পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান ড. হোসেন মনসুর নিজেই স্বীকার করলেন, নতুন গ্যাস সংযোগ বন্ধ থাকায় সারা দেশে কমবেশি দেড় লাখ অবৈধ গ্যাস সংযোগ হয়েছে। এতে প্রতিদিন ১৮ লাখ টাকার গ্যাস চুরি হচ্ছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। ১০০ কিলোমিটারের বেশি অবৈধ পাইপলাইন পর্যন্ত নির্মিত হওয়ারও উদ্বেগজনক খবর ফাঁস করেন ড. হোসেন মনসুর। তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনের কাছে এভাবেই স্বীকারোক্তি দিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, অবৈধ আবাসিক গ্যাস সংযোগের মাধ্যমে প্রতিদিন ৯০ লাখ ঘন ফুট গ্যাস চুরি হচ্ছে। বছরে যার দাম দাঁড়ায় প্রায় ৬৫ কোটি টাকা। পাশাপাশি বাণিজ্যিক গ্যাস সংযোগকে আবাসিক দেখিয়েও প্রতিদিন চুরি হচ্ছে ৬০ লাখ ঘন ফুট গ্যাস, যার দাম বছরে সাড়ে ৪৩ কোটি টাকা। তবে সবচেয়ে বেশি গ্যাস চুরি হচ্ছে শিল্প খাতে। এ খাতে প্রতিদিন চুরির পরিমাণ প্রায় দেড় কোটি ঘন ফুট। বছরে এর দাম ১০৯ কোটি টাকারও বেশি। অবৈধ সংযোগ, বাণিজ্যিক খাতকে আবাসিক দেখিয়ে বিল দেওয়া এবং শিল্প খাতে মিটার ও বিল কারসাজির মাধ্যমে চলছে চুরি। এসব জালিয়াতির কারসাজিতে বছরে লোপাট হচ্ছে আরও অন্তত আড়াইশ কোটি টাকা। অন্যদিকে চোর সিন্ডিকেটের সদস্যরা অবৈধ পাইপলাইন নির্মাণে গ্যাসের জন্য নির্ধারিত এমএস পাইপের বদলে কম দামের জিআই পাইপ, এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে অত্যন্ত নিম্নমানের এমএস পাইপ ব্যবহার করছে। এসব পাইপের চাপ সহ্য করার ক্ষমতা খুবই কম। কিন্তু পাইপলাইনে গ্যাসের চাপ থাকে অনেক বেশি। ফলে এসব অবৈধ পাইপলাইনে চরম ঝুঁকিতে গ্যাস সরবরাহ হচ্ছে। যে কোনো সময় পাইপলাইনগুলোতে বড় ধরনের দুর্ঘটনার আশঙ্কা রয়েছে। বর্তমানে পেট্রোবাংলার অধীনে পাঁচটি বিতরণ কোম্পানি গ্যাস সরবরাহ করছে। এর মধ্যে তিতাস ছাড়া বাকি কোম্পানিগুলো হচ্ছে বাখরাবাদ, কর্ণফুলী, জালালাবাদ ও পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস কোম্পানি।
উদ্বেগজনক হারে চুরি : শিল্প ও আবাসিক খাতে গ্যাস চুরি উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানিগুলোর ভিজিলেন্স টিম থাকলেও সেগুলোর তৎপরতার ওপর ভরসা রাখতে পারছে না মন্ত্রণালয়। এ কারণে মন্ত্রণালয়ের নিজস্ব টিম গ্যাস চুরি বন্ধের জন্য এখানকার শিল্প-কারখানায় হানা দিচ্ছে। তাদের অভিযানে প্রতিনিয়তই ধরা পড়ছে গ্যাস চুরির ঘটনা। সিলগালা করা হচ্ছে মিল-কারখানা। আদায় করা হচ্ছে জরিমানা। কিন্তু এর পরও থামানো যাচ্ছে না চুরির পাগলা ঘোড়া। বিভিন্ন শিল্পাঞ্চলেই মূলত সবচেয়ে বেশি গ্যাস চুরি ও লুটপাটের ঘটনা ঘটছে। ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুরের পাশাপাশি চট্টগ্রাম অঞ্চলেও ব্যাপকভাবে গ্যাস চুরির খবর পাওয়া যাচ্ছে। চট্টগ্রামে কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (কেজিডিসিএল) গ্যাস বিতরণ ও বিপণনকাজ করে থাকে। চট্টগ্রামে নতুন সংযোগ এবং পুরনো গ্রাহকদের চাহিদামতো গ্যাসের জোগান দিতে না পারলেও কেজিডিসিএল কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পাঁচ-ছয়টি শক্তিশালী সিন্ডিকেট নানা কৌশলে গ্যাস চুরির মাধ্যমে হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা। ওয়ান-ইলেভেনে দুদকের কাছে দুর্নীতির দায় স্বীকার করে মুচলেকা দিয়ে আসা কোটিপতি কর্মকতারাও রয়েছেন ওই সিন্ডিকেটে। বন্ধ ঘোষণায় পোয়াবারো : গ্যাস সংকটের কারণে বর্তমান মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পরপরই ২০১০ সালের ১৩ জুলাই আবাসিক নতুন সংযোগ দেওয়া সাময়িকভাবে বন্ধ রাখার নির্দেশ দেয়। আর এরই সুযোগে সারা দেশেই চোরাই সংযোগ দিয়ে এবং ওই সব সংযোগ ব্যবহারকারীর কাছ থেকে প্রতিমাসে কোটি কোটি টাকা বিল আদায় করছেন তিতাস গ্যাসের ঠিকাদার ও অসাধু কর্মকর্তারা। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, সরকারি এ নির্দেশনার তোয়ক্কা না করে ঢাকার পার্শ্ববর্তী গাজীপুরেই গত দুই বছরে এমন অবৈধ সংযোগ দেওয়া হয়েছে সহস্রাধিক।চুনা কারখানায় বন্ধ নেই গ্যাস চুরি : সারা দেশে গ্যাস সংকট নিয়ে জনজীবনে যখন হতাশা নেমে এসেছে, তখন সিদ্ধিরগঞ্জের চুনা কারখানাগুলোতে পড়েছে গ্যাস চুরির হিড়িক। তিতাস গ্যাসের অসাধু কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে বাইপাস লাইনের মাধ্যমে চালানো হচ্ছে গ্যাস চুরির মহোৎসব। সিদ্ধিরগঞ্জের ঘনবসতিপূর্ণ আবাসিক এলাকায় পরিবেশ নীতিমালা অমান্য করে গড়ে উঠেছে নামে-বেনামে ১৬টি চুনা কারখানা। এসব কারখানায় দিন-রাত অবিরাম যে পরিমাণ গ্যাস ব্যবহৃত করা হচ্ছে, এর সঠিক বিল পরিশোধ করা হচ্ছে না।
চুনা শিল্পের মালিকরা তিতাসের কিছু দুনীতিগ্রস্ত অর্থলোভী অসাধু কর্মকর্তাদের সহায়তায় প্রতি মাসে চুরি করছে কোটি কোটি টাকার গ্যাস। মোটা অঙ্কের উৎকোচের বিনিময়ে অসাধু মিটার রিডাররা গ্যাসের মিটারের রিডিং কমিয়ে নামমাত্র বিল তৈরি করছেন। এ ছাড়া মাসিক উৎকোচ দিয়ে চুনা কারখানায় চোরাই সংযোগ দিয়ে ব্যবহার করা হচ্ছে গ্যাস। এতে সরকার হারাচ্ছে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব।