টানাপোড়েন- সবকিছুই অব্যাহত রইল বিহারের রাজ্য রাজনীতিতে। এও শোনা যাচ্ছে দলের বিধায়ক, সাংসদ ও শীর্ষ নেতাদের সাথে বৈঠক সেরে রবিবার হয়তো ইস্তফা দিতে পারেন নীতিশ। সকাল ১০টায় এই বৈঠক ডাকা হয়েছে। বৈঠকের পরেই রাজভবনে গিয়ে রাজ্যপালের হাতে ইস্তফা পত্র তুলে দিতে পারেন নীতিশ কুমার। পরে বিকাল ৪টায় শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান হতে পারে।

বিহার বিধানসভায় মোট আসন ২৪৩ টি (ম্যাজিক ফিগার ১২২)। এর মধ্যে একক বৃহত্তম দল আরজেডি। তাদের বিধায়ক সংখ্যা ৭৯; দ্বিতীয় বৃহত্তম দল বিজেপি, যার বিধায়ক সংখ্যা ৭৮; এছাড়াও জেডিইউ-৪৫; কংগ্রেস-১৯, বামফ্রন্ট-১৬; হিন্দুস্তান আওয়াম মোর্চা-৪; অল ইন্ডিয়া মজলিস-ই-ইত্তেহাদুল মুসলিমীন-১; স্বতন্ত্র-১ জন বিধায়ক আছে।

জেডিইউ ছাড়া বিহারে মহাজোটের সরকারে অন্য শরিক দল গুলি হল আরজেডি, কংগ্রেস ও তিনটি বাম দল। তাদের সম্মিলিত বিধায়ক সংখ্যা ১৫৯। শেষ পর্যন্ত জেডিইউ এই সরকার থেকে বেরিয়ে গেলে এই মহাজোটের বিধায়ক সংখ্যা দাঁড়াবে ১১৪। স্বাভাবিকভাবেই সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকার কারণে এই সরকারের পতন ঘটবে।

রবিবার বিজেপির সমর্থনে নীতিশ কুমার সরকার গঠন করলেও আগামী ৫ ফেব্রুয়ারি রাজ্য বিধানসভায় আস্থা ভোটে নিজেদের শক্তির প্রমাণ দিতে হবে জেডিইউ-বিজেপি জোট সরকারকে। যদিও আপাতদৃষ্টিতে এই সরকার পড়ে যাওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই, কারণ জেডিইউ এবং বিজেপির সম্মিলিত আসন সংখ্যা ১২৩ (ম্যাজিক ফিগার থেকে ১ টি আসন বেশি)। পাশাপাশি কংগ্রেসেরও বেশ কয়েকজন বিধায়ক বিজেপির দিকে পা বাড়িয়ে রয়েছে বলে জানা গেছে।

বিহারের এই রাজনৈতিক সঙ্কটের আঁচ গিয়ে পড়েছে ভারতের রাজধানী দিল্লিতেও। নীতিশ কুমার যদি সত্যিই বিজেপির হাত ধরেন, সেক্ষেত্রে বড় ধাক্কা আসতে চলেছে বিজেপি বিরোধী জোট 'ইন্ডিয়া'এ।

বর্তমানে বিহারে লালু প্রসাদ যাদবের 'রাষ্ট্রীয় জনতা দল' (আরজেডি) এর সাথে মহাজোট সরকারে আছে নীতিশের দল জেডিইউ। কিন্তু সেই আরজেডি'এর সাথে সম্পর্ক কার্যত তলানিতে ঠেকেছে নীতিশের। 

সম্প্রতি বিহারের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী প্রয়াত কর্পূরী ঠাকুরকে মরণোত্তর ভারতরত্ন সম্মাননা প্রদান করে মোদি সরকার। বুধবার তারই জন্মশতবার্ষিকী অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে নাম না করে লালু প্রসাদ যাদবের পরিবারের উদ্দেশ্যে পরিবারতন্ত্রের অভিযোগ তোলেন বিহারের মুখ্যমন্ত্রী। এর পরেই নীতিশ কুমারকে কড়া ভাষায় তোপ দাগেন লালু প্রসাদের কন্যা রোহিনী আচার্য।

জেডিইউ সাংসদ সুনীল কুমার পিন্টু অভিযোগ করেছেন 'মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে নীতিশ কুমারকে কাজ করার স্বাধীনতাই দেওয়া হয়নি। তাই তিনি বিজেপিতে আসছেন। তিনি আরো বলেন বিহারের উন্নয়নে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং মুখ্যমন্ত্রী নীতিশের বন্ধন খুব প্রয়োজন। আর এবার এই জোটটা চিরস্থায়ী হবে।' 

এর পাশাপাশি বিহার সহ অন্য রাজ্যগুলিতে আসন ভাগাভাগি নিয়ে কংগ্রেসের সাথে অন্য আঞ্চলিক দলগুলির সমঝোতা বিলম্বিত হওয়ার কারণে কংগ্রেসের উপর ক্ষুব্ধ নীতিশ। নিতীশের ধারনা লোকসভা নির্বাচনের আগে কেবল মাত্র শতাব্দী প্রাচীন এই দলের স্বার্থেই একক ভাবে রাহুলের নেতৃত্বাধীন কংগ্রেসের 'ভারত জোড়ো ন্যায় যাত্রা'র সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, এতে 'ইন্ডিয়া' জোটের কোন স্বার্থসিদ্ধ হবে না। স্বাভাবিকভাবেই বিহারে এই ন্যায় যাত্রায় শামিল হচ্ছে না নীতিশের দল জেডিইউ। 

এছাড়াও গত ডিসেম্বরে 'ইন্ডিয়া' জোটের বৈঠকে প্রকাশ্যে কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গেকে জোটের মুখ হিসেবে তুলে ধরার প্রস্তাবনা দেন মমতা ব্যানার্জি এবং অরবিন্দ কেজরিওয়াল। ওই ঘটনায় যথেষ্ট ক্ষুব্ধ হন নীতিশ। এমনকি সে সময় বৈঠক ছেড়ে বেরিয়ে আসেন বলে অভিযোগ। 

এরই মধ্যে কংগ্রেসের সাথে আসন ভাগাভাগি নিয়ে মতানৈক্য সামনে আসায় গত বুধবারই বিরোধী দলের জোট 'ইন্ডিয়া'র অন্যতম শরিক দল কংগ্রেসের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে তৃণমূল কংগ্রেস। তৃণমূল নেত্রী ও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি পরিষ্কার জানিয়ে দেন আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে বাংলায় কংগ্রেসের সাথে কোন সম্পর্ক নেই। নির্বাচনে তারা একাই লড়বে। মমতার ওই ঘোষণার পরেই দ্বিতীয় ধাক্কা আসে আপ'এর তরফে। পাঞ্জাবের ক্ষমতাসীন দল ও রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ভাগবত মান জানিয়ে দেন 'পাঞ্জাবে আমরা কংগ্রেসের সাথে কোন জোট করছি না।' রাজ্যের ১৩ টি লোকসভার আসনেই আপ একক ভাবে জয় পাবে বলেও আশা প্রকাশ করেন তিনি।

এদিকে নিতিশ কুমারের দলবদলের সম্ভাবনা নিয়ে মুখ খুলেছেন উত্তরপ্রদেশের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ও সমাজবাদী পার্টির (সপা) সভাপতি অখিলেশ যাদব। গত শুক্রবার একটি সর্বভারতীয় সংবাদ মাধ্যমে (ইন্ডিয়া টুডে) সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে অখিলেশ বলেছিলেন 'নীতিশ কুমার যদি ইন্ডিয়া জোটে থাকতেন তবে জোট ক্ষমতায় এলে তিনি প্রধানমন্ত্রীও হতে পারতেন।'

একে একে আঞ্চলিক দলগুলো কংগ্রেসের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করায় কংগ্রেসকে নিশানা করেন তিনি। তৃণমূল কংগ্রেস ও আম আদমি পার্টির মতো আঞ্চলিক দলগুলির সাথে আসন ভাগাভাগি নিয়ে মতানৈক্য ঠেকাতে কংগ্রেসেরই এগিয়ে আসা উচিত ছিল বলে অভিমত অখিলেশের।

বিডি প্রতিদিন/জুনাইদ আহমেদ

 

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর