শুক্রবার, ২৮ জুন, ২০১৩ ০০:০০ টা

সাংবাদিক গৌতম হত্যার দায়ে নয় জনের যাবজ্জীবন

নির্ভীক সাংবাদিক গৌতম দাসকে হত্যার দায়ে ৯ আসামির যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। একই সঙ্গে আসামিদের ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানা, অনাদায়ে আরও এক বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। হত্যাকাণ্ডের প্রায় আট বছর পর গতকাল ঢাকার ১ নম্বর দ্রুতবিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক শাহেদ নূরুদ্দীন এ রায় ঘোষণা করেন। ২০০৫ সালের ১৭ নভেম্বর ভোরে চিহ্নিত সন্ত্রাসীরা দৈনিক সমকালের ফরিদপুর ব্যুরো অফিসে ঢুকে সাংবাদিক গৌতমকে নির্যাতন ও শ্বাসরোধ করে হত্যা করে। রায়ে যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন- আসিফ ইমরান, আসিফ ইমতিয়াজ বুলু, কাজী মুরাদ, কামরুল ইসলাম আপন, আসাদ বিন কাদির, সিদ্দিকুর রহমান মিয়া, তামজিদ হোসেন বাবু, রাজিব হাসান মিয়া এবং আবু তাহের মো. মতুর্জা ওরফে অ্যাপোলো বিশ্বাস। আসামিদের মধ্যে আবু তাহের মো. মর্তুজা ওরফে অ্যাপোলো বিশ্বাস পলাতক রয়েছে। অন্য এক আসামি জাহিদ খান আগেই মারা গেছেন। দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের মধ্যে আসাদ, অ্যাপোলো ও বাবু হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ততার কথা স্বীকার করে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় আদালতে জবানবন্দি দেন। রায় ঘোষণার আগে কারাবন্দী আটজন আসামিকে আদালতে হাজির করা হয়। তবে রায় শুনে আসামিদের মধ্যে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। রায় ঘোষণার সময় আসামিদের স্বজনরাও আদালতে উপস্থিত ছিলেন। রায়ের আদেশে বলা হয়েছে, পলাতক অ্যাপোলো বিশ্বাসকে যেদিন গ্রেফতার করা হবে কিংবা তিনি যেদিন আদালতে আত্দসমর্পণ করবেন সেদিন থেকে তার দণ্ড কার্যকর হবে। এ ছাড়া দণ্ডপ্রাপ্ত আটজন আসামিকে সাজা পরোয়ানা দিয়ে কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হোক। রায় ঘোষণার পর প্রতিক্রিয়ায় দৈনিক সমকালের সম্পাদক গোলাম সারওয়ার বলেন, আসামিদের ফাঁসির আদেশ না হওয়ায় আমরা পুরোপুরি সন্তুষ্ট হতে পারছি না। তাই আদালতের এ আদেশের বিরুদ্ধে আমরা উচ্চ আদালতে আপিল করব।

ফরিদপুর ও ভাঙ্গা প্রতিনিধি জানান, গৌতম দাসের স্ত্রী দিপালী দাস তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, এ রায়ে আমি খুশি নয়। যে রায় প্রত্যাশা করেছিলাম তা পূরণ না হওয়ায় আমি হতাশ। আট বছর ধরে অপেক্ষায় ছিলাম হত্যাকারীদের ফাঁসির রায় হবে, কিন্তু তা হলো না। এ রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করা হবে। ফরিদপুরের সাংবাদিকরা তাদের প্রতিক্রিয়ায় বলেন, এ রায় আমরা মানি না। সাংবাদিকদের পাশাপাশি ফরিদপুরের বিভিন্ন স্তরের মানুষ এ রায়ে সন্তুষ্ট হতে পারেননি। প্রবীণ সাংবাদিক মুন্সী হারুন অর রশিদ তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, এ রায়ে আমরা সন্তুষ্ট হতে পারি না। ফরিদপুর প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি হাবিবুর রহমান হাবিব তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, গৌতম দাস হত্যা মামলায় যে রায় দেওয়া হয়েছে আমরা সাংবাদিক সমাজ তা প্রত্যাখ্যান করছি। ফরিদপুর রিপোর্টার্স ইউনিটির সভাপতি আরিফ ইসলাম বলেন, যে রায় দেওয়া হয়েছে তা দেখে আমরা হতবাক। ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ মাসুদ হোসেন বলেন, আমরা আশা করেছিলাম হত্যাকারীদের ফাঁসির রায় হবে। তা না হওয়ায় স্বভাবতই আমরা হতাশ হয়েছি। শিক্ষাবিদ ও সাংবাদিক প্রফেসর মোহাম্মদ শাহজাহান বলেন, আমরা আরও কঠোর শাস্তি আশা করেছিলাম।

বেলা ১টা ৫৩ মিনিটে গৌতম দাসের বাড়ির উঠোনে কথা হয় গৌতমের বোন পার্বতী দাসের সঙ্গে। তখন পর্যন্ত বাড়ির কেউ জানতেন না গৌতম হত্যার বিচারের রায় হয়েছে। এ প্রতিবেদকের কাছ থেকে রায় শুনে কেঁদে ফেললেন পার্বতী দাস। তিনি বললেন, এ রায় আমরা মানি না। দাদাকে (গৌতম দাস) বাবা বলতেন, তুমি এত করছ কেন? দেশ তোমার জন্য এত কিছু করবে না। দাদা বলতেন, কাউকে না কাউকে দায়িত্ব তো নিতে হবে। দায়িত্ব নিতে গিয়ে মারা গেলেন দাদা। শোক সইতে না পেরে ২০০৭ সালের ২ সেপ্টেম্বর মারা গেলেন আমাদের মা সতীরানী দাস। পরের বছর ২০০৮ সালের ২৩ নভেম্বর মারা গেলেন আমাদের বাবা বলরাম দাস। সর্বশেষ ২০১২ সালে চোখের জলে ভাসতে ভাসতে মারা গেলেন কাকা জয়হিন দাস।

গৌতমদের এখনো একান্নবর্তী পরিবার। গৌতমের কাকি আবার গৌতমের মায়ের আপন বোন। ছোটবেলা থেকে গৌতমকে তিনি মানুষ করেছেন। তিনি ডুকরে কেঁদে উঠলেন। বললেন, আমার বলার কিছু নেই। কেন গৌতম হত্যাকারীদের ফাঁসি হলো না। গৌতমের জন্য আমার সংসার থেকে একে একে তিনজন মারা গেল।

সর্বশেষ খবর