রবিবার, ২২ জুন, ২০১৪ ০০:০০ টা
জলবায়ু পরিবর্তন

বৈরী হয়ে উঠছে প্রকৃতি, দুর্যোগ মোকাবিলায় নেই প্রস্তুতি

পৃথিবীব্যাপী অন্যান্য দেশের সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের নির্মম শিকার বাংলাদেশও। এ কারণে আগের চেয়ে দেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বেড়েছে। প্রকৃতি তার কোমলতা হারিয়েছে। তার বদলে স্থান নিয়েছে এক ধরনের বৈরী আচরণ। ঋতুচক্রের পরিবর্তন এখন স্পষ্ট। সময়মতো বর্ষা যেমন আসছে না, তেমনি শীত আসতেও দেরি হচ্ছে। গ্রীষ্মে তীব্র দাবদাহে হাঁসফাঁস করে জীবকুল। দুঃখজনক হলেও সত্য, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর তালিকায় বাংলাদেশের নাম আছে প্রথম দিকে। এ ছাড়া জাতিসংঘ প্রণীত মোর্টালিটি রিস্ক ইনডেক্স অনুযায়ী ভূমিকম্প, বন্যা, ঘূর্ণিঝড় ও ভূমিধসের কারণে সবচেয়ে বিপন্ন দেশগুলোর তালিকায়ও বাংলাদেশ শীর্ষে। সম্প্রতি জলবায়ু পরিবর্তনসংক্রান্ত একটি প্যানেল সতর্ক করে দিয়ে বলেছে, পৃথিবীজুড়ে যে দেশগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের হুমকির মুখে রয়েছে বাংলাদেশ তার অন্যতম। এ কারণে বাংলাদেশের উপকূলবর্তী লাখ লাখ মানুষের জীবিকা ও বাসস্থান হারানোর আশঙ্কা করা হচ্ছে। অথচ জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় এখনো সরকারিভাবে কোনো প্রস্তুতি নেওয়া হয়নি। এমনকি যে ধনী দেশগুলো গ্রিন হাউস সংকটের জন্য দায়ী তারাও এখন পর্যন্ত বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল যেসব দেশ জলবায়ু পরিবর্তনের নির্মম শিকার, তাদের জন্য তহবিল গঠনের ব্যাপারে সহায়ক ভূমিকা পালন করেনি। এটি উদ্বেগজনক যে, অঙ্ফোর্ড ইউনিভার্সিটি সেন্টার ফর দি এনভায়রনমেন্টের ড. ক্যারোলিন সুলিভান প্রস্তাবিত ক্লাইমেট ভালনারিবিলিটি ইনডেক্স অনুযায়ী বাংলাদেশ জলবায়ু ঝুঁকিতে থাকা সবচেয়ে বিপন্ন একটি দেশ। জলবায়ুসংক্রান্ত জাতিসংঘের আইপিসিসির (জলবায়ু পরিবর্তনসংক্রান্ত আন্তঃসরকার প্যানেল) প্রতিবেদনে বলা হয়-জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশিরা সুপেয় পানির অভাব, কৃষি জমির ক্ষতি, খাদ্যসংকট, জীববৈচিত্র্য সংকট ও স্বাস্থ্যসহ নানা সমস্যায় পড়বে। এতে বলা হয়- তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধির সঙ্গে হিমবাহ গলে সমুদ্রপৃষ্ঠর উচ্চতা বাড়বে। এ প্রতিবেদনটি তৈরির সঙ্গে জড়িত বাংলাদেশি বিজ্ঞানী সালিমুল হক বলেন, গ্রিন হাউস কমাতে না পারলে আগামী এক বা অর্ধ শতাব্দীর মধ্যে তাপমাত্রা বেড়ে যাবে। যদি তাপমাত্রা এখন থেকে গড়ে আরও ৪ ডিগ্রি বাড়ে তাহলে মানুষ ও পশুপাখি এর সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারবে না। এর ফলে দেশে বন্যা ও সাইক্লোন বাড়বে। বাংলাদেশ সেন্টার ফর অ্যাডভান্স স্টাডিজের নির্বাহী পরিচালক আতিক রহমান বলেন, পৃথিবীর যে ধনী দেশগুলোর জন্য বাংলাদেশের মানুষ বাস্তুহারা হয়েছে বা হতে যাচ্ছে, তাদের ধনী দেশে বসবাসের অনুমতি থাকা উচিত। ২০৫০ সালের মধ্যে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে দেশের ১৭ ভাগ এলাকা সমুদ্রের নিচে চলে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ কারণে ১৮ মিলিয়ন মানুষ বাস্তুহারা হতে পারে। এ বিষয়ে ইংল্যান্ডের নিউক্যাসেল বিশ্ববিদ্যালয়ের কোস্টাল সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক জন প্যাঠিক জানান, তাপমাত্রা এভাবে বাড়তে থাকলে ২১০০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ১৩ ফুট বেড়ে যেতে পারে। ইতিমধ্যে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে উপকূলবর্তী বিভিন্ন এলাকার মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছে।

এদিকে জলবায়ু পরিবর্তন অব্যাহত থাকায় তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে বঙ্গোপসাগরে আগের চেয়ে ঘূর্ণিঝড়সহ অনান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঘটনা বেড়ে গেছে। একের পর এক নদী-নালা, খাল-বিল শুকিয়ে যাচ্ছে। ভূগর্ভস্থ পানির অভাব তৈরি হচ্ছে। উত্তরাঞ্চলসহ বিভিন্ন জায়গায় মরুকরণ শুরু হয়েছে। আবহাওয়াবিদেরা জানিয়েছেন, বাংলাদেশ 'এল-নিনো'র শিকার হতে যাচ্ছে। এর প্রভাবে মারাত্দক খরার আশঙ্কা আছে। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা অঙ্ফামের গবেষণায় জানা যায়, জলবায়ু পরিবর্তনে উপকূল ও নদী ভাঙনে প্রতি বছর ৫০ হাজার থেকে ২ লাখ মানুষ ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। লবণাক্ততার জন্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আরও ১ লাখ ২০ হাজার লোক। ইতিমধ্যে জলোচ্ছ্বাস ও উত্তাল সাগরে ৩ থেকে ৪ লাখ লোক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। এক জরিপে দেখা যায়, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে গত এক দশকে মানুষ ডায়রিয়া, কলেরা, ম্যালেরিয়া, ফাইলেরিয়া, ডেঙ্গু, পানিশূন্যতা, হৃদরোগ, মানসিক রোগ, চর্মরোগ, কালাজ্বর ও পুষ্টিহীনতায় বেশি আক্রান্ত হয়েছে। আবহাওয়া অধিদফতরের হিসাবে জুন থেকে নভেম্বর পর্যন্ত আগে বছরে চার থেকে ছয়টি নিম্নচাপ হতো। গত কয়েক বছরে তা বেড়ে কমপক্ষে ১২টি হয়েছে।

বিশিষ্ট জলবায়ু বিজ্ঞানী ড. আহসান উদ্দিন আহমেদ বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পৃথিবীর উষ্ণতা গত পাঁচ দশকে শূন্য দশমিক ৭ ডিগ্রি বেড়েছে। তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মূলত উন্নয়নশীল দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের ওপর পড়বে। বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদফতরের জলবায়ু ডিভিশনের এক সিনিয়র ডিউটি ফোরকাস্টিং কর্মকর্তা বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। তিনি জানান, জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাবের বিষয়ে আবহাওয়া অধিদফতর এখনো গবেষণা কার্যক্রম শুরু করেনি।

 

 

 

সর্বশেষ খবর