রবিবার, ১৩ এপ্রিল, ২০১৪ ০০:০০ টা

রং লেগেছে পাহাড়ে

রং লেগেছে পাহাড়ে

গতকাল থেকে তিন পার্বত্য জেলায় শুরু হয়েছে বৈসাবী। বাংলা পুরনো বছরকে বিদায় ও নতুন বছরকে বরণ করার লক্ষ্যে এখন উৎসবের আমেজ। পাহাড়িদের কাছে বাংলা বছর হয়ে ওঠে ধর্মীয় ও সামাজিক প্রধানতম উৎসব। নতুন বছরে নতুন পোশাক, নতুন করে জীবনযাপনের মাধ্যমে নতুনভাবে যেন সবকিছু শুরু করতে চায় সবাই।

বান্দরবান, রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ি এ তিন পার্বত্য জেলায় পাহাড়ি-বাঙালির বসবাস শত বছর ধরে। কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া বাঙালি আর পাহাড়িদের মধ্যে এখানে তেমন বিভেদ নেই বলা চলে। পরস্পরের উৎসব পার্বণ এমনকি ধর্মীয় অনুষ্ঠানও যেন সর্বজনীন হয়ে ওঠে পাহাড়ে। এর রেশ চলে আসছে বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ ধরে। বাংলা বছর শেষ হতে শুরু করলেও যেন পাহাড় পায় নতুন রূপ। ঘরে ঘরে বাংলা বছরকে বিদায় জানাতে প্রস্তুতি শুরু হয়। বাঙালিরা পাহাড়ে পহেলা বৈশাখ বা বর্ষবরণ করে বৈচিত্র্যময় অনুষ্ঠানমালার মাধ্যমে। যা সমতলের চেয়েও ভিন্নতর ও বৈচিত্র্যময়। বাংলা বছরের শেষ দুই দিন এবং নতুন বছরের পাঁচ দিন পাহাড়ে চলে উৎসবের ঘনঘটা। প্রতিটি পাড়া হয়ে ওঠে উৎসবমুখর। নুতন পোশাকের পাশাপাশি নতুন করে ঘর সাজিয়ে তোলার চেষ্টা পাহাড়ের সর্বত্র। বাংলা বছরের শেষ দুই দিন মূলত ধর্মীয় কার্যক্রম চালায় পাহাড়ি জনগোষ্ঠী। এ সময় ঘর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে সব গ্লানিকে মুছে ফেলার চেষ্টা থাকে। আবার নতুন বছরের প্রথমদিন মারমা, চাকমা, ত্রিপুরা, তঞ্চঙ্গ্যা, ম্রোসহ আরও কয়েকটি উপজাতি জনগোষ্ঠী (বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী) বুদ্ধমূর্তি নিয়ে শোভাযাত্রা বের করে। এ সময় ধর্মীয় গুরু (ভান্তে) থাকে সামনে, আর পেছনে সারিবদ্ধভাবে উপজাতি নারী-পুরুষ শোভাযাত্রায় অংশ নেয়। নদীর তীরে গিয়ে চন্দনমিশ্রিত পানি দিয়ে বুদ্ধমূর্তিকে ধুয়ে-মুছে নতুন করে যাত্রা শুরুর ধর্মীয় দীক্ষা গ্রহণ করে সবাই। এরপরই শুরু হয় পানি নিয়ে মঙ্গল বারতা প্রকাশ, যাকে পানি খেলা বলে সবাই জানে।

 

পানি ছিটিয়ে মূলত নিজেদের মধ্যে সম্প্রীতি, ভ্রাতৃত্ববোধ জাগিয়ে তোলার পাশাপাশি ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটানো হয়। পরের দিন থেকে চার দিনব্যাপী চলে পাহাড়ের সর্বত্র পানি খেলাসহ বিভিন্ন প্রতিযোগিতা। অন্যদিকে উৎসবের শেষ দুই দিন চলে পাড়ায় পাড়ায় উৎসবমুখর পরিবেশে পিঠা তৈরি। ক্যায়াং এ নিয়ে ভান্তেকে দানের মাধ্যমেই প্রতিবেশী ও আত্দীয়স্বজনের মধ্যেও পিঠা বিতরণ করা হয়। আবার তঞ্চঙ্গ্যাকে ঘিলা খেলা, চাকমাকে নদীর জলে ফুল ভাসিয়ে দেওয়াও স্থানীয়দের পাশাপাশি আগত দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আকর্ষণ করে। গতকাল সকাল ৭টায় রাঙামাটি ত্রিপুরা কল্যাণ ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে আয়োজন করা হয় কাপ্তাই হ্রদে ফুল ভাসানো, বয়োজ্যেষ্ঠদের স্নান ও বস্ত্রদান, ত্রিপুরা তরুণ-তরুণীদের গড়াইয়া নৃত্য, আলোচনা সভা, পুরস্কার বিতরণী ও ঐতিহ্যবাহী পিঠা উৎসব। এ সময় অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের সদস্য অংসু চাইন চৌধুরী, উন্নয়ন বোর্ডে সিনিয়র পরিকল্পনা কর্মকর্তা প্রীতি কান্তি ত্রিপুরা, জনসংযোগ কর্মকর্তা অরুনেন্দু ত্রিপুরা, ত্রিপুরা কল্যাণ ফাউন্ডেশনের সভাপতি সুরেশ ত্রিপুরা ও সাধারণ সম্পাদক ঝিনুক ত্রিপুরা প্রমুখ। চাকমা রীতি অনুযায়ী গতকাল ১২ এপ্রিল পানিতে ফুল ভাসানোর মধ্য দিয়ে তিন দিনের সার্বজনীন উৎসব শুরু হয়। আজ ১৩ এপ্রিল উদযাপিত হচ্ছে মূল বিজু। আগামীকাল ১৪ এপ্রিল অর্থাৎ পহেলা বৈশাখ গোজ্যাপোজ্যে দিন ও বর্ষবরণ উৎসব।

গোজ্যাপোজ্যে দিন নানাবিধ পূজা-পার্বণ আর প্রার্থনার মধ্য দিয়ে তিন দিনব্যাপী উৎসব শেষ হবে। পার্বত্য আদিবাসীদের মতে, বিজু মানে আনন্দ, নতুন করে বেঁচে থাকার স্বপ্ন, সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় আর চেতনার নতুন প্রেরণা। তাই এবার অভাব-অনটনের মধ্যেও যথারীতি উৎসবের আয়োজন করা হয়েছে।

 

সর্বশেষ খবর