সোমবার, ১০ ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ ০০:০০ টা

নাটোরে যমুনার বিষাক্ত বর্জ্যে বিপন্ন পরিবেশ

নাটোরে যমুনার বিষাক্ত বর্জ্যে বিপন্ন পরিবেশ

যমুনা ডিস্টিলারিজ কোম্পানির বিষাক্ত বর্জ্য শোধনহীন অবস্থায় নারদ নদে ফেলে নদটিকে যেমন ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে, তেমনি নদটির দুই তীরে গড়ে ওঠা নাটোর জেলা শহরসহ ২০টিরও বেশি গ্রামের বাসিন্দা এখন চরম বিপর্যয়ের মুখে পড়েছেন। এক সময়ের দেহ হিম করা গর্জনের  স্রোতবাহী নদ 'নারদ' আজ মৃত। এ নদের আশপাশের এলাকায় দাঁড়িয়ে বুকভরে শ্বাস নেওয়া যায় না, বাতাসে উৎকট দুর্গন্ধ। মানুষের জীবন ওষ্ঠাগত। বাসিন্দাদের দেহে নানা ধরনের ছোঁয়াচে রোগবালাই। 
যমুনা ডিস্টিলারিজের উৎপাদিত দূষিত ও বিষাক্ত বর্জ্য শোধন না করেই সরাসরি এসে পড়ছে নারদ নদে। ফলে দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে দূষিত হচ্ছে নারদ নদের পানিসহ আশপাশের পরিবেশ। এ বর্জ্যের প্রভাবে বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে ঘরবাড়ি। পরিবেশ অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, কারখানার লেগুনে সংরক্ষিত বর্জ্য থেকে দুর্গন্ধযুক্ত গ্যাস চারদিকে ছড়িয়ে বাতাস দূষিত করছে। তরল বর্জ্যের সঙ্গে নির্গত কঠিন বর্জ্য নারদ নদে নির্গত হয়ে নদটি ভরাট হয়ে যাচ্ছে। পরিবেশ অধিদফতরের ল্যাবরেটরিতে যমুনা ডিস্টিলারিজের বর্জ্য নিয়ে পরীক্ষা করা হয়। ওই ফলাফলে উল্লেখ করা হয়েছে, বর্জ্যে পিএইচপির পরিমাণ ৮.১৮ অয়েল অ্যান্ড গ্রিজ ১৭ মিলিগ্রাম পার লিটার, ভাসমান কঠিন পদার্থ ১১০ মিলিগ্রাম পার লিটার এবং বিওডি ৩৫ হাজার ৪০০ মিলিগ্রাম পার লিটারে পাওয়া যায়। অপরদিকে বাংলাদেশের জন্য গ্রহণযোগ্য মাত্রা পিএইচপি ৬ থেকে ৯ অয়েল অ্যান্ড গ্রিজ ১০ মিলিগ্রাম পার লিটার এবং বিওডি ৫০ হাজার মিলিগ্রাম পার লিটার। 
দূষণে অনেক আগেই নাটোর জেলা শহরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত নারদ নদের প্রাকৃতিক পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য নষ্ট হয়ে গেছে। এখন ভূগর্ভস্থ পানিকেও করছে বিষাক্ত। পরিবেশ আইনের কোনো ধরনের তোয়াক্কা করছে না কোম্পানিটি। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দোর্দণ্ড প্রতাপশালী শিল্পপতি নুরুল ইসলাম বাবুলের ভয়ে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করছে না। এদিকে যমুনা ডিস্টিলারিজের বিরুদ্ধে জনমনে ক্ষোভ দীর্ঘদিনের, কিন্তু যখনই মানুষ সোচ্চার হয়েছে তখন কিছু অসাধু মানুষকে ম্যানেজ করে সবাইকে থামিয়ে দেওয়া হয়েছে। প্রায় দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে নাটোর শহরের লেংগুড়িয়া এলাকায় যমুনা ডিস্টিলারিজ কোম্পানি তাদের কার্যক্রম শুরু করে। কারখানাটি চালু হওয়ার পর থেকে দূষিত ও বিষাক্ত বর্জ্য নদে ফেলা শুরু করে। বর্জ্যের কারণে নদের পানি দুর্গন্ধ ও কালচে রঙের হয়ে ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। বিষের তীব্রতার কারণে নদটি মাছশূন্য হয়ে পড়েছে। নারদ নদ নাটোর শহরের মধ্য দিয়ে পশ্চিম দিক থেকে পূর্ব দিকে প্রবাহিত। রাজশাহীর চারঘাটে পদ্মা থেকে বের হয়ে নাটোর থানার কাফুরিয়ার ভেতর দিয়ে প্রবেশ করে কান্দিপাড়ায় এসে মুছাখান নদীর সঙ্গে মিশে যায়। এটি মোটামুটি ৪০ কিলোমিটার দীর্ঘ। নাটোর শহর এলাকায় এটি প্রায় ৬ কিলোমিটার। এক সময় নদটি ছিল খরসে াতা। মূলত এ নদকে ঘিরেই এককালে নাটোরে সম্পদ গড়ে ওঠে। ব্যবসা-বাণিজ্য ও যোগাযোগের ক্ষেত্রে নারদের একটি বড় ভূমিকা ছিল। ১৭০৬ সালে নাটোরের রাজপরিবারের গোড়াপত্তনের রামজীবন ও রঘুনন্দন নাটোরের রাজধানী প্রতিষ্ঠা করেন। তারপর থেকে বাংলার রাজধানী মুর্শিদাবাদের সঙ্গে নাটোরের যোগাযোগের অন্যতম অবলম্বন ছিল নারদ নদ। নারদ নদের কূল ধরে গড়ে উঠেছিল প্রসিদ্ধ গ্রামগঞ্জ, হাটবাজার। নারদের পানি আশপাশের কৃষিকে করেছে সমৃদ্ধ ও উর্বর। কিন্তু কালক্রমে সেই নারদ হয়ে ওঠে নাটোরের দুঃখ। এ নদ এখন আর স্বাস্থ্যকর বাসস্থানের কেন্দ্রবিন্দু নয়, পরিবেশ বিপর্যয়ের কবলে পড়ে হয়ে উঠেছে নাটোরের দুঃখ। অথচ সরকারের বিভিন্ন দফতরে অভিযোগ দিয়েও এর কোনো প্রতিকার পাওয়া যাচ্ছে না। কথাগুলো ক্ষোভের সঙ্গে বলছিলেন সংলগ্ন একডালা এলাকার ভুক্তভোগী সাধারণ মানুষ। যমুনা ডিস্টিলারিজ কারখানা চালু থেকে আজ পর্যন্ত একটি সরু নালার মাধ্যমে নারদ নদে বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ ফেলা হয়। কাঁচামালের বেশির ভাগই বর্জ্য হিসেবে নির্গত হয়। কারখানা চালু হওয়া থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত একটি সরু ক্যানেল বা মোটা পাইপ দিয়ে নারদ নদে এসব বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ ফেলে দেওয়া হয়। একই এলাকার অপর বড় প্রতিষ্ঠান প্রাণ এগ্রো কোম্পানি ২০০০ সালে উৎপাদনে যাওয়ার পরপরই ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টের মাধ্যমে শোধন করে তাদের বর্জ্য নদে ফেলে। অথচ ১৯৮৯ সালে প্রতিষ্ঠিত যমুনা গ্রুপ পরিবেশ আইনের তোয়াক্কাই করছে না। অপরদিকে নাটোর শহরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত তেবাড়িয়া, হুগোলবাড়িয়া, বড়গাছা, মলি্লকহাটি, মীরপাড়া, কান্দিভিটা, কানাইখালী, পটুয়াপাড়া, হরিশপুর, দত্তপাড়া, হালসাসহ বিভিন্ন এলাকার প্রায় ২০ লাখ মানুষ মুখ বুজে সহ্য করছে এই দূষিত বর্জ্যের ভয়াবহ পরিণতি। জিম্মিদশা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য বিভিন্ন আন্দোলন গড়ে উঠলেই টাকা ও মাস্তান লাগিয়ে সে আন্দোলন দমন করা হয়। অন্যদিকে কোম্পানির সৃষ্ট বর্জ্য কারখানা-সংলগ্ন সিংহারদহ, লেংগুড়িয়া, তেবাড়িয়া, হুগোলবাড়িয়া এলাকাবাসী জানান, কারখানার পেছনের পুকুরে উন্মুক্ত অবস্থায় সংরক্ষিত বর্জ্য থেকে দুর্গন্ধযুক্ত গ্যাস চারদিকে ছড়িয়ে বাতাস দূষিত করছে। তারা বলেন, যমুনা কোম্পানির দূষিত বর্জ্য প্রবাহ বন্ধে ও পরিবেশ দূষণ রোধের দাবিতে এলাকাবাসী দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে আসছে। ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাবাসী যমুনা ডিস্টিলারিজ কোম্পানির বিরুদ্ধে পরিবেশ অধিদফতরসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করে কোনো ফল পাচ্ছে না। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পরিবেশ অধিদফতরের রাজশাহীর এক বিভাগীয় কর্মকর্তা বলেছেন, যমুনার দূষণ বিষয়টি নিয়ে জেলা প্রশাসনের সঙ্গে একাধিকবার বৈঠক করা হয়েছে। কিন্তু কেন জানি সব নীরব হয়ে যায়। তাদের বিরুদ্ধে কেউ কথা বলতে চায় না।

সর্বশেষ খবর